আত্মবিশ্বাসী: ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের আগের দিন অনুশীলনে বিরাট কোহালি এবং মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। এএফপি
যদি কেউ মনে করে থাকেন, পুলওয়ামা আর বালাকোট শব্দ দু’টো সব চেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে ম্যাঞ্চেস্টারে মহারণের আগে, ভুল ভাবছেন!
বরং ইংল্যান্ডে সব চেয়ে বেশি ভারত-পাকিস্তান বংশোদ্ভূতদের উপস্থিতি থাকা শহরে দ্বিপাক্ষিক তিক্ততাকে দূরে সরিয়ে রেখে শান্তির আবহে ক্রিকেট দ্বৈরথকে উপভোগ করার ডাক দেওয়া হচ্ছে। আর সেই অভিযানে দু’দেশের বর্তমান ও প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা তো বটেই, বিশ্বের ক্রিকেট মহলও জড়িয়ে পড়েছে। ক্রিস গেল বিশেষ স্যুট পরে ছবি টুইট করেছেন। এক দিকে ভারতের গেরুয়া রং, অন্য দিকে পাকিস্তানের সবুজ। গেলের মতো অনেকেরই দু’দেশে বন্ধুবান্ধব ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁদের কাছে এটা মন আর হৃদয়কে ভাগাভাগি করতে বলার মতো ব্যাপার।
কিন্তু বিরাট কোহালি? তাঁর তো আর হৃদয় এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় হওয়ার নেই। তবু তিনি ঢাল-তরোয়াল নিয়ে উপস্থিত হচ্ছেন না, ব্যাট-বলেই সীমাবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করছেন। কোহালি জিততে চান, কিন্তু যুদ্ধের ডাক দিয়ে শিঙা ফোঁকাফুঁকি করে নয়, ক্রিকেটীয় দ্বৈরথে টেক্কা দিয়ে জিততে চান।
শনিবার ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ভারত অধিনায়ক যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে এলেন, প্রেস কনফারেন্স রুমকে মনে হচ্ছিল, ম্যাঞ্চেস্টার অপেরা হাউস। বসার জায়গা মুহূর্তে সব ভরে গিয়েছে। বিশাল ঘরে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। তার মধ্যে রবিবারের ম্যাচ নিয়ে জিজ্ঞেস করায় কোহালি বলে দিলেন, ‘‘ক্রিকেট ভক্তরা নিশ্চয়ই তাঁদের মতো করে ভাবতে পারেন। আমি তো আর তাঁদের বলে দিতে পারি না, কী ভাবে তাঁরা এই ম্যাচকে দেখবেন। তবে আমরা পেশাদারি ভঙ্গিতে আর একটা ম্যাচ হিসেবেই দেখছি। প্রত্যেকটা ম্যাচ যেমন জিততে চাই, এটাও চাই।’’ এর পরেই দ্রুত ভক্তদের উদ্দেশে ভারত অধিনায়কের বার্তা, ‘‘রবিবার ম্যাঞ্চেস্টারে একটা ভাল ক্রিকেট ম্যাচ হতে যাচ্ছে। সকলে উপভোগ করুন।’’
পাকিস্তানের সাংবাদিকেরাও দেখা গেল কোহালির বক্তব্য শুনে সম্ভ্রমে ঘাড় নাড়ছেন। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁদের কেউ কেউ বলতে থাকলেন, ‘‘কী দারুণ কথা বলে গেল! সে দিন স্টিভ স্মিথকে ভারতীয় দর্শকরা বিদ্রুপ করছে দেখে হাততালি দেওয়ার আবেদন জানাল। এ বার পাক ম্যাচ নিয়ে এত সুন্দর বার্তা। সত্যিই এই বিশ্বকাপে ক্রিকেটকে খেলার বৃত্ত ছাড়িয়ে অন্য মহাকাশে নিয়ে যাচ্ছে কোহালি।’’
কোথায় যুদ্ধের আবহ! এ তো সত্যিই শান্তির সাদা পতাকায় মোড়া ম্যাচ খেলার প্রতিজ্ঞা। যেখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই থাকবে কিন্তু বল্লমের খোঁচা থাকবে না। উৎকর্ষের ঝনঝনানি হবে, বোমাবর্ষণ চলবে না। পাক সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া দেখে কোহালিকে ২০০৪-এর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় মনে হচ্ছিল। পনেরো বছর আগে পাকিস্তানে গিয়েছেন ‘দিল জিতলো’ সিরিজে। তার আগে কার্গিল ঘটে গিয়েছে। সে বার পাকিস্তান থেকে সিরিজ আর ‘দিল’ দু’টোই জিতে ফিরেছিলেন সৌরভ।
ম্যাঞ্চেস্টারের মাঠ থেকে কোহালিও বিশ্বকাপের সব চেয়ে ধুন্ধুমার ম্যাচে বিজয়ীর মুকুট পরে বেরোতে পারবেন কি না, সময় বলবে। কিন্তু শনিবারই দু’টো দল অলিখিত মউ সাক্ষর করে ফেলল যে, যুদ্ধের বাতাবরণে তাঁরা এই ম্যাচ খেলবেন না। খেলবে চিরকালের সেই ভারত-পাক ক্রিকেটের নিয়মে। যেখানে মাঠের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই থাকে আর মাঠের বাইরে বন্ধুত্ব। কোহালির মতো পাক অধিনায়ক সরফরাজ় আহমেদ প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলনে আসেননি। এলেন তাঁদের বিদেশি কোচ মিকি আর্থার। কিন্তু যুদ্ধং দেহি মনোভাবের চিহ্ন তাঁর কথাবার্তাতেও নেই।
আরও বড় শান্তির ছবি দেখা গেল দুপুরের দিকে। কোহালিরা প্র্যাক্টিস সেরে মাঠ থেকে বেরোচ্ছেন। পাকিস্তান ঢুকছে। অনেককেই দেখা গেল হাত মিলিয়ে কথাবার্তা বলছেন। তাতে সেই পুরনো ভারত-পাক ক্রিকেট আবেগের ছোঁয়া। যখন ইকবাল কাশিম দিল্লিতে এলে বিষাণ সিংহ বেদীর বাড়িতে উঠতেন। আর পাকিস্তানে ভারতীয় দল গেলে জাভেদ মিয়াঁদাদ ঘোরাতে নিয়ে যেতেন। একটু আগে শোয়েব মালিকের নিয়ে দরাজ প্রশংসা করে বিবৃতি দিয়ে গিয়েছেন কোহালি। সানিয়া মিজ়ার স্বামী অবসর নিচ্ছেন। কোহালি বলে দিলেন, ‘‘পাকিস্তানের সব চেয়ে সফল এক খেলোয়াড় চলে যাচ্ছে। ক্রিকেট ওকে মিস করবে।’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে যতই সীমান্তে কাঁটাতারের উচ্চতা বাড়ুক, যতই দ্বিপাক্ষিক আলোচনা তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকুক, যতই যুদ্ধ-যুদ্ধ আবহ তৈরি হয়ে যাক, যতই দু’দেশের আকাশে পরস্পরের বিমান ওড়া নিয়ে অশান্তির কালো মেঘ ছড়িয়ে থাকুক, ক্রিকেট বরাবরের মতো ফের শান্তির পতাকা নিয়েই হাজির হচ্ছে। হালফিলের সব চেয়ে স্পর্শকাতর ভারত-পাক ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল রবিবারের ম্যাঞ্চেস্টারের। কিন্তু প্রাক-দ্বৈরথ মহড়ায় ক্রিকেট মহল ‘নব’ ঘুরিয়ে যেন ক্রিকেট বহির্ভূত নানা উত্তেজনার ডেসিবেল কমিয়ে দিতে চাইছে। শুধু ক্রিকেট মহলই বা বলি কী করে, সকালে মাঠে আসার সময়ে পাকিস্তানি ট্যাক্সি ড্রাইভারও তো বলে দিলেন, ‘‘এটা মোটেও যুদ্ধ নয়। শুধুই একটা ম্যাচ।’’
এই ম্যাঞ্চেস্টারেই ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ভারত হারিয়েছিল পাকিস্তানকে। সে দিন পাক অধিনায়ক ছিলেন ওয়াসিম আক্রম। ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে এখানে বহু দিন কাউন্টি ক্রিকেট খেলা আক্রম ম্যাঞ্চেস্টারে অসম্ভব জনপ্রিয়। দুপুরের দিকে হঠাৎই ফোন পাওয়া গেল প্রাক্তন পাক অধিনায়কের। ‘‘আমার একটা বার্তা আছে রবিবারের ম্যাচ নিয়ে। আপনাদের সংবাদপত্রের মাধ্যমে বলতে চাই,’’ বলে আক্রম দীর্ঘ বিবৃতি দিলেন, ‘‘দু’দেশের ক্রিকেট ভক্তদের কাছেই অনুরোধ করব, এটাকে যুদ্ধ হিসেবে ভাববেন না। এটা নিঃসন্দেহে বিশ্বকাপের সব চেয়ে বড় ম্যাচ, তবু বলব, মনে রাখবেন, এটা শুধুই একটা ক্রিকেট ম্যাচ। ক্রিকেট মঞ্চে দু’দেশ কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে অনেক লড়াই একসঙ্গে লড়েছে। ভক্তদের বলব, সেই বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ রেখে ক্রিকেটীয় দ্বৈরথ উপভোগ করুন।’’
আক্রম মানে এটাকে ব-কলমে টিম ইমরান খানের বক্তব্য হিসেবেও পড়া যেতে পারে। এখনও ইমরানকে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে ডাকেন তাঁর বাঁ-হাতি পেস কিংবদন্তি। এমন মারমার-কাটকাট ম্যাচের আগে আক্রমের বিরানব্বই বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের দিক থেকে গা গরম করা কোনও বিবৃতি নেই। বরং আপাতত ক্রিকেটীয় দ্বৈরথকে ক্রিকেটের আঙিনাতে ছেড়ে রাখো, দ্বিপাক্ষিক তিক্ততার প্রিজমে রবিবারের ম্যাচকে দেখো না—এমন বার্তাই পাক প্রধানমন্ত্রী ঘনিষ্ঠমহলে দিয়ে রেখেছেন বলে শোনা গেল।
ফুটবলের ডার্বির জন্য বিখ্যাত শহরে ক্রিকেটের মহারণ। দুই ম্যাঞ্চেস্টার ফুটবল দলের মুখোমুখি হওয়ার মতোই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মুখোমুখি সাক্ষাৎ। মনে হয়েছিল, কাশ্মীর বেশি বার উচ্চারিত হবে কভার ড্রাইভের চেয়ে। কিন্তু কোহালি থেকে আক্রম সকলের মুখে একটাই স্লোগান— এটা যুদ্ধ নয়, ক্রিকেটীয় দ্বৈরথ। উপভোগ করুন। খেলার মাঠে এসপার-ওসপার দ্বৈরথও আসলে শান্তির বার্তা নিয়ে হাজির হতে পারে। ম্যাঞ্চেস্টার প্রমাণ করতে চাইছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy