নজরে: বিরাটদের দল নির্বাচন নিয়েও উঠছে জোরালো প্রশ্ন। ফাইল চিত্র
ভারতীয় ক্রিকেটরের পয়মন্ত ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। যেখানে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে তিরাশিতে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল কপিল দেবের ভারত। তার পরে ইংল্যান্ডকে সেমিফাইনালে হারিয়ে ফাইনালের যোগ্যতা অর্জন। সেই ঐতিহাসিক ট্রামলাইনের পাশেই লেখা থাকল বিরাট কোহালির দলের অপ্রত্যাশিত বিদায়কাহিনি। এমনই অবাক করে দেওয়া এই ফল যে, লন্ডনে ট্যাক্সি ড্রাইভার পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ফাইনালে ওঠার আনন্দে হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘আমরাও ধরে নিয়েছিলাম, লর্ডসে ভারতই আসবে ফাইনাল খেলতে।’’ কিন্তু কেন এই হার? কোথায় ভুল হল? খোঁজার চেষ্টা করল আনন্দবাজার।
বড় মঞ্চে ব্যর্থ তারকারা: ভারতীয় মিডল অর্ডার এবং মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ব্যাটিং ভঙ্গি নিয়ে বিতর্কের ঝড়ের মধ্যেও লুকোনো যাচ্ছে না আরও এক কঠিন বাস্তব। ফের বড় মঞ্চে ভারতের তারকা ব্যাটসম্যানেরা ফ্লপ। ২০১৫ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে ৩২৮ তাড়া করতে নেমে ভাল শুরু করলেও রোহিত শর্মা, শিখর ধওয়ন এবং বিরাট কোহালি ফিরে যান ১৫ রানের ব্যবধানে। সেই ধাক্কা আর সামলে ওঠা যায়নি। তার পরে ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। ওভালে পাকিস্তান বড় রান তোলার পরে মহম্মদ আমিরের ওপেনিং স্পেলে ধ্বংস হয়ে যায় ভারতীয় ব্যাটিং। সে-দিনও তিন ওভারের মধ্যে ফিরে যান রোহিত এবং বিরাট। কিছু ক্ষণের মধ্যে শিখর যোগ দেবেন এবং ৩৩-৩ হয়ে গিয়ে ওভালে তলিয়ে যাবে ভারত। তার পরে ২০১৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল এবং বুধবার ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেও দেখা গেল ম্যালেরিয়ার কুইনিন এখনও পাওয়া যায়নি। রোহিত, কোহালি, রাহুলকে হারিয়ে পাঁচ রানে তিন উইকেট হয়ে গিয়ে সেই যে ভূকম্পন ঘটল, ধোনি আর জাডেজার ১১৬ রানের পার্টনারশিপও সূচনার সেই ধাক্কা থেকে বার করে আনার পক্ষে যথেষ্ট হল না। অথচ শিখর চোট পেয়ে ছিটকে যাওয়ার পর থেকে গ্রুপ পর্বে দলকে টেনেছেন এই ত্রয়ী। প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ রান এসেছে তাঁদের ব্যাট থেকে। রোহিত একাই পাঁচটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। দারুণ ছন্দে ছিলেন কেএল রাহল এবং কোহালিও। তা হলে কি নক-আউট ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ‘চোক’ করে যাচ্ছে টপ অর্ডার ব্যাটিং?
অতীত বিপর্যয়ের মিল-অমিল: আগের দু’টি উদাহরণের সঙ্গে এ বারের তফাত হচ্ছে, অনেক কম রান তাড়া করতে হচ্ছিল। ২০১৫-য় অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে তুলেছিল ৩২৮। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালে পাকিস্তান তোলে ৩৩৮। আর বুধবার এজবাস্টনে নিউজ়িল্যান্ড করেছিল ২৩৯। পিচ কঠিন থাকলেও রিজার্ভ ডে-তে খেলা গড়ানোয় ব্যাটিং নীতি ঠিক করার জন্য অনেক বাড়তি সময় পেয়েছিল দল। নিউজ়িল্যান্ড কিন্তু হোমওয়ার্ক করে এসেছিল। ছ’মাস আগে মেঘলা আবহাওয়া পেয়ে হ্যামিল্টনে তারা ভারতকে শেষ করে দিয়েছিল একশোর কমে। কেন উইলিয়ামসন জানতেন, কোহালিদের মাত করতে হবে সুইং বোলিং আর আক্রমণাত্মক ক্রিকেটে। হিসেব বলছে, মেঘলা আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরিরা প্রথম দশ ওভারে একটাও বাজে বল করেননি। একটা দল অতীতের নকশা মাথায় রেখে খেলতে নেমেছিল। অন্যটা অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি। ফল? ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে দুঃস্বপ্নের স্কোরকার্ড। আর আগের দু’বারের সঙ্গে মিল হচ্ছে, বাঁ-হাতি পেসারের সামনে বিপর্যস্ত দেখানো। নিউজ়িল্যান্ডের হয়ে শুরুতে ম্যাট হেনরির স্পেল বেশি ভয়ঙ্কর দেখালেও ট্রেন্ট বোল্ট ছিলেন আসল আতঙ্ক। জাডেজার উইকেটটাও তুলে নেন তিনিই। আর আগের দু’বার তেমনই ঘাতক ছিলেন মিচেল জনসন-মিচেল স্টার্ক বাঁ-হাতি জুটি এবং মহম্মদ আমির।
মানসিক দাওয়াই কোথায়: এজবাস্টনে ভারতকে হারানোর পরে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারেরা দুরন্ত জয়ের রহস্য ফাঁস করেছিলেন। জানিয়ে দেন, এসপার-ওসপার ম্যাচ খেলতে নামার আগে তাঁরা মনোবিদের ক্লাস করেছিলেন। কেন? না, তার ঠিক আগেই ম্যাচ হেরে সেমিফাইনালের যোগ্যতা অর্জন করাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকে তাই মনোবিদের সামনে বসে খোলাখুলি ভাবে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করেন। পুরো দল শপথ নেয়, সত্যি কথা লুকোব না। মনোবিদ অনেককে জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের কি ভয় করছিল মাঠে দাঁড়িয়ে? হারার আতঙ্ক তাড়া করছিল? অনেকে জানান, হ্যাঁ, করছিল। রোগ নির্ণয় করতে বেশি সময় নেননি মনোবিদ। ফল? মানসিক জড়তা কাটিয়ে, ভয় দূর করে ভারতের বিরুদ্ধে খেলতে নামে এক দুঃসাহসিক ইংল্যান্ড দল। আর এজবাস্টনে জিতেই টুর্নামেন্টে প্রবল ভাবে ফিরে আসে তারা। অতীতে ভারতীয় ক্রিকেটেও এই ধরনের বিশেষজ্ঞ এনে ক্লাস করার উদাহরণ রয়েছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সময় ২০০৩ বিশ্বকাপে মনোবিদ হিসেবে উড়িয়ে আনা হয়েছিল স্যান্ডি গর্ডনকে। তিনি স্লোগান তৈরি করে দিয়েছিলেন দলের জন্য— ‘নাউ অর নেভার’। পরবর্তী কালে বিখ্যাত অভিযাত্রী মাইক হর্নকে ভারতীয় দলের সঙ্গে দেখা গিয়েছে। দুর্ধর্ষ সব অভিযানের অভিজ্ঞতার কাহিনি শুনিয়ে হর্ন মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটারদের। কলকাতা নাইট রাইডার্স শিবিরে এসেও তাঁর দুঃসাহসিক অভিযানের নানা গল্প শুনিয়ে গিয়েছেন হর্ন। এমনকি, ব্রাজিলে যে বিশ্বকাপ জিতল জার্মানি, সেখানেও মুলার, লাম-রা নিয়ে গিয়েছিলেন বিখ্যাত অভিযাত্রীকে। বিশ্বকাপে চাপ সামলানোটাই সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। লম্বা টুর্নামেন্টে সব সময় সেরা মানসিক অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। সেই কারণে মানিসক দাওয়াই এগিয়ে দিতে গর্ডন বা হর্নের মতো দক্ষ বিশেষজ্ঞের দরকার পড়ে। কিন্তু ভারতীয় দলের বিশ্বকাপ অভিযানে কার কত বিশ্রাম দরকার, তা বোঝার জন্য জিপিএস আন্দোলন ছাড়া আর কোনও ‘আউট অব দ্য বক্স’ ভাবনা দেখা যায়নি।
বিস্ময়কর দল নির্বাচন: দু’বছরের উপরে চলল এক সোপ অপেরা! যার নাম ‘ইন্ডিয়ান মিডল অর্ডার গ্যাম্বেল’। নানান লোককে নিয়ে পরীক্ষা করা হল। মণীশ পাণ্ডে অস্ট্রেলিয়ায় সেঞ্চুরি করার পরেও তাঁর উপরে আস্থা দেখানো হল না। অজিঙ্ক রাহানে ছিলেন। টেস্টে পাঁচ নম্বর এবং ২০১৫ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ায় চার নম্বরে দারুণ খেলেছিলেন। টেকনিক ভাল। তাঁকে পছন্দ হল না। নিয়ে আসা হল অম্বাতি রায়ডুকে। তাঁকে দিয়ে হবে না বুঝে শেষ মুহূর্তে বিজয় শঙ্কর। কারও কারও মনে হচ্ছে, এর চেয়ে সুরেশ রায়নাকে নিয়ে এলেও হত। কেদার যাদবের চেয়েও রায়না ভাল পছন্দ হতে পারতেন। ২০১১ বিশ্বকাপজয়ী দলে ধোনির সঙ্গে রায়না ‘ফিনিশারের’ ভূমিকা দারুণ ভাবে করে দিতেন। সঙ্গে কয়েক ওভার হাত ঘোরাতে পারতেন। এবং, দুর্ধর্ষ ফিল্ডার। মাঝখানে ভারতীয় দল চেষ্টাও করেছিল রায়নাকে ফেরানোর। তেমন দাগ কাটতে পারেননি রায়না। কিন্তু আর একটু বেশি সময় তাঁর উপরে আস্থা দেখানোই যেত। জনপ্রিয় মত হচ্ছে, অন্তত তিনটি বাজে নির্বাচন নিয়ে কোহালিরা এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। এক) চার নম্বরে বিজয় শঙ্কর। তিনি দলেই জায়গা পাওয়ার যোগ্য নন। দুই) কেদার যাদবের পরিবর্তে আরও ফিট, আরও তেজীয়ান কাউকে দরকার ছিল। কেদার বছরের অর্ধেক সময় ফিজিয়োর সঙ্গে থাকেন। তিন) দীনেশ কার্তিককে অতিরিক্ত উইকেটকিপার হিসেবে দলে ঢোকানো। কার্তিকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাব হয় ধোনিরও আগে। আর বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেললেন ২০১৯-এ, চৌত্রিশ বছর বয়সে। একটি দলে তিন জন উইকেটকিপার খেলানো হচ্ছে মানে কি দেশে বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান নেই? কোনও সন্দেহ নেই, প্রথম অবস্থাতেই ঋষভ পন্থকে দ্বিতীয় উইকেটকিপার হিসেবে নিয়ে আসা উচিত ছিল। কার্তিকের জায়গায় এক জন অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান আনা যেত। কোহালি, শাস্ত্রী-সহ টিম ম্যানেজমেন্টের দিকে যেমন আঙুল উঠবে, তেমনই মনে রাখা দরকার, ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সব চেয়ে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নির্বাচক কমিটির মেয়াদ চলছে এখন। সকলে মিলে দশ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতাও নেই। এখনকার চেয়ারম্যান এসএসকে প্রসাদ। খেলেছেন ৬টা টেস্ট আর ১৭টা ওয়ান ডে। যেখানে দিলীপ বেঙ্গসরকরের মতো প্রাক্তন অধিনায়ক নির্বাচক প্রধান হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন। সেমিফাইনাল বিপর্যয়ের পরে একাংশের ‘টার্গেট’ হয়ে গিয়েছেন রবি শাস্ত্রী। হেড কোচ হিসেবে বিপর্যয়ের দায় নিতেও হবে তাঁকে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বিশ্বকাপের দল নির্বাচনী সভায় তিনি ছিলেন না কেন? কোচকে ছাড়া কী করে হয়ে গেল বিশ্বকাপের দল নির্বাচন? কার্তিক না পন্থ, এই আলোচনা যখন চলছিল, তখন হেড কোচ থাকলে কী বলতেন? গত দু’বছর ধরে লোঢা কমিটির সংস্কার নিয়ে টালবাহানায় ঠিকমতো কোনও ক্রিকেট বোর্ডই নেই। কোন কমিটি আছে, কোনটা নেই, কেউ জানে না। বিশ্বকাপের আগে কী কী প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা নিয়ে উচ্চ স্তরের কোনও বৈঠকই হল না। কারও কারও মনে হচ্ছে, এই ফল প্রাপ্যই ছিল।
ধোনি-ধাঁধায় বিদ্ধ: দলের মধ্যে কখনও কারও মধ্যে সন্দেহ ছিল না যে, বিশ্বকাপে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে দরকার। শাস্ত্রী থেকে শুরু করে কোহালি, নির্বাচক কমিটি, সকলে এ ব্যাপারে একমত ছিলেন। কথা হল, ধোনি নিয়ে আবেগ এক জিনিস। আর তিনি যে ফুরিয়ে আসছেন, সেই বাস্তব পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়ার মেরুদণ্ড দেখাতে পারা আর এক জিনিস। তিনি যে-পরিমাণ বল নষ্ট করছেন, তা কোনও ভাবেই মেরামত করা সম্ভব নয়। সেমিফাইনালেই যেমন জাডেজার সঙ্গে পার্টনারশিপ হতই না ধোনি ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে না-থাকলে। আবার এটাও সত্যি যে, পুরনো ধোনির তুলনায় ইনি সম্পূর্ণ ম্রিয়মাণ ছিলেন। মাত্র একটা চার আর একটা ছয় মারতে পেরেছেন। তর্ক অব্যাহত যে, রান আউট না-হলেও ‘ফিনিশার’ ম্যাচ জিতিয়ে ফিরতে পারতেন কি না। কথা উঠেছে, ধোনিকে আরও আগে পাঠানো হল না কেন? কারও কারও বিশ্লেষণ, আরও আগে পাঠালে আরও খারাপ হতে পারত। ধোনি চার নম্বরের ব্যাটসম্যান নন। তাঁর খেলাটাই পাঁচ বা ছয় নম্বরে নেমে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ টেনে নিয়ে গিয়ে তার পর নক-আউট পাঞ্চ মারা। আগে এটা তিনি ছ’বারে ছ’বার করে দেখাতেন। এখন ছ’বারে হয়তো মেরেকেটে এক-আধ বার পারছেন। শেন ওয়ার্ন, মাইকেল আথারটনেরা যদিও পাশে দাঁড়াচ্ছেন ধোনির। তাঁদের মতে, পাঁচ রানে তিন উইকেট গিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল ভারত। ধোনি আর জাডেজা অবিশ্বাস্য লড়াই করেছেন। তাঁদের প্রশংসাই প্রাপ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy