Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

হিউম বোমায় নীলের দর্পচূর্ণ

দু’জনের মধ্যে একটু-আধটু নয়, প্রথম দর্শনে মিল প্রভূত। তা ফুটবল-বোধে হোক বা ইন্দ্রলুপ্তে। শারীরিক ভাবে দু’জনেই ভাল শক্তপোক্ত, একটা খুনে কাঠামোর সদর্প উপস্থিতি দু’জনকে দেখলেই টের পাওয়া যায়। আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের সঙ্গে যদি ‘বস’ শব্দটা আপনাআপনি বসাতে হয়, তা হলে ইয়ান হিউমের ভাল প্রতিশব্দ ‘হি-ম্যান’। মাথা ফাটুক না ফাটুক, ফেট্টি বেঁধে নামতে হোক চাই না হোক, কিছুতেই যেন কিছু যায় আসে না! এবং সময় বিশেষে যেন টিমের ‘বস’-এর চেয়েও ধারালো, তার চেয়েও নিষ্ঠুর।

সুনীলদের পাড়ায় হিউমের হ্যাটট্রিক-উৎসব। ছবি আইএসএল

সুনীলদের পাড়ায় হিউমের হ্যাটট্রিক-উৎসব। ছবি আইএসএল

সোহম দে
মুম্বই শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

দু’জনের মধ্যে একটু-আধটু নয়, প্রথম দর্শনে মিল প্রভূত। তা ফুটবল-বোধে হোক বা ইন্দ্রলুপ্তে।

শারীরিক ভাবে দু’জনেই ভাল শক্তপোক্ত, একটা খুনে কাঠামোর সদর্প উপস্থিতি দু’জনকে দেখলেই টের পাওয়া যায়। আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের সঙ্গে যদি ‘বস’ শব্দটা আপনাআপনি বসাতে হয়, তা হলে ইয়ান হিউমের ভাল প্রতিশব্দ ‘হি-ম্যান’। মাথা ফাটুক না ফাটুক, ফেট্টি বেঁধে নামতে হোক চাই না হোক, কিছুতেই যেন কিছু যায় আসে না! এবং সময় বিশেষে যেন টিমের ‘বস’-এর চেয়েও ধারালো, তার চেয়েও নিষ্ঠুর।

রবিবার রাতের নভি মুম্বইয়ে লোপেজ হাবাসকে দেখা গেল, টিমের ‘হি-ম্যান’-কে নিয়ে কী বলবেন, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। একবার বললেন, হিউম আসলে একটা বোমা। যে রবিবার মুম্বইয়ের ডেরায় ফেটেছে এবং প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে ছেড়েছে। আবার একু পর বললেন, কানাডা স্ট্রাইকার নাকি এতটাই ইউটিলিটি ফুটবলার যে তাঁকে যে কোনও পজিশনে নামিয়ে দেওয়া যায়। এমনকী ডিফেন্সেও! তা হাবাস নামাতেই পারেন। হিউমকে ‘বোমা’ বলে ডাকতেই পারেন। কারণ, বিশ্ব এত দিন মানববোমা কাকে বলে শুনেছিল। রবিবার মুম্বইয়ের মাঠে তা আছড়ে পড়তে দেখল।

হিউম্যান নয়। হিউম-বম্ব!

ফাটা মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে যিনি নিকোলাস আনেলকার মুম্বইকে নব্বই মিনিট ধরে ছিন্নভিন্ন করে গেলেন। ঠোঁটে খুনে হাসি আর পায়ে বুলেট-গতি নিয়ে যিনি সুব্রত পালের প্রাচীর খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিলেন বারবার। টিমকে হারের হ্যাটট্রিকের অন্ধকূপ থেকে এক ঝটকায় বার করে আনলেন নিজের হ্যাটট্রিক দিয়ে। এবং সবচেয়ে বড়, তিনি আজ দ্বৈত শাপমোচন ঘটিয়ে গেলেন।

তাঁর নিজের। তাঁর কোচের।

অথচ সন্ধে সাতটার ডি ওয়াই পাটিল ভাবতেও পারেনি, কী অপমান পরবর্তী দেড় ঘণ্টায় তাদের উপর আছড়ে পড়তে চলেছে। ভিভিআইপি বক্সে তখন ঋষি কপূর এবং যত দূর দৃষ্টি যায় নীল পতাকার সমুদ্র। সঙ্গে হাড় হিম করা হাজার চল্লিশের নাদ—মুম্বই...মুম্বই...। তার উপর আবার প্রথম থেকে নিকোলাস আনেলকা। মুম্বই যেন ধরেই নিয়েছিল যে, মধ্যবর্তী দেড় ঘণ্টা সময়ের স্রেফ অপচয় মাত্র। স্কোরলাইনটা চোখ বুজে লিখে ফেলা যায়— মুম্বই জিতছে।

দেড়ও লাগল না, পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে সে উৎসবকে গলা টিপে খুন করে গেলেন। পঁয়ত্রিশে প্রথম, পঁয়তাল্লিশের মাথায় দ্বিতীয়। গ্যালারির দেখা গেল, চোখমুখে ঘোর অবিশ্বাস নিয়ে মোটামুটি চিত্রার্পিত দশা। স্বাভাবিক। ‘আহত’ কানাডা স্ট্রাইকার যে এ ভাবে আতঙ্ক হয়ে উঠতে পারেন, কে ভেবেছিল। যে লোকটা আইএসএল-টু-তে এত দিন একটাও গোল পাননি, তাঁর শাপমুক্তি কি না হ্যাটট্রিকে! এ তো বলিউডি চিত্রনাট্য, বাস্তব নয়। মুশকিল হল, মুম্বই দর্শক যদি ইয়ান হিউমের উইকিপিডিয়াটা একটু উল্টে নিতেন, এতটা অবিশ্বাস্য লাগত না। ফুটবল খেলার কথাই তো ছিল না তাঁর। মাথার খুলি একবার ফেটে জীবন বিপণ্ণ হয়েছিল হিউমের। হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল অনেক দিন। এবং মাঠে ফিরেও অসুস্থ হয়ে ফের ভর্তি হতে হয়েছিল হাসপাতালে। তিনি মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে হ্যাটট্রিক করবেন না তো কে করবেন? রবিবারের মুম্বইয়ে হিউম দু’টো জিনিস বুঝিয়ে দিলেন। এক, গত আইএসএলে ইলানো ব্লুমারকে টপকে তিনি এমনি-এমনি টপ স্কোরার হননি। আর দুই, তিনি যে দিন রুদ্রমূর্তি ধরবেন কোনও হেল্ডার পোস্টিগাকে মনে পড়বে না।

আন্তোনিও লোপেজ হাবাস— তাঁকে নিয়েও প্রশ্ন ওঠা তো এখন কিছু দিন বন্ধ থাকবে। শোনা গেল, এ দিন সকালে টিমের ফুটবলারদের তিনি বলে দিয়েছিলেন যে, দ্যাখো জেতার জন্য তোমাদের চাপ দিচ্ছি না। কিন্তু গোল খেও না। এমন দুর্ধর্ষ জয়ের পরেও নিজেকে শান্ত রাখলেন। টিমকে শান্ত রাখলেন। আটলেটিকো ড্রেসিংরুমের উৎসবের বাড়াবাড়ি এ দিন হয়নি। সাধারণ অভিনন্দন পর্ব, ব্যস। রবিবার মাঠের হাবাসও একই রকম। শান্ত, ধৈর্যশীল। আনেলকা-সুনীল-নর্ডি সমন্বিত মুম্বই আক্রমণের ঝাড়বাতি তিনি নিভিয়ে দিলেন বুদ্ধিমত্তায়। মাঝমাঠে পাঁচ জন নামিয়ে নিজ-অঞ্চল দুর্ভেদ্য করে দিলেন। আনেলকার সঙ্গে সুনীল-সনির যোগসূত্র ভাঙলেন। ফাইনাল বলগুলো জিতলেন। আর বল পজেশনে রেখে গোলের মুখ খোলার চেষ্টা করলেন। অর্থাৎ, ট্রেডমার্ক হাবাস। কিন্তু তাতেও বাঁচা যেত না। যন্ত্রী ভাল হলে তো শুধু হয় না। যন্ত্রকেও সমান ভাল হতে হয়। হাবাসের ভাগ্য ভাল যে, টিমের চরম দরকারের সময় তিনি হিউম-বম্বকে পেয়ে গেলেন। গত বছর গোল খেলে কী হবে তা ভাবতে হত। কিন্তু এ বছর হিউম বোমা হাবাসের তূণে জায়গা নেওয়ায় সেই ভয়টা কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে।

চ্যাম্পিয়নশিপ এখনও এভারেস্ট, কিন্তু তার দিকে তাকানোর সাহস তো এখন দেখানো যেতে পারে। স্বপ্নের দিকে আবার হাঁটা যেতে পারে। স্বস্তির অক্সিজেন নিয়ে লাল-সাদা সমর্থকরা আরও বাঁচতে পারেন ক’টা দিন।

কোমায় থাকা রোগী এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারত?

আটলেটিকো: অমরিন্দর, তিরি, ডেঞ্জিল, অগাস্টিন, বোরহা, নাতো, জুয়েল (অর্ণব), নবি (রিনো), গ্যাভিলান (লারা), সামিগ, হিউম।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE