আরাতার গোল।
ফুটবলমহলে অনেকেই বলে থাকেন তাঁর বিষণ্ণ মনের ডায়েরিতে লেখা রয়েছে দু’টো নাম।
প্রথমটা— ক্লাইভ টমাস। প্রাক্তন ওয়েলস রেফারি। আর দ্বিতীয়টা— মার্সিও নুনেজ। ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগে খেলা প্রাক্তন ডিফেন্ডার।
এফসি গোয়ার মহাতারকা কোচ জিকো মনে করেন, এই দু’জনই তাঁকে মারাদোনার মতো অতিমানবিক ফুটবলার হতে দেয়নি। ক্লাইভ আটাত্তরের বিশ্বকাপে সুইডেন ম্যাচে একদম শেষ সেকেন্ডে জিকোর গোলমুখী হেড হাওয়ায় বল থাকাকালীন খেলা শেষের বাশি বাজিয়ে দেন। আর নুনেজ নাকি তাঁকে হাঁটুতে এমন জখম করেছিলেন যে, ছিয়াশির বিশ্বকাপে আর পুরনো ছন্দ কিছুতেই পাননি জিকো।
আইএসএলের সৌজন্যে আটলেটিকো দে কলকাতা কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস নামটা এ বার উঠতে পারে সাদা পেলে-র মনের বিষণ্ণ ডায়েরিতে তৃতীয় নাম হিসেবে। যিনি জিকোকে কিনা ভারতের মতো ফুটবল দেশে এখনও পর্যন্ত পাঁচ বারের সাক্ষাতে এক বারও জিততে দেননি!
ম্যাচের পর এই প্রশ্নটা শুনে অবশ্য কপাল কুঁচকোলেন জিকো। ‘‘কিন্তু পাঁচ বারের মধ্যে হেরেছি তো মাত্র এক বার।’’ কিন্তু পস্টিগা, অর্ণব, রিনো, জোসেমি, জুয়েল কেউ এ দিন কলকাতার প্রথম একাদশে নেই। বলজিতও লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে গেলেন। দশ জনের কলকাতাকে আধ ঘণ্টারও বেশি পেয়েও তো হাবাসের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে জিতে ফিরতে পারলেন না জিকো। এর পরেও কি এটা প্রবাদপ্রতিম ব্রাজিলীয়র নৈতিক পরাজয় নয়? এ বার জিকো— ‘‘আমাদেরও বিক্রমজিৎ, প্রণয়দের নিয়ে প্রথম দলের চার জন ফুটবলার ছিল না।’’
মুখে এই ব্যাখ্যা দিলেও কাজে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় ম্যাচেই ‘মার্কি’ পস্টিগা-হীন কলকাতাকে নিজেদের জিম্মায় পেয়ে লুসিও, লিও, রোমিও, মন্দারদের মতো অস্ত্র ব্যবহার করে হাবাস-বধের মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন জিকো। আর্নোলিনের ‘বিখ্যাত’ গেমসম্যানশিপ প্রয়োগও বাদ ছিল না! কিন্তু শেষমেশ মগজাস্ত্রের লড়াইয়ে জিকোর বিরুদ্ধে অপরাজিতই রয়ে গেলেন কলকাতার স্প্যানিশ কোচ।
বরং আটলেটিকো কলকাতার কোচ তো এ দিন গোয়ার মাঠে চচ্চড়ির মশলা দিয়েই বিরিয়ানি রাঁধলেন! প্রশ্নটার জবাবে বেদনার হাসি হাবাসের চোখেমুখে। সীমিত সামর্থ নিয়ে যে ভাবে তিনি অ্যাওয়ে ম্যাচে এফসি গোয়ার উইং-ঝড় থামিয়ে দিয়েছিলেন তা ফুটবলের এক অসাধারণ ট্যাকটিক্যাল পরিকল্পনা হিসেবে প্রশংসা পেতেই পারে। আরবসাগরের তীরের শহরে পা রেখে গত দু’দিন ধরে রোমিও-লুসিওদের অকেজো করার এই অঙ্কটাই তিনি কষে গিয়েছেন।
গোয়া ডিফেন্সে লুসিও যতই বড় নাম হোন না কেন, এ দিনের ম্যাচ দেখাল বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলীয় স্টপার এখন আনফিট। ম্যান মার্কিং পর্যন্ত ঠিকঠাক করতে পারছেন না। যে সুযোগ কাজে লাগিয়ে এ দিন ম্যাচের শুরুতেই কলকাতাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন আরাতা। দুর্ভাগ্য হাবাসের। এগিয়ে গিয়েও তিনি জিতে মাঠ ছাড়তে পারলেন না। প্রথমত তাঁর দলে কোনও এক বলজিৎ সাইনি নামে ফুটবলার থাকায়! আর দুই, দ্বিতীয়ার্ধে গোয়া যখন অলআউট আক্রমণে তখন কলকাতা কোচ হিউমকে পর্যন্ত নিচে নামিয়ে একটু বাড়তিই রক্ষ্মণাত্মক হয়ে যান। না হলে ওই রকম সময় একটা আচমকা প্রতি-আক্রমণে হিউম গোল পেয়ে গেলে জেতা নিয়ে কোনও সমস্যা হত না হাবাসের।
ম্যাচের পর উপস্থিত আটলেটিকো কর্তাদের কেউ কেউ গজগজ করছিলেন তাঁদের ‘পঞ্জাব দা পুত্তর’-এর জন্যই। আর হাবাস শুধু বললেন, ‘‘লাল কার্ডের ঘটনার সময় কে ভুল করল তা বেশ কিছুটা দূরে হচ্ছিল বলে ঠিক মতো দেখতে পাইনি।’’
সত্যিকারের পেশাদার কোচ যতই তাঁর প্লেয়ারের ঢাল হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন না কেন, দশ জন হয়ে গিয়ে গোয়াকে ম্যাচে ফিরতে দেওয়ার জন্য বলজিৎই দায়ী। জিকোর দলে প্লে-অ্যাক্টিংয়ে এ দিন ‘উত্তমকুমার’ আর্নোলিন। গত বার এই ম্যাচটায় আটলেটিকোর গোলমেশিন ফিকরুকে ‘হেড বাট’ বিতর্কে জড়িয়ে ফেলে মাঠে তাণ্ডব শুরু করিয়ে দিয়েছিলেন এই আর্নোলিন। বলজিৎ সে দিন ছিলেন রাইট ব্যাকে। এ দিন ফের আর্নোলিন যে এ বার বলজিতকেই গেমসম্যানশিপের জালে জড়াতে চলেছেন আটলেটিকো ফুটবলারটি সেটা বুঝতে চূড়ান্ত ব্যর্থ। সবচেয়ে বড় কথা, গত বারের ফিকরুর ‘হেড বাট’ থেকে কোনও শিক্ষা নেননি বলজিৎ। যা অবস্থা এখন, আইএসএলের শৃঙ্খলারক্ষার কমিটির শাস্তির কোপেও পড়তে পারেন তিনি। আটলটিকো শিবির সূত্রে খবর, বলজিৎ তাঁকে মাথা দিয়ে আঘাত করার আগের মুহূর্তে আর্নোলিন নাকি গালাগাল করেছিলেন। বলজিৎ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেননি। পারলে এ রকম ‘মার্কি-হারা’ প্রতিকূল অবস্থাতেও দু’ম্যাচ থেকে ছয় পয়েন্ট নিয়ে হাসতে হাসতে কলকাতায় পা রাখত পারত হাবাসের দল। তবু কঠিন টুর্নামেন্টের শুরুতেই জোড়া অ্যাওয়ে ম্যাচ থেকে চার পয়েন্টও খারাপ কী!
এবং তার জন্য কৃতিত্ব যার সবচেয়ে বেশি তাঁর নাম আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। যিনি ফুটবল খেলাটার ক্ষুরধার ট্যাকটিকাল জ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিলেন জিকোকে।
হাবাস তাই মাঠ ছাড়ার আগে বলে যেতে পারলেন, ‘‘পস্টিগা নেই, সাতটা হলুদ কার্ড, একটা লাল কার্ড, বিপক্ষের ডিফেন্সিভ ফুটবল— এত কিছুর বিরুদ্ধে পুরোপুরি লড়া যায় নাকি? তার উপর এই রেফারিং! এখানকার রেফারিংয়ের জন্যই এ বার ভারতে আসার আগে আমি এত চিন্তা-ভাবনা করেছিলাম।’’
হাবাসের দলের এ দিন যতটুকু নম্বর কাটা যাচ্ছে সেটা তাদের ম্যান মার্কিং আর ব্লকিংয়ে। যার গলদেই কিনানের সমতা ফেরানো। হাবাস বলছেন, ‘‘ভুলের সঙ্গে সঙ্গে চোটেরও মাশুল গুণতে হল আমাদের।’’
এবং গোয়া বনাম কলকাতা হবে আর তাতে বিতর্ক থাকবে না তা হয় নাকি? এ দিনও তার ব্যতিক্রম হল না। ৬৩ মিনিটে গোয়ার ডেনসনের পরিবর্তে জোনাটনকে নামানো নিয়ে এক দফা হয়ে গেল যেমন। আটলেটিকো শিবিরের দাবি, ‘‘ওই সময় গোয়া সাত জন বিদেশি নিয়ে খেলেছে।’’ যার পাল্টা হিসেবে জিকো বলে গেলেন, ‘‘আমরা আগে কিপার এলিনটনকে তুলে কাট্টিমণিকে নামানোর কথা চতুর্থ রেফারিকে জানিয়েছিলাম। উনি নাকি প্লেয়ার পরিবর্তনের যে ইলেকট্রনিক বোর্ড সেটা চালাতে জানেন না। তাই ওই ভুল বোঝাবুঝি। আমাদের কী দোষ!’’
আটলেটিকো দে কলকাতা: অমরিন্দর, ডেঞ্জিল, নাতো, টিরি, অগাস্টিন, বোরহা, গ্যাভিলান (জোসেমি), বলজিৎ, আরাতা (নবি), লারা (ভালদো), হিউম।
ছবি: পিটিআই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy