প্রহরী: ইস্টবেঙ্গলের গোলে দঁাড়িয়ে বহু আক্রমণ এ ভাবেই রুখে দিতেন ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। লাল-হলুদের সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলকিপার হিসেবে শতবর্ষেও তাঁর নামই আসছে। ফাইল চিত্র
ওকোরি চিমা তখন মধ্যগগনে। মহমেডানের হয়ে গোলের পর গোল করে চলেছে। ১৯৮৫-তে সেই চিমাদের বিরুদ্ধে কলকাতা লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। না জিততে পারলে খেতাবের দৌড় থেকে ছিটকে যাবে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু সেই ম্যাচে একই সঙ্গে আমার আর মনোরঞ্জনের চোট। সবাই আতঙ্কে। ইস্টবেঙ্গলের কোচ তখন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। চোটের জন্য দু’দিন ধরে অনুশীলনেই আসতে পারলাম না। নানা টোটকা ব্যবহার করলাম। কখনও হাঁটুতে গঙ্গার মাটি মাখলাম। কখনও কবিরাজি ওযুধ খেলাম। সঙ্গে সারাদিন নানা ব্যায়াম চলছেই। আমাদের সময়ে এ রকমই চলত। তবু হাঁটতে পারছি না।
ম্যাচের আগের দিন মাঠে এলাম। আমার সতীর্থ গোলকিপার তখন বিজন চক্রবর্তী। মনা (মনোরঞ্জন) এসে আমাকে বলল, ‘‘আমি খেলতে পারছি না। তুই না খেললে যদি হেরে যাই, তা হলে সব শেষ। চিমা খেলছে ওদের দলে।’’ মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা আলোড়ন হল। ইস্টবেঙ্গল হারবে? সবাই বলল, ইঞ্জেকশন নিয়ে খেল। রাজি হয়ে গেলাম। ডাক্তার এম এস ঘোষ আমার হাঁটুতে ইঞ্জকশন দিলেন। নেমে পড়লাম। চিমা একটা গোল করলেও ম্যাচটা আমরা জিতলাম ২-১ গোলে।
আরও একবার তিরুচিরাপল্লিতে ইঞ্জেকশন নিয়ে মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছিলাম ইস্টবেঙ্গলকে জেতাতে। সেটা ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনাল। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলা। ইস্টবেঙ্গল কোচ প্রয়াত অমল দত্ত। চোট পেয়ে অনুশীলনই করতে পারিনি তিন দিন। ওখানকার নানা ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। সবাই বলছে, মাঠে নামা সম্ভব নয়। কিন্তু অমলদা বললেন, ‘‘তোকে নামতেই হবে। ডাক্তার যা-ই বলুক, ইঞ্জেকশন দিয়ে নামাব।’’ তাই হল। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে জিতেছিলাম ওই ম্যাচটায়।
আমি এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটি। হাঁটতে গেলে সমস্যাও হয়। তার প্রধান কারণ অন্তত ১৫-১৬ বার ইস্টবেঙ্গলকে জেতানোর জন্য ইঞ্জেকশন নিয়ে নামতে হয়েছে মাঠে। এটা তারই ফল। অন্তত ডাক্তারেরা তাই বলেন। তাতে অবশ্য আমার দুঃখ নেই। কারণ মায়ের জন্য যদি রাত জাগতে পারি, জীবন বাজি রাখতে পারি, তা হলে দ্বিতীয় জন্মদাতার জন্য এটা তো কিছুই নয়।
ইস্টবেঙ্গলে ১৪ বছর খেলেছি। দু’বার নানা কারণে ক্লাব ছেড়ে অন্য দুই প্রধানে খেলেছি। কিন্তু কোনও ক্লাবকে অসম্মান না করেই বলছি লাল-হলুদ জার্সি, ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের আবেগের বিস্ফোরণ বা ড্রেসিংরুমের পরিবেশ অন্য কোথাও পাইনি। এখানেই তো আমার পুনর্জন্ম হয়েছিল ছিয়াত্তরে। বলতে পারেন, আমার জন্মদাত্রী মা হলেও দ্বিতীয় জন্মদাতার নাম সে জন্যই ইস্টবেঙ্গল। বলতে পারেন, ফুটবলার জীবনের আশ্রয়দাতাও। লাল-হলুদ জার্সি পরার সুযোগ না পেলে কোথায় যে হারিয়ে যেতাম, জানি না। ইস্টেবঙ্গল জার্সি পরে বারপোস্টের নীচে না দাঁড়ালে কেউ ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়কে চিনত? এই ক্লাবে খেলেই তো আমার দেশের অধিনায়ক হওয়া। দেশের হয়ে ৫০টিরও বেশি ম্যাচ খেলার পিছনেও সব কৃতিত্ব ইস্টবেঙ্গলের কর্তা, সদস্য, সমর্থকদের। একশো বছরের ক্লাবে আমি একজন সৈনিক, এটা ভাবলেই মনটা ভাল হয়ে যায়। বাঁচার রসদ পাই। যত দিন বাঁচব, তত দিনই আমি ইস্টবেঙ্গলের হয়েই থাকব।
ইস্টবেঙ্গলে আমার যোগদানটাও তো নাটকীয় ভাবে। বলা যায়, কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবে।
এখনও এত দিন পরেও মোহনবাগানের গোলের নীচে দাঁড়িয়ে সেই দিনের কথা মনে পড়লে শিউরে উঠি। পঁচাত্তরের সেই অভিশপ্ত ডার্বি ম্যাচ। উনিশ বছর বয়স আমার। জীবনের প্রথম ডার্বিতে চার গোল খেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছি। রাস্তা-ঘাটে সবাই আমাকে দেখে বলত, ‘‘পাঁচ গোল খাওয়া ভাস্কর।’’ অনেকেই মনে রাখেন না, শেষ গোলটার সময় আমার জায়গায় ছিলেন প্রশান্ত মিত্র। তা সত্ত্বেও এটা এখনও শুনতে হয়। সমর্থকদের ভয়ে আমি তখন দাদার দুর্গানগরের বাড়িতে লুকিয়ে রয়েছি। বাড়ির লোকেরা রাস্তায়ও বেরোলে গালাগাল দিচ্ছে মোহনবাগানের সমর্থকেরা। এই অবস্থায় লুকিয়ে অনুশীলন করলেও ভাবতাম, আমার আর ময়দানে খেলা হল না। খেলা ছেড়ে অন্য কিছু করার কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম।
রাতের পর রাত ঘুমোতাম না। এ রকম যখন অবস্থা, তখনই পেলাম ইস্টবেঙ্গলের প্রস্তাব। প্রয়াত সচিব পল্টু দাশ এবং ফুটবল রিক্রুটার জীবন চক্রবর্তী আমাকে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দিতে বললেন এখনকার এক শীর্ষ কর্তার মাধ্যমে। প্রস্তাবটা পেয়ে প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তাঁবুতে আসার পরে পল্টুদা পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘‘তুই দেশের সেরা গোলকিপার হবি। ইস্টবেঙ্গলে সই কর।’’
মনে হল বাবার হাত। কোচ তখন অমল দত্ত। দলে সুরজিৎ সেনগুপ্ত, তরুণ বসু, শ্যামল ঘোষ, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়ের মতো ফুটবলার। বিশ্বাস করুন, একবারও ওঁরা বুঝতে দিতেন না, আমি সেই চার গোল খাওয়া ভাস্কর। ওঁরা আমাকে আগলে রাখতেন ভাইয়ের মতো। বন্ধুর মতো। ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমের এমনই পরিবেশ ছিল তখন। অমলদা নতুন প্রতিভা পেলে তাকে তারকা বানানোর জন্য প্রাণপাত করতেন। প্রথম বছর তেমন সুযোগ পাইনি। কিন্তু পরের বার রাশিয়া থেকে পাখতাকোর বলে একটা ক্লাব এসেছিল প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে। হঠাৎ সেই শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে আমাকে নামিয়ে দিলেন অমলদা। আমি বরাবরই সাহসী। নেমে পড়লাম চ্যালেঞ্জ নিয়ে। নিশ্চয়ই ভাল খেলেছিলাম, না হলে লিগের সেই ডার্বিতে অমলদা আমাকে নামিয়ে দেবেন কেন? মিহির বসু এবং সমরেশ চৌধুরীর গোলে শক্তিশালী মোহনবাগানকে হারিয়ে দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। বলতে পারেন, ওই ম্যাচটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। তার পর প্রচুর ডার্বি খেলেছি। ৩০-৪৫টা তো হবেই। হেরেছি, জিতেছি। অধিনায়কত্ব করেছি। কিন্তু এই ডার্বি (তখন বলা হত বড় ম্যাচ) আমার কাছে
অন্য রকম।
১৯৮৩-তে ডিসিএমে খেলতে গিয়ে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলাম। কামড়ে দিয়েছিলাম এক ফুটবলারের পায়ে। সে বার অস্ট্রেলিয়া থেকে স্পেয়ারউড একাদশ নামে একটা ক্লাব দল খেলতে এসেছিল। ফাইনাল খেলছি। কৃষ্ণগোপাল চৌধুরীর গোলে এগিয়ে রয়েছি। ওরা চেপে ধরেছে। হঠাৎ-ই আমার সঙ্গে লেগে গেল ঝামেলা। ওদের এক বড় চেহারার স্ট্রাইকার আমাকে জাপটে ধরল। ওকে ছাড়াতে ওর পায়ে কামড়ে দিলাম। শুনেছিলাম, অস্ট্রেলিয়ানরা কামড়কে খুব ভয় পায়। এবং কী আশ্চর্য, ওই কামড়ের ভয়ে বাকি ম্যাচে কেউ আমার কাছে আসেনি। ম্যাচটা ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল।
ইস্টবেঙ্গল গোলে দাঁড়ানো প্রচণ্ড চাপের। লাল-হলুদ সমর্থকরা চান সব ম্যাচ জিততে। এবং সেই চাহিদা এতটাই তীব্র যে, গোল খেলে আর রক্ষে নেই। আমাদের দল গোল খেলে ইট, কাঠ, পাথর তো খেতেই হত, বাড়ি ফিরতে হত পুলিশের গাড়িতে। আর জিতলে ওরা এমন করত যেন বিশ্বের সব কিছু ওদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ১৯৭৮ সালে উয়াড়ির কাছে হেরে লিগ খেতাব থেকে ছিটকে গিয়েছিলাম আমরা। ১৯৮২-তে পুলিশের অরুণ নাথের শট করা বল এমন ভাবে গোলে ঢুকেছিল যে আটকাতে পারিনি। ইট, কঠ এসে মাথায় পড়েছিল। আবার ডার্বি বা ট্রফি জিতে সমর্থকদের কাঁধে চেপে কত বার যে তাঁবুতে ফিরেছি তারও হিসেব নেই। এটাই ইস্টবেঙ্গলে খেলার মহিমা। লাল-হলুদের আবেগের সঙ্গে অন্য কারও তুলনা আমি স্বপ্নেও আনতে পারি না।
(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy