আনোয়ার আলি। — ফাইল চিত্র।
মাস দুয়েক আগে মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গলে সই করেছিলেন আনোয়ার আলি। সেই সময় ফিফার নিয়ম দেখিয়ে লোনের চুক্তি ভেঙে নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে যাওয়ার জন্য আনোয়ার, ইস্টবেঙ্গল এবং দিল্লি এফসি-র কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল মোহনবাগান। বিভিন্ন ঘটনার পর সেই বিষয়টি এখন প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটির (পিএসসি) অধীনে। ফিফার ট্রান্সফার সংক্রান্ত আর একটি নিয়ম বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়েছে। তবে আনোয়ারের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছিল ‘লোনের’ চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে। এ ক্ষেত্রে ‘স্থায়ী’ চুক্তি ভেঙে বেরোনোর অভিযোগ উঠেছে। আনোয়ার ফিফার নিয়ম কাজে লাগিয়ে চুক্তি ভেঙেছিলেন। ফ্রান্সের প্রাক্তন ফুটবলার ফিফার নিয়মেরই বিরোধী।
কী হয়েছে ইউরোপে?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ আদালত একটি রায়ে জানিয়েছে, ট্রান্সফার সংক্রান্ত ফিফার নিয়ম ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনবিরোধী। ফ্রান্সের প্রাক্তন ফুটবলার লাসানা দিয়ারার একটি আবেদনের রায় দিয়ে আদালত জানিয়েছে, ফিফার নিয়ম আইনবিরুদ্ধ। যদিও ফিফা এই কথা শুনে তাদের আইন বদলাবে কি না তা জানা যায়নি।
ফিফার ট্রান্সফার সংক্রান্ত নিয়মে বলা হয়েছে, স্থায়ী চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে যদি কোনও ফুটবলার যথাযথ কোনও কারণ ছাড়াই চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যেতে চান তা হলে তাঁর ক্লাবকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পাশাপাশি যে ক্লাবে সই করবেন তাদেরও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ইউরোপীয় আদালতের দাবি, ইউরোপীয় শ্রমিক আইন অনুযায়ী এই নিয়ম কোনও কর্মচারীর স্বাধীন চলাফেরা এবং অন্য সংস্থায় যোগ দেওয়ার অধিকারের পরিপন্থী। এতে ওই কর্মচারীর অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এই নিয়মকে অপেশাদারও বলা হয়েছে।
রাশিয়ার লোকোমোটিভ মস্কোর খেলোয়াড় দিয়ারা ২০১৪ সালে এক বছরের মাথায় চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁর সঙ্গে ক্লাবের চুক্তি ছিল চার বছরের। পরের বছর বেলজিয়ামের ক্লাব শার্লেরইয়ের প্রস্তাব পেয়ে সেখানে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিফা সে সময় আন্তর্জাতিক ট্রান্সফার সার্টিফিকেটে (আইটিসি) সই করতে রাজি না হওয়ায় শার্লেরই দিয়ারাকে সই করানোর ব্যাপারে পিছিয়ে আসে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদালতের রায় অনুযায়ী আইটিসি সই করতে রাজি না হওয়াও আইনবিরোধী।
২০১৫ সালে ফিফা দিয়ারাকে নির্দেশ দেয় ক্ষতিপূরণ বাবদ ১ কোটি ইউরো (৯২ কোটি টাকা) লোকোমোটিভকে দেওয়ার জন্য। রিয়াল মাদ্রিদের প্রাক্তন ফুটবলার দিয়ারা ফিফা এবং বেলজিয়ান ফুটবল সংস্থার বিরুদ্ধে স্থানীয় আদালতে মামলা করেছিলেন। দিয়ারার আইনজীবী জানিয়েছিলেন, ফিফার এই আইনের জন্য সকল পেশাদার ফুটবলারেরা ভুগছে। তাঁর আশা ছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন ভাঙার অপরাধে ফিফা এই আইন সংশোধন করবে। তা এখনও হয়নি।
কী হয়েছিল আনোয়ারের ক্ষেত্রে?
আনোয়ারের ক্ষেত্রেও ফিফার ট্রান্সফার নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তবে স্থায়ী চুক্তি নয়, লোনের চুক্তি। গত ১১ জুলাই ফুটবল কর্তা রঞ্জিত বজাজের একটি পোস্টকে ঘিরে ঘটনার সূত্রপাত হয়। রঞ্জিত জানিয়েছিলেন, ফিফার নতুন নিয়মে কোনও ফুটবলারকে এক বছরের বেশি ‘লোনে’ রাখতে পারে না কোনও ক্লাব। সেই নিয়মের আওতায় পড়ছেন আনোয়ারও। মোহনবাগানে তিনি ইতিমধ্যেই লোনে এক বছর খেলে ফেলেছিলেন। ফলে এ বার তিনি পুরনো ক্লাব দিল্লি এফসি-তে ফিরে যাবেন। সেখান থেকে আইএসএলের কোনও দলে পাকাপাকি ভাবে সই করার চেষ্টা করবেন। একাধিক ক্লাবের প্রস্তাবও নাকি তাঁর কাছে রয়েছে। আনোয়ার নিজেও মোহনবাগানের কাছে চুক্তির বিচ্ছেদ চেয়ে আবেদন করেছিলেন।
মোহনবাগান দাবি করেছিল, আনোয়ার চার বছরের লোনে সবুজ-মেরুনে এসেছেন। যখন তিনি সই করেছেন, তখন এই নিয়ম হয়নি। তা ছাড়া ভারতীয় ফুটবলে এখনও এই নিয়ম চালু হয়নি। ফিফাও জানিয়েছে, ২০২২ সালে এই নিয়ম অনুমোদিত হলেও বিশ্বব্যাপী তা চালু হতে তিন বছর পর্যন্ত সময় নেওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে, ২০২৫ পর্যন্ত সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থা বা এআইএফএফ-এর কাছে সময় রয়েছে এই নিয়ম চালু করার।
আনোয়ারের বিষয়টি কোন দিকে গড়িয়েছে?
বিষয়টি গড়ায় ভারতীয় ফুটবল সংস্থার প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটিতে (পিএসসি)। গত ৩ অগস্ট পিএসসি রায় দেয়, আনোয়ার যে ভাবে চুক্তি ভেঙেছেন তা অনৈতিক। তবে ইস্টবেঙ্গলে খেলতে পারবেন না এমন কথা বলা হয়নি। গত ১১ অগস্ট রাতে কলকাতায় পৌঁছে যান আনোয়ার। তাঁকে স্বাগত জানান ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক এবং কর্তারা। দু’দিন পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে ইস্টবেঙ্গলে আনোয়ারের সই করার খবর জানিয়ে দেওয়া হয়।
গত ১০ সেপ্টেম্বর পিএসসি জানায়, ভারতীয় এই ডিফেন্ডারকে চার মাসের জন্য নির্বাসিত করা হয়েছে। শাস্তি হয় ইস্টবেঙ্গলেরও। বলা হয় আগামী দু’টি ট্রান্সফার উইন্ডোয় কোনও ফুটবলার সই করাতে পারবে না ইস্টবেঙ্গল এবং দিল্লি এফসি। ইস্টবেঙ্গল এবং আনোয়ারকে মিলিত ভাবে ১২ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেই টাকা পাবে মোহনবাগান।
এই রায়ের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন করে ইস্টবেঙ্গল এবং দিল্লি এফসি। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ফেডারেশনের পিএসসি-র নির্বাসন এবং জরিমানার সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয় দিল্লি হাইকোর্ট। পিএসসি-কে আবার বিষয়টি শুনতে বলে। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলায় কোনও বাধা দেওয়া হয়নি। লাল-হলুদ জার্সিতে ইতিমধ্যে তিনি তিনটি ম্যাচও খেলে ফেলেছেন। আগামী ১৪ অক্টোবর আবার শুনানি রয়েছে পিএসসি-র। সেখানে আনোয়ারের ভবিষ্যত নির্ধারিত হতে পারে। এই নিয়ে ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকারের বক্তব্য, ‘‘ফিফা যা নিয়ম করবে, সেটা আমাদেরও মানতে হবে। ফিফার সবার আগে লক্ষ্য, ফুটবলারের স্বার্থ সুরক্ষিত করা। আমরাও সেটাই চাইছি। আনোয়ারের ভবিষ্যৎ যাতে নষ্ট না হয়, সেটা দেখতে হবে।’’
কী বলছে ফিফার আইন?
ইউরোপে দিয়ারার ক্ষেত্রে যে বিষয়ে রায় দেওয়া হয়েছে তা প্রযোজ্য নয় আনোয়ারের ক্ষেত্রে। কারণ দিয়ারা স্থায়ী চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন, যা ফিফার নিয়মবিরুদ্ধ। ফিফার দাবি, এতে অনুমতি দেওয়া হলে গোটা বিশ্বে ট্রান্সফার ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে। খেলোয়াড়েরা যোগ্যতার থেকে বেশি ধনী হয়ে যাবেন। ইচ্ছেমতো চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারবেন। ক্লাবের পরিচালন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে।
আনোয়ারের ক্ষেত্রে, তিনি ফিফার নিয়মেরই সুবিধা নিয়েছেন। ফিফাই জানিয়েছে এক বছরের বেশি কোনও খেলোয়াড়কে লোনে রাখা যাবে না।
মোহনবাগানের একটি সূত্রের দাবি, ইউরোপীয় আদালতের আইন বাকি মহাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে এমন কোনও ব্যাপার নেই। তা ছাড়া স্থায়ী চুক্তির ক্ষেত্রে ফিফার যে নিয়ম রয়েছে তাতে কোনও আপত্তি দেখছেন না তিনি। তাঁর দাবি, নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া স্থায়ী চুক্তি ভেঙে বেরোনোর ক্ষেত্রে ফিফার কঠোর অবস্থানই নেওয়া উচিত।
সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের বক্তব্য, তাদের আইন ফিফার নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও সেটাই করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy