গোলের পর উচ্ছ্বাস পেত্রাতোসের। ছবি: এক্স।
ইস্টবেঙ্গল ১ (ক্রেসপো)
মোহনবাগান ৩ (কামিংস, লিস্টন,
পেত্রাতোস)
রবিবারের সকাল এবং দুপুর শহর কলকাতা তৃণমূল কংগ্রেসের ‘জনগর্জন’ শুনলে, রাতের জনগর্জন নিঃসন্দেহে মোহনবাগানের। আইএসএলের কলকাতা ডার্বিতে আবার দাপট সবুজ-মেরুনের। রবিবার ইস্টবেঙ্গলকে ৩-১ ব্যবধানে হারিয়ে আইএসএলের শীর্ষে উঠে এল তারা। ১৭ ম্যাচে ৩৬ পয়েন্ট নিয়ে ভাল ভাবেই লিগ-শিল্ডের দাবিদার। পাশাপাশি, মুম্বইয়ের থেকে একটি ম্যাচ কম খেলেছে সবুজ-মেরুন।
ডার্বিতে আবার নজর কেড়ে নিলেন দিমিত্রি পেত্রাতোস। একটি গোল করলেন, দু’টি করালেন। এই নিয়ে ডার্বিতে তিনটি গোল হয়ে গেল অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকারের। ডুরান্ড কাপ, আইএসএলের প্রথম পর্বের পর দ্বিতীয় পর্বেও গোল করলেন। মোহন-জনতার কাছে ক্রমশ ডার্বির নায়ক হয়ে উঠছেন পেত্রাতোস। গোল এবং অ্যাসিস্ট ছাড়াও গোটা ম্যাচে বিভিন্ন ভাবে ব্যস্ত রাখলেন ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণকে।
কোনও দলের মানসিকতা একদম তলানিতে থাকলে কী হতে পারে, তার স্পষ্ট প্রমাণ রবিবার ইস্টবেঙ্গলের প্রথমার্ধের খেলা। গোটা অর্ধ ইস্টবেঙ্গলকে দেখে মনে হয়েছে তারা ভাঙাচোরা একটি দল। কারও সঙ্গে কারও বোঝাপড়া নেই। সুপার কাপ জেতার পর যে ছন্দ নিয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে আইএসএলের প্রথম পর্বের ডার্বি খেলেছিল তারা, সেই দলের এই পারফরম্যান্স মেলানো যাচ্ছিল না।
অথচ সেই দলের খেলাই বদলে গেল দ্বিতীয়ার্ধে। যাঁরা ভেবেছিলেন পাঁচ গোলের লজ্জা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হবে ইস্টবেঙ্গলকে, তাঁদের ভাবনা সফল হয়নি। উল্টে ম্যাচ শেষে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের আফশোস, ক্লেটন পেনাল্টি নষ্ট না করলে অথবা দ্বিতীয়ার্ধের খেলা প্রথমার্ধে দেখা গেলে ম্যাচের ফল অন্য রকম হতেই পারত। অনেকে আবার এটাও বলছেন, প্রথমার্ধে তিন গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগানের খেলায় একটু গা-ছাড়া মনোভাব দেখা গিয়েছিল। তার ফায়দা তুলেছে ইস্টবেঙ্গল। তাতে অবশ্য ইস্টবেঙ্গলের ঘরে কোনও পয়েন্ট আসেনি।
সুপার কাপ জেতার পর ইস্টবেঙ্গল দলটাকে ভাল আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল। অনেক দিন পরে মোহনবাগান সমর্থকদের চোখে চোখ রেখে যে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা কথা বলতে পারছেন, সেটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন কোচ কার্লেস কুয়াদ্রাতই। দুর্ভাগ্য, তিনি নিজেই নিজের বানানো সৌধ শেষ করে দিয়েছেন। দলের নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার বোরহা হেরেরা এবং স্ট্রাইকার হাভিয়ের সিভেরিয়োকে লোনে অন্য ক্লাবে পাঠিয়ে দেন। ‘সেট’ দল ভেঙে যায় তখনই। বদলে যে সব বিদেশিদের নিয়ে এসেছেন, তাঁরা আই লিগের কোনও ক্লাবে সুযোগ পেতেন কি না সন্দেহ। এমন অবস্থা যে ডার্বিতে প্রথম একাদশে তাঁদের রাখাই যাচ্ছে না।
এ দিন ম্যাচের শুরুতে আগে আক্রমণ করেছিল ইস্টবেঙ্গলই। ছ’মিনিটের মাথায় বল নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন নাওরেম মহেশ। কিন্তু তাঁর ক্রস ক্লিয়ার হয়ে যায়। সামলে নিয়ে পর পর দু’বার আক্রমণ করে মোহনবাগান। খেলার কিছুটা বিপরীতেই ১২ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি পায় ইস্টবেঙ্গল। আক্রমণের সময় নাওরেম মহেশ পাস বাড়িয়েছিলেন ক্লেটন সিলভার উদ্দেশে। এগিয়ে গিয়ে ফিস্ট করে বল উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিশাল। হাত গিয়ে লাগে ক্লেটনের বুকে। রেফারি তেজস নাগবেঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির নির্দেশ দেন। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি ইস্টবেঙ্গল। এমনিতে ক্লেটন পেনাল্টি খারাপ নেন না। কিন্তু এ দিন নষ্ট করলেন। মোহনবাগানের গোলকিপার বিশালের বাঁ দিকে মেরেছিলেন। তবে শটে খুব বেশি জোর ছিল না। বিশাল বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচিয়ে দেন।
এর পর খেলা যত এগোতে থাকে, মোহনবাগানের আক্রমণ বাড়তে থাকে। ইস্টবেঙ্গল চলে যায় রক্ষণাত্মক কৌশলে। দিমিত্রি এক বার গোলের সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি। ২৫ মিনিটের মাথায় ইস্টবেঙ্গলের লালচুংনুঙ্গা একটা বল নিয়ে দারুণ ভাবে ঢুকে পড়েছিলেন। কিন্তু বলে জোরে টোকা দিয়ে ফেলায় তা সাইডলাইনের বাইরে যায়।
তার দু’মিনিট পরেই গোল খেয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগানের আক্রমণের সময় জনি কাউকো পাস দেন সাহাল সামাদকে। সেই বল ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডার ক্লিয়ার করে দিলেও ফিরতি বল পেত্রাতোসের কাছে গেলে তিনি চলতি বলে নীচু শট নেন। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে সেই শট প্রভসুখন গিল বাঁচালেও বল ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর হাতে লেগে বেরিয়ে আসা বল জালে জড়িয়ে দেন জেসন কামিংস। এর পর পেত্রাতোস এবং কামিংস একসঙ্গে ‘স্টেনগান’ সেলিব্রেশন করলেন, যা আবার মনে করিয়ে দিল সনি নর্দের বিখ্যাত সেই উচ্ছ্বাসকে।
প্রথম বার ভুল থেকেও যে ইস্টবেঙ্গল শিক্ষা নেয়নি, তা বোঝা গেল ১০ মিনিট পরেই। এ বারও মোহনবাগানের গোলের নেপথ্যে সেই পেত্রাতোস। ডান দিক থেকে আক্রমণ করে প্রথম পোস্টে নীচু শট মেরেছিলেন পেত্রাতোস। বারে লেগে তা আবার তাঁর কাছেই ফেরত যায়। অবাক করা হলেও সত্যি, পেত্রাতোসের পাশে ইস্টবেঙ্গলের এক ডিফেন্ডার থাকা সত্ত্বেও তাঁকে আটকাতে পারেননি। ফলে ফিরতি বলেও শট নেন পেত্রাতোস। এ বার শট গোলে ছিল না। কিন্তু বাঁ দিকে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা লিস্টনের পায়ে বল যায়। তিনি হালকা টাচে বল জালে জড়ান। পেত্রাতোসের পাস লিস্টনের কাছে যাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়েছিলেন হিজাজি মাহের। পা লাগিয়ে বল বার করে দিতেই পারতেন। শুধু শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। সুপার কাপে হিজাজিকে নিয়ে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, সেই ফানুস এ বার চুপসে যেতে বাধ্য।
দশ মিনিটের ব্যবধানে মোহনবাগানের তৃতীয় গোল আসে। বক্সে লিস্টন ঢোকার মুখে তাঁকে ফেলে দেন নন্দকুমার। দু’জনের সঙ্ঘর্ষ আদৌ বক্সের মধ্যে হয়েছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মোহনবাগানের তৃতীয় গোল আসা আটকাতে পারেনি। পেনাল্টিতে গোল করায় সুখ্যাতি রয়েছে পেত্রাতোসের। সপাটে শটে প্রভসুখনকে পরাস্ত করেন অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার।
প্রথমার্ধের খেলা শেষের বাঁশি যখন রেফারি বাজালেন, তত ক্ষণে গ্যালারিতে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে, পঁচাত্তরের পাঁচ গোলের স্মৃতি আবার ফিরবে না তো? সাজঘরে ফেরার সময় ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের অবস্থা দেখে কেউ আশান্বিত হতে পারেননি। প্রথমার্ধেই তিন গোল খেয়ে ক্লেটন, নন্দকুমারকে কাঁধ তখন ঝুলে গিয়েছে। মানসিক, শারীরিক ভাবে প্রত্যেকেই যে বিধ্বস্ত তা বোঝা যাচ্ছিল। গ্যালারি থেকে সমর্থকদের ভিড়ও আস্তে আস্তে পাতলা হতে শুরু করেছিল।
সেই ইস্টবেঙ্গল যে দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগানকে এতটা বেগ দেবে, এটা অনেকেই ভাবতে পারেননি। চোট পাওয়া অজয় ছেত্রীর জায়গায় পি ভি বিষ্ণু এবং লালচুংনুঙ্গার জায়গায় সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নামাতেই ইস্টবেঙ্গল বদলে যায়। প্রথম আক্রমণে ওঠে মোহনবাগানই। শুরুতেই কামিংস বক্সে একটি বল পেয়ে জোরালো শট নিয়েছিলেন। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে সেই শট বাঁচান প্রভসুখন। এর পরেই বদলে যায় ইস্টবেঙ্গলের খেলা। একের পর এক আক্রমণ শানাতে থাকে তারা। ৫৩ মিনিটের মাথায় বাঁ দিক থেকে ওঠা ক্লেটনের পাস বুকে রিসিভ করে চলতি বলেই বাঁ পায়ে শট করেন ক্রেসপো। মোহনবাগান গোলকিপার বিশালের কিছু করার ছিল না।
এক গোল শোধ করে তেড়েফুঁড়ে খেলতে থাকে ইস্টবেঙ্গল। ডান দিক থেকে নন্দের ক্রসে হেড করেছিলেন ক্লেটন। বাঁ দিকে শূন্যে ঝাঁপিয়ে বল বাঁচিয়ে দেন বিশাল। নিশ্চিত গোল খাওয়া থেকে বেঁচে যায় মোহনবাগান। তবে ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণ তাতে থামেনি। বিষ্ণু এবং সায়ন বার বার সমস্যায় ফেলতে থাকেন মোহনবাগানের ডিফেন্সকে।
মোহনবাগান আবার খেলায় ফেরে আশি মিনিটের পরে। দু’টি গোলের মতো সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু চতুর্থ গোল আসেনি। ইস্টবেঙ্গলও গোলের ব্যবধান আর কমাতে পারেননি। তবে রেফারি ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজানোর পর দু’দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ক্লেটন রেফারিকে গিয়ে কিছু বলছিলেন। সেই সময় তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন কাউকো। পাল্টা কাউকোর দিকে তেড়ে যান ক্লেটন। তবে দু’দলের আধিকারিকদের তৎপরতায় ঝামেলা বেশি গড়ায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy