ফাইনালে জোড়া গোল করা মেসি নয়, ট্রফি জয়ের আসল কৃতিত্ব মার্তিনেসের বলেই মনে করছে গবেষণা। ফাইল ছবি
আধুনিক ফুটবলে যত দিন যাচ্ছে, ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে পেনাল্টি শুটআউটের ভূমিকা। নকআউট ম্যাচে দুই দলের পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে পেনাল্টি শুটআউটই। মাস তিনেক আগে বিশ্বকাপের ফাইনালেও জয়ী দল নির্ধারিত হয়েছে সে ভাবেই। বিভিন্ন পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, কোনও কোনও দলের সাফল্য শুটআউটে খুবই ভাল। আবার কিছু দল ধারাবাহিক ভাবে শুটআউটে ব্যর্থ হয়েই যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শুটআউট হলে কী ভাবে সাফল্য পাওয়া সম্ভব? কোন পদ্ধতি অনুকরণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে বিভিন্ন দল? কারণ জানতে গবেষণা করেছিলেন নরওয়ের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তিনি মূলত একটি জিনিসের কথাই তুলে ধরেছেন। তা হল, মানসিকতা।
এটা শুধুমাত্র জয়ের খিদে থাকা বা সাফল্য পেতে উদ্গ্রীব হওয়ার মানসিকতা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক কিছুই। মাঠ এবং তার বাইরের বিভিন্ন জিনিস, বিভিন্ন ঘটনা প্রভাবিত করে ফুটবলারদের। নেতিবাচক বা ইতিবাচক, দু’দিকেই তার ফল পাওয়া যায়। কেউ ভিতরে ভিতরে নার্ভাস হয়ে পড়েন। আবার কেউ উত্তেজনায় ফুটতে থাকেন। ফলে গোল করা বা নষ্ট করার পিছনে তার প্রভাব থাকে। নিজের গবেষণায় সেই দিকগুলিই তুলে ধরেছেন গবেষক জেয়ার জর্ডেট।
তিনি উল্লেখ করেছেন বিশ্বকাপ ফাইনালের কথা। জর্ডেটের মতে, শুটআউটের সময় ম্যাচের গতিপ্রকৃতি গোলকিপারের থেকে বেশি কেউ প্রভাবিত করতে পারেন না। তিনি জানিয়েছেন, ফাইনালে আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সের মধ্যে যদি আসল পার্থক্য কেউ গড়ে দিয়ে থাকেন, তিনি এমিলিয়ানো মার্তিনেস। বিশ্বকাপের সময়ে এবং পরে যিনি বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন। ফলে ফাইনালে জোড়া গোল করা মেসি নয়, ট্রফি জয়ের আসল কৃতিত্ব মার্তিনেসের বলেই মনে করছে গবেষণা।
নিজের গবেষণায় মার্তিনেসকে ‘ফুটবলের ম্যাকিয়াভেলি’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন জর্ডেট। শুটআউটের সময় বিশেষ করে মার্তিনেসের আচরণের কথা তুলে ধরেছেন তিনি। ফাইনালের বিশ্লেষণ করার আগে জর্ডেট উল্লেখ করেছেন ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে শুটআউটের কথা। সেই ম্যাচে উল্টোপাল্টা কথা বলে বিপক্ষের নজর ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মার্তিনেস।
সেই ম্যাচ হয়েছিল রুদ্ধদ্বার স্টেডিয়ামে। ফলে মাইক্রোফোনে স্পষ্ট শোনা গিয়েছিল মার্তিনেসের কথাবার্তা। যিনিই শট নিতে আসছিলেন, তাঁকে উদ্দেশ্য করে মার্তিনেস বলছিলেন, “আমি জানি তুমি নার্ভাস। জানি কোন দিকে তুমি শট নেবে। দেখো কী ভাবে আমি শট বাঁচিয়ে দিই। মনে রেখো, আমি তোমার শট বাঁচাবই।” বিশ্বকাপ ফাইনালে মার্তিনেসের আসল চেহারা দেখা যায়। শুটআউটের সময় পেনাল্টি বক্সকে নিজের এলাকা বানিয়ে ফেলেছিলেন মার্তিনেস। পণ করেছিলেন, সেখানে তিনি দুর্ভেদ্য হয়ে উঠবেন।
ফ্রান্সের ফুটবলারদের প্রথম থেকেই বিক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ফ্রান্সের প্রথম দুটি শটের সময় রেফারিকে বার বার বলছিলেন, বল ঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে কি না দেখতে। এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ফুটবলারের ফোকাস নড়ে যায়। সেই ফুটবলার রেফারিকেও দুষতে থাকেন। কিংসলে কোমানের দ্বিতীয় পেনাল্টি সে ভাবেই বাঁচিয়ে দেন মার্তিনেস। তার পরে চিৎকার করে উচ্ছ্বাস করতে থাকেন।
সাধারণত গোলকিপাররা ও ভাবে উচ্ছ্বাস করেন না। তবে জর্ডেট গবেষণা করে দেখেছেন, উচ্ছ্বাস মাত্রা ছাড়ালে পরবর্তী ঘটনাক্রমে তা প্রভাব ফেলে। জর্ডেট বলেছেন, “পেনাল্টিতে গোল করে যে সব ফুটবলার বেশি উচ্ছ্বাস করে, সেই দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কোনও ফুটবলার বেশি উচ্ছ্বাস করলে পরবর্তী ফুটবলারের মিস্ করার সম্ভাবনা ১০-১৫ শতাংশ। এবং যে ফুটবলার বাড়তি উচ্ছ্বাস করেছেন, তাঁর সতীর্থদের গোল করার সম্ভাবনা ৭-৮ শতাংশ বেড়ে যায়।”
ফাইনালে ফ্রান্সের অরেলিয়ে চুয়ামেনি কিক্ নিতে আসার সময় মার্তিনেসের হাতে বল ছিল। তিনি আর্জেন্টিনীয়দের উদ্দেশে ইঙ্গিত করে আরও বেশি চিৎকার করতে বলছিলেন। রেফারি বল চাইলে মার্তিনেস সেটি ৪৫ ডিগ্রি কোণে ছুড়ে দেন। চুয়ামেনিকে গিয়ে সেই বল ধরতে হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যদি কোনও ফুটবলারকে শট নেওয়ার আগে অপেক্ষা করতে হয়, তাঁর গোল করার সম্ভাবনা ২০-৩০ শতাংশ কমে যায়। ফলে চুয়ামেনিও শট মিস্ করেন।
মার্তিনেস জানতেন যে, তিনি যে পদ্ধতি নিয়েছেন, বিপক্ষ গোলকিপার হুগো লরিসও সেটাই করতে পারেন। তাই চুয়ামেনির শটের পরেই বল নিয়ে নিজেই সতীর্থ লিয়ান্দ্রো পারেদেসের হাতে তুলে দেন। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার চার ফুটবলারই গোল করেছিলেন। মার্তিনেস সম্পর্কে জর্ডেট লিখেছেন, “খুব হিসেবি, সৃষ্টিশীল একটা চরিত্র।”
গত ২০ বছর ধরে প্রতিটি বিশ্বকাপের সব পেনাল্টি শুটআউট দেখেছেন জর্ডেট। দুশোটিরও বেশি শট বিশ্লেষণ করেছেন। ২০০০ কিক দেখেছেন। শুটআউটের সময় ফুটবলারদের মানসিকতা, আচার-আচরণ এবং চলাফেরা খুঁটিয়ে দেখেছেন তিনি। অতীতে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন গোলকিপার পিটার শিল্টন বলেছিলেন, “পেনাল্টি হল ভাগ্যের ব্যাপার।” জর্ডেট তা মানতে রাজি নন। তাঁর মতে, পেনাল্টির পিছনে জড়িয়ে বিজ্ঞান। তাই জন্যেই সাফল্য এবং ব্যর্থতার বিভেদ ক্রমশ কমছে। ২০২১-এ অলিম্পিক্সে পুরুষ এবং মহিলা বিভাগে জয়ী দুই দলই ফাইনালে সাফল্য পেয়েছিল শুটআউটে। বিশ্বকাপের আগে কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা এবং ইউরো কাপে ইটালি জিতেছে শুটআউটে।
পরের বছরে আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্সে সেনেগাল, ইংলিশ কাপে চেলসির বিরুদ্ধে দু’বার লিভারপুল জিতেছে শুটআউটে। একই ভাবে স্প্যানিশ এবং জার্মান কাপ জিতেছে রিয়াল বেটিস এবং আরবি লাইপজিগ। ইউরোপা লিগে ফ্রাঙ্কফুর্ট হারিয়েছে রেঞ্জার্সকে। কাতার বিশ্বকাপে রেকর্ড সংখ্যক পাঁচটি শুটআউট দেখা গিয়েছে।
দল বা দেশের পরিসংখ্যান বার করতে গিয়ে জর্ডেট দেখিয়েছেন, ইংল্যান্ড ১০ বারের মধ্যে ৭ বার হেরেছে। নেদারল্যান্ডস আটটির মধ্যে সাতটি হেরেছে। স্পেন শেষ চার বারই হেরেছে। অন্য দিকে, আর্জেন্টিনা শেষ তিন বার, ক্রোয়েশিয়া শেষ চার বার এবং জার্মানি শেষ ছ’টি শুটআউটে জিতেছে। কোনও দল যদি পরিসংখ্যানে পিছিয়ে থাকার কথা মাথায় রেখে শুটআউটে নামে, তাদের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। একই ভাবে, অতীতে সাফল্য থাকলে ভবিষ্যতেও সাফল্য মিলবে।
জর্ডেটের মতে, যত দিন যাবে, ততই পেনাল্টির গুরুত্ব বাড়বে। পেনাল্টির ক্ষেত্রে সাহায্য চেয়ে ইতিমধ্যেই জর্ডেটের কাছে আবেদন করেছে ২০টি ক্লাব। তাদের সাধ্যমতো সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy