বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসাবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এখন মেসির নাম বলছেন। ছবি: টুইটার।
বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের বয়স তখন ৭০ মিনিট। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে নিজের দ্বিতীয় এবং দলের তৃতীয় গোল করে ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে ফেললেন ইউলিয়ান আলভারেস। অন্য কিছু করার সুযোগই ছিল না আলভারেসের। তাঁর দায়িত্ব ছিল শুধু বলে পা ছোঁয়ানো। ইচ্ছা না থাকলেও বল এসে তাঁর পায়ে লাগত। এবং গোল হতই।
প্রায় গোল লাইন থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোনাকুনি ব্যাক পাসটা বাড়িয়েই লিয়োনেল মেসি বুঝে গিয়েছিলেন ফলাফল। দৌড় থামাননি। গোলপোস্টের পিছনে আর্জেন্টিনার সমর্থক ভর্তি গ্যালারির দিকে ছুটে গিয়ে থামলেন। উত্তাল গ্যালারি চাইছিল তাঁকে আলিঙ্গন করতে। মেসিও হয়তো তাই চাইছিলেন। তবু থামলেন। আর একটা ম্যাচের শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে। সেই ম্যাচ, যা তাঁকে দিতে পারে অধরা বিশ্বকাপ।
বিমান রানওয়ের শেষে একটু থমকে দাঁড়ায়। তার পর ডানা মেলে উড়ে যায় আকাশে। মেসির আর্জেন্টিনাও ৩৬ ম্যাচের রানওয়ে জুড়ে ছুটে আসার পর একটু থমকে ছিল। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তাঁরা। তার পরেই বিমানের মতো ডানায় ভর করে শুধুই উপরে উঠে চলেছে আর্জেন্টিনা। সেই ডানার নাম মেসি।
ফুটবল বিশ্ব তাঁকে আদর করে ডাকে এলএম১০ বলে। আদর তাঁর বাঁ পায়ের জন্য। কথা তো বলে ডান পা-ও। ডান পায়ের পদক্ষেপ বোকা বানায় প্রতিপক্ষকে। বাঁ পা শাসন করে বল। এই যুগলবন্দি সবার থাকে না। বড় ফুটবলার হলেই মেসি হওয়া যায় না। দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বকাপের মাঝারি মানের একটা দলকে ফাইনালে তুলে দেওয়া যায় না। এক বার নয়, একাধিক বার। মঙ্গলবার রাতে আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনাল শেষে টেলিভিশনের ক্যামেরায় ধরা পড়ল একটি টিফো। তাতে ছিল দিয়েগো মারাদোনার ছবি। মারাদোনাও আর্জেন্টিনাকে দু’বার বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছিলেন। এক বার চ্যাম্পিয়ন করেছেন। নিজের খেলা দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন ফুটবলবিশ্বকে। যোগ্য উত্তরসূরিকেই তিনি তুলে দিয়েছেন প্রিয় আর্জেন্টিনার পতাকা। মেসি চাইলেই পারতেন স্পেনের হয়ে খেলতে। স্পেনই তো ছোট্ট লিয়োনেলকে উপহার দিয়েছে মেসি রূপে।
মেসির ফুটবল প্রতিভাকে শুধু বসন্তের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে স্পেনের বার্সেলোনা। সেই রঙেই সেজেছে মারাদোনা পরবর্তী আর্জেন্টিনার ফুটবল। মারাদোনার পাশে এক জন গ্র্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা ছিলেন। যিনি গোল চিনতেন নিজের হাতের তালুর মতো। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সব থেকে বেশি ১০টি গোল করার রেকর্ড ছিল তাঁর। মঙ্গলবার সেই বাতিস্তুতাকে ছাপিয়ে বিশ্বকাপে মেসির গোল সংখ্যা হল ১১। মারাদোনার আট গোলের নজির কাতারেই টপকেছেন তিনি। বিশ্বকাপের ২১টি ম্যাচ খেলে মারাদোনা সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়েছিলেন আটটি। অর্থাৎ, ১৬টি গোলে তাঁর অবদান ছিল। মেসি ২৫টি ম্যাচে ১১টি গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন ন’টি। ২০টি গোলে রয়েছে তাঁর অবদান। মারাদোনার হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি উঠেছে। মেসি এখনও পারেননি। রবিবার সেই খালি হাত ভরার সুযোগ। যদি না ভরে? তা হলে কি মারাদোনাই শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে থেকে যাবেন? এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
একটা সময় পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ছিল মারাদোনার সঙ্গে পেলের। শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দুই কিংবদন্তির আকচাআকচি কম দেখেনি ফুটবল বিশ্ব। দ্বিমুখী সেই লড়াই এখন ত্রিমুখী। তৃতীয় পক্ষ মেসি। ফুটবল নিয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার রেষারেষির কথা অজানা নয় ফুটবলপ্রেমীদের। বিশ্বকাপ জয়ের নিরিখে ব্রাজিল এগিয়ে ৫-২ ব্যবধানে। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের নিরিখে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে আর্জেন্টিনা।
পেলে ব্রাজিলকে তিন বার বিশ্বকাপ দিয়েছেন। তিনি পাশে পেয়েছিলেন সে সময়ের একঝাঁক সেরা ফুটবলারকে। তাতে যদিও পেলের কৃতিত্ব কমে যায় না। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে অক্ষত তাঁর একাধিক রেকর্ড। মারাদোনা তাঁর শিল্প দিয়ে মুগ্ধ করেছেন ফুটবল বিশ্বকে। যত বার নিজস্ব ভঙ্গিতে নিজের বুকে ঘুষি মেরেছেন, তত বারই বোধহয় কেঁপে উঠেছে পেলের বুক। শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের আসন হারানোর আশঙ্কা তৈরি না হলে নিজের মুখে কেন নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করতে হয়েছে তাঁকে! দম্ভ? অহঙ্কার? এ সব তাঁকে অবশ্যই মানায়। তাঁর দাবি একটুও বেমানান নয়। কিন্তু কথায় বলে, বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট! এ সবের কিছুই করেন না মেসি।
পেলে, মারাদোনা এক প্রজন্মের ফুটবলার নন। তাঁরা নিঃসন্দেহে নিজেদের সময়ের সেরা। মেসিও তাই। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, নেমাররা যতই তাঁর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলুন আর্জেন্টিনার অধিনায়কের মতো হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা হতে পারেননি। মেসি মাঠে থাকা মানেই প্রতিপক্ষের চার-পাঁচ জন ফুটবলার তাঁকে অনুসরণ করবেনই। অনুসরণ করেন তাঁর সতীর্থরাও। অনুকরণ করার সাধ্য কার!
ট্রফি, পুরস্কারের সংখ্যা মাপকাঠি হলেও পিছিয়ে নেই মেসি। বিশ্বকাপ নেই তো নেই। সে তো নেমার, রোনাল্ডোদেরও নেই। মেসির প্রজন্মের বা আগের প্রজন্মের যাঁদের বিশ্বকাপ আছে, তাঁদের প্রায় সকলেই ক্রীড়ানৈপুণ্যে তাঁর কাছাকাছি নন। ৩৫ বছরের মেসিও কাতার বিশ্বকাপে প্রতিপক্ষের তিন-চার জন ফুটবলারকে একাই সামলে নিচ্ছেন। তাঁর শরীরে কি চুম্বক আছে! না হলে কেন তাঁর পায়ে বল এলেই লোহার মতো ছুটে আসেন প্রতিপক্ষের চার-পাঁচ জন। লোহার বর্ম দিয়ে ঘিরে ফেলেও আটকানো যাচ্ছে না। গোল করছেন। নিশ্চিত গোলের ঠিকানা লেখা পাস দিচ্ছেন সতীর্থদের। বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত ভাবে নয়। প্রতি ম্যাচে। ধারাবাহিক ভাবে।
মেসিকে নিজের বুকে ঘুষি মারতে হয় না। নিজের মুখে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে হয় না। বহু ম্যাচের প্রতিপক্ষ রোনাল্ডো বা বহু ম্যাচের সতীর্থ নেমারকে বশ্যতা স্বীকার করান পায়ের জাদুতে। রবিবার মেসি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতাতে না পারলেও কি তাঁকে রাখা যাবে শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়ে? প্রশ্ন আছে। উত্তরও আছে। মঙ্গলবারের পর মেসির ফুটবল জীবনে শেষ হয়ে গেলেও তাঁর কৃতিত্ব কমবে না একটুও। বিশ্বকাপ জিতলে মুকুটে একটা নতুন পালক যোগ হবে মাত্র। তাতেও তাঁর কৃতিত্ব বাড়বে না একটুও।
এমনই বলছেন বাংলার প্রাক্তন ফুটবলার সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তিনি পেলের থেকে এগিয়ে রাখছেন মারাদোনা এবং মেসিকে। সত্যজিতের বক্তব্য, ‘‘মেসি বিশ্বকাপ জিতবে কি না জানি না। না জিতলেও কিছু যায়-আসে না। শুধু ট্রফি দিয়ে এক জন ফুটবলারকে বিচার করা ঠিক নয়। ক্রীড়ানৈপুণ্যে মারাদোনা এবং মেসি সমান। পেলের থেকে কিছুটা এগিয়ে। এই বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত মারাদোনা কিছুটা এগিয়ে ছিলেন তাঁর আগ্রাসনের জন্য। কাতারে মেসি সেই খামতিও ঢেকে দিয়েছে। দক্ষতার মাপকাঠিতে বিচার করলে আমার কাছে মারাদোনা এবং মেসিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার।’’
পেলে, মারাদোনা, মেসির মধ্যে কে সর্বকালের সেরা— এই বিতর্ক শুরু হয়েছে মেসি বিশ্বকাপ জেতার আগেই। তিনি বিশ্বকাপ না জিতলেও বিতর্ক চলবে। বিশ্বকাপ বিশ্বাস কমাতে বা বাড়াতে পারবে না। যদিও ফুটবলার হিসাবে পেলেকে এগিয়ে রাখছেন ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার। দীর্ঘ দিন ধরে ফুটবলের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রাখা দেবব্রতর বক্তব্য, ‘‘পেলেকে আমি দেখেছি কম, শুনেছি বেশি। প্রয়াত অমল দত্তের কাছে পেলে সম্পর্কে জেনেছি। সম্পূর্ণ ফুটবলার বলতে যা বোঝায়, পেলে ঠিক তাই। দু’পায়ের সমান দক্ষতা, হেড দেওয়ার দক্ষতা, বুদ্ধি, গতি, সুযোগ তৈরি করা, ফিটনেস— এক জন ফুটবলারের যত রকম গুণ থাকা প্রয়োজন একমাত্র পেলেরই সব ছিল। মারাদোনা অবশ্যই বড় মাপের খেলোয়াড়। ফুটবলের শিল্পী। অসম্ভব গতি এবং বুদ্ধি ছিল। গোল করতেন, করাতেন। প্রচুর চাপ নিয়ে খেলতে পারতেন। দলকে একার দক্ষতায় জেতাতে পারতেন। তবে সম্পূর্ণ ফুটবলার বলতে যা বোঝায়, ঠিক তেমন নন। সন্দেহ নেই এখন মেসিই বিশ্বের সেরা। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে তৃতীয় গোলের যে বলটা বাড়িয়েছে, সেটা একমাত্র ওর পক্ষেই সম্ভব। হঠাৎ গতি তুলতে পারে। গোল করে, করায়। অসম্ভব ফিট। চাপ নিয়ে খেলতে পারে। এখন আর্জেন্টিনা ১০ জনকে নিয়ে খেলতে নামে। মেসির পায়ে বল পড়লে সংখ্যাটা বেড়ে ১৩-১৪ জন হয়ে যায়। তবু সম্পূর্ণ ফুটবলার হিসাবে পেলেই এগিয়ে থাকবেন।’’
এক বার হতাশায় মারাদোনা মেসি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘আমি দু’রকম মেসিকে চিনি। যখন মেসি বার্সেলোনার জার্সি গায়ে খেলে তখন ওকে মেসির মতোই মনে হয়। আর্জেন্টিনার হয়ে খেলার সময় মেসিকে অন্য রকম লাগে। ও বড় মাপের ফুটবলার। কিন্তু ভাল অধিনায়ক নয়।’’ তবু কোচ মারাদোনা আর্জেন্টিনাকে তৃতীয় বিশ্বকাপ জেতানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন মেসিকে ঘিরেই। কাতারে মেসিকে দেখলে হয়তো নিজের এই বক্তব্য ফিরিয়ে নিতেন মারাদোনা। গোল করছেন। করাচ্ছেন। সতীর্থদের কোলে উঠে পড়ছেন। কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারের নায়ক গোলরক্ষক মার্টিনেজ়কে একা দেখে ছুটে যাচ্ছেন। দক্ষ ব্যান্ডমাস্টারের মতো পরিচালনা করছেন দলকে। সুর তুলছেন। তাল কেটে গেলে জুড়ে দিচ্ছেন।
মেসি আগেই বলেছিলেন, কাতারেই শেষ বিশ্বকাপ খেলবেন। সেমিফাইনালের পরেও একই ইঙ্গিত দিয়েছেন। অধরা বিশ্বকাপের জন্য খেলা চালিয়ে যাওয়ার বান্দা নন তিনি। সতীর্থের গোলকে নিজের বলে দাবি করার কথা ভাবেন না। কোচের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ান না। আবার মাঠে কড়া রেফারিকে পাল্টা সমঝে দিতে দু’বার ভাবেন না। দলের স্বার্থে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান। সত্যিই তো, রেফারির খেলা পরিচালনা দেখতে কে যায় মাঠে!
২০১৪ সালে ব্রাজিলে আয়োজিত বিশ্বকাপের ফাইনালে হারার পর সতীর্থদের ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যর্থতার দায় মাথা পেতে নিয়েছিলেন মেসি। সে জন্যই হয়তো বাস্তেন সোয়েনস্টাইগার বলেছেন, ‘‘মেসি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের খেলোয়াড়। দেশের জন্য অসম্ভব আবেগ ওর। সবাইকে আনন্দিত করতে চায় আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে। আমার মনে হয় সেটা ও করবেই।’’ জার্মানির প্রাক্তন ফুটবলার হোলগার ব্যাডস্টুবার বলেছেন, ‘‘মেসিই সর্বকালের সেরা। শুধু আর্জেন্টিনার সেরা ফুটবলার নয়। মেসি এমন এক জন ফুটবলার যে একাই ম্যাচের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বক্সের মধ্যে এত বিপজ্জনক কেউ নেই। গোল করে। গোলের সুযোগ তৈরি করে। গোলের ঠিকানা লেখা পাস বাড়ায়। দেশকে বিশ্বকাপ দেওয়ার জন্য নিজের সেরাটা দিচ্ছে। এমন এক জন ফুটবলার, যার পিছনে রয়েছে দলের সকলে। আর্জেন্টিনার সব মানুষ।’’
#Messi is the man for the crucial moments. The passion, this joy - he really wants it. All of Argentina wishes him the #WorldCup title and I'm sure many others do it as well.
— Bastian Schweinsteiger (@BSchweinsteiger) December 9, 2022
মেসি এগোচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে এগোচ্ছে পৌনে পাঁচ কোটি মানুষের আর্জেন্টিনা। এগোচ্ছে দুনিয়া জোড়া ভক্তকুল। যাঁরা পিছনে ছিলেন, তাঁরা আরও পিছিয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিলেন, তাঁরাও পিছোতে শুরু করেছেন। মেসি নিজেই বলেছেন, তাঁদের এগিয়ে দিচ্ছেন মারাদোনা। হাসপাতালের টেলিভিশনে অপ্রতিরোধ্য মেসিকে দেখছেন ৮২ বছরের পেলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy