আত্মঘাতী গোলে হতাশ ইস্টবেঙ্গল। আর সেই গোলেই টানা ছ’বার ডার্বি জয় মোহনবাগানের। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ
ডার্বি ২০২২
এটিকে মোহনবাগান ১ ইমামি ইস্টবেঙ্গল ০
শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা দরকার। বহু দিন পরে আবার কলকাতায় ফিরল ডার্বি। ভরা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের গ্যালারিতে সেই চেনা উন্মাদনা, পরিচিত আবেগ দেখা গেল দুই শিবিরের সমর্থকদের মধ্যে। দুই দলের পতাকায় ঝলমলে গোটা পরিবেশ। কিন্তু মন ভরল না। ইস্টবেঙ্গলের আত্মঘাতী গোলে(যা ম্যাচের একমাত্র গোলও) ফয়সালা হওয়া ম্যাচ শেষে কেমন জানি মনে হল, এ দিন গ্যালারি যত রঙিন ছিল, খেলা সেই তুলনায় অনেকটাই বিবর্ণ। নায়কহীন ম্যাচে সেই আগ্রাসী ফুটবল সে ভাবে চোখে পড়ল কই!
অনেক দিন পরে এমন একটা বড় ম্যাচ দেখলাম, যেখানে কোনও নায়ক খুঁজে পাইনি। বড় ম্যাচে খেলার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই মঞ্চ থেকেই অতীতে উঠে এসেছে প্রচুর নতুন মুখ, যাদের শৈল্পিক ফুটবল মন ভরিয়ে দিয়েছে সকলের। যাকে নিয়ে ম্যাচের পরেও চর্চা দীর্ঘ সময় অব্যাহত থেকেছে। ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। কোথায় সেই নতুন তারা?
যে লড়াই রবিবার দেখলাম, সেখানে একটা দল নিজেদের তৈরি করার প্রক্রিয়া সবে শুরু করেছে। নতুন ফুটবলার, নতুন কোচ— এমন একটি দলকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলার কাজ কখনও সহজ নয়। ইস্টবেঙ্গলের কোচ স্টিভন কনস্ট্যান্টাইনের কৌশলে সেই ভাবনা বার বার প্রতিফলিত হয়েছে। পুরো সময় সমান তালে দৌড়ে লড়াইয়ে টিকে থাকতে হবে। প্রতিপক্ষকে নিজেদের কাঁধে চড়তে দেওয়া যাবে না। অন্তত এই দর্শনে স্টিভন এ দিন সফল।
মোহনবাগানের কাছে এই ম্যাচে জয় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল ডুরান্ড কাপের পরবর্তী পর্বের ছাড়পত্র নিশ্চিত করার জন্য। সেখানে এই জয় সমর্থকদের নিঃসন্দেহে আনন্দ দেবে। তার উপরে এই নিয়ে টানা ছ’বার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারানোর ‘কীর্তি’। কিন্তু যে ফুটবল জুয়ান ফেরান্দোর দলের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেছিলাম, সেটা কিন্তু হয়নি। আইএসএলে যে ফুটবল মোহনবাগান উপহার দিয়েছে,
তাতে আমার ধারণা ছিল, কমপক্ষে তিন গোলে জিতে মাঠ ছাড়বে। বিশেষত যেখানে এই দলটা অনেক বেশি তৈরি। আরও বেশি গোল হবে মনে করেছিলাম।
চুক্তি নিয়ে টালবাহানা, অনেক দেরিতে ফুটবলার বাছাইয়ে নামা—সব মিলিয়ে ইস্টবেঙ্গল যে দল তৈরি করেছে, তাতে ওদের কাছ থেকে এখনই বিরাট বড় কিছু আশা করা হয়তো ঠিক হবে না। আমি নিজে স্টিভনের কোচিং খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করেছি। পরিচ্ছন্ন একটা ভাবনা নিয়ে চলতে পছন্দ করে। মাত্র দু’সপ্তাহের প্রস্তুতিতে স্টিভন যে ব্যাপারটা অনুধাবন করেছে, তার নির্যাস হল, এখনই মনমাতানো ফুটবল উপহার দেওয়া ওর দলের পক্ষে সম্ভব নয়। আপাতত জোর দিয়েছে ফিজ়িক্যাল ফিটনেসে। ফলে রবিবার পুরো ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল দলটা ছুটে গিয়েছে। তাই হারের ব্যবধানটা বাড়েনি। বরং চোখে পড়েছে শৌভিক চক্রবর্তী এবং বিদেশি ইভান গঞ্জালেসের লড়াই। আইএসএলের আগে নিশ্চয় স্টিভন দলকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে। তবে ওর দরকার ভাল স্ট্রাইকার। মাঝমাঠে ভাল কান্ডারিও।
বিরতির আগে যে গোলটা হল, সেটা নিয়ে আমি সুমিত পাসিকে দোষ দিতে পারছি না। লিস্টন যে কর্নারটা নিয়েছিল, তা এ দিনের ম্যাচে সবচেয়ে নির্বিষ এবং লক্ষ্যহীন ছিল। সেটা ইস্টবেঙ্গলের চার ডিফেন্ডারের মধ্যে পড়ে হঠাৎ করে পিছলে যেতেই গোলের দিকে মুখ করে থাকা সুমিতের পক্ষে তা বিপন্মুক্ত করার উপায় ছিল না। ও তো বলের গতিপথও অনুমান করতে পারেনি। ওর গায়ে লেগে গোলে ঢুকে যায় বল।
এ দিনের ডার্বি দেখে যেটা মনে হয়েছে তা হল, রয় কৃষ্ণ এবং ডেভিড উইলিয়ামস চলে যাওয়ার পরে ফেরান্দো নিজেও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। ও বুঝতেই পারছে না, কাকে গোল করার দায়িত্ব দেওয়া দরকার। পুরো ম্যাচটা লক্ষ্য করলে দেখবেন, মাঝমাঠে জনি কাউকোর নেতৃত্বে সবুজ-মেরুন একচ্ছত্র শাসন করেছে। কিন্তু প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের সামনে এসে (যেটাকে আমরা সাধারণত পেনিট্রেটিং জ়োন বলে থাকি) সমস্ত আক্রমণ নষ্টহয়ে গিয়েছে।
লিস্টন বিপজ্জনক ফুটবলার। অসম্ভব গতি রয়েছে। ড্রিবল অসাধারণ। যে কোনও রক্ষণের কাছে ও এই মুহূর্তে আতঙ্ক। কিন্তু ওকে সহায়তা করার মতো ফুটবলার কোথায়? লিস্টন বল ধরবে, ও-ই আবার ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে গোল করবে, এতটা আশা করা বাস্তবোচিত নয়। পুরো ম্যাচে মোহনবাগানের কোনও ‘থার্ড ম্যান মুভ’ চোখে পড়েনি। যেটা হতে পারত কিয়ান নাসিরিকে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই নামিয়ে দিলে। ও পিছন থেকে বল খুব ভাল ‘ফলো’ করে গোল করতে সিদ্ধহস্ত। ডার্বিতে হ্যাটট্রিক করে সেটা তো ও প্রমাণও করে দিয়েছে। তা হলে ম্যাচ শেষ হওয়ার মাত্র আট মিনিট আগে ওকে কেন নামাল ফেরান্দো?
এটা তো মানতেই হবে, লাল-হলুদ রক্ষণে বোঝাপড়ার বিস্তর অভাব রয়েছে। সেখানে কিয়ানের মতো তরতাজা ছেলেকে নামিয়ে দেওয়ার অর্থই তো গতিতে প্রতিপক্ষকে বেদম করে গোল পাওয়ার রাস্তা সুগম করে তোলা। জুয়ান কেন এই বিষয়টা বুঝতে পারছে না? তবে কি ও এখনও কিয়ানের উপরে আস্থা রাখতে পারছে না? এটা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। অনেক আগে মনবীরকেও নামানো যেত। আমার ধারণা, তা হলে কিন্তু গোলের সংখ্যা বাড়ত।
বড় ম্যাচে দুই ক্লাবের জার্সিতেই খেলেছি। দুই শিবিরের হয়ে গোলও রয়েছে। মোহনবাগানের জয় তাই আমাকে আনন্দ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মন ভরেনি। ওদের থেকে আরও ইতিবাচক এবং মনকাড়া ফুটবল দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy