সতীর্থ অরুণলালকে সংবর্ধনা সৌরভের। বুধবার ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে।
অরুণলালের কথা শুনলে কিছুতেই বিশ্বাস হবে না, কীর্তি আজাদের সঙ্গে ডুয়েলটা আজও শেষ হয়েছে বলে। পঁচিশ বছর পরেও সেটা দিব্য চলছে, আর বঙ্গ ক্রিকেটের ‘লালজি’ কোনও ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নেই। উনি এখনও ইডেনের বাইশ গজে ম্যাচটা খেলছেন! সামনে দিল্লি অধিনায়ক কীর্তি। যাঁর দিকে ঝাঁঝালো শাসানি উড়ে আসছে অনবরত—‘‘শোন, ওভার নষ্ট করছিস তো? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর যেন আমাকে তোরা তাড়াতা়ড়ি ফেরাতে পারিস। নইলে আমি তোদের সাত-আট ওভার নষ্ট করাব। বলে রাখলাম!’
আচ্ছা, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বয়স ঠিক কত এখন? ইন্টারনেট বিয়াল্লিশ দেখাচ্ছে। কিন্তু মঞ্চ থেকে নেমে যে সৌরভ মিডিয়ার বুমের সামনে দাঁড়ালেন, তাঁর কত? বিয়াল্লিশ বললেন? একশোয় গোল্লা! ওটা সতেরো-আঠারো। এই সৌরভ উচ্চমাধ্যমিক দেবেন দিন কয়েকে, একটু আগে খবর পেয়েছেন দাদার বদলে রঞ্জি ফাইনালে তিনি এবং দাদা স্নেহাশিসের আশেপাশে ঘোরাঘুরির ব্যাপার আজ রাতের মতো নেই!
সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানে এখনও কথাগুলো বাজে। বাংলা বাইরে খেলতে গেলে কানে মিষ্টি-মধুর ঢুকত যেগুলো। ঠেস দেওয়া সব মন্তব্য, বাংলাকে উদ্দেশ্য করে যা উ়ড়ে আসত প্রাক্-নব্বই যুগে। সম্বরণ হয়তো তাই সে জন্য বাড়তি ধন্যবাদ দেন দিনটাকে। আবেগে, স্মৃতিতে আবিষ্ট হয়ে বলে ফেলেন, ‘‘ওই জয়টার পর সব তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’’
অধিকাংশের চুলে এখন রুপোলি রেখার ভিড়, চোখে চশমা উঠেছে। পঁচিশ বছরে কেউ একটু স্থুলাকৃতি, কারও জীবনে বার্ধক্য ঢুকছে চুপিসাড়ে, কাউকে দেখলে আবার চেনাই যায় না। অতীতের ফাস্ট বোলারকে মনে হয়, ইতিহাস অধ্যাপকের ভূমিকায় বুঝি বেশি মানাত! নব্বইয়ের শেষ মার্চের বিকেলের পর এঁদের দিন বদলেছে। জীবন পাল্টেছে। ইডেনে ফাইনাল খেলা সে দিনের আঠারো বছরের কিশোর পরের পনেরো বছরে ভারতবর্ষের দুঁদে অধিনায়কে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। সে দিনের অধিনায়ক পরে ঢুকেছেন জাতীয় নিবার্চক কমিটিতে। ’৯০ সেমিফাইনালে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ ডাবল সেঞ্চুরিকারী তুখোড় ব্যাটসম্যান এখন বাংলার কোচ। অরুণলালকে তো টিভি কমেন্ট্রিতে প্রায়ই দেখা যায়। শরদিন্দু মুখোপাধ্যায় ক্রিকেট অ্যাকাডেমি চালু করেছেন কিছু দিন হল।
শুধু পঁচিশ বছর পরেও ২৮ মার্চ ১৯৯০ প্রসঙ্গ উঠলে সব ছেড়েছু়ড়ে আজও এঁরা টিম হয়ে যান!
রঞ্জিজয়ী টিমের রজতজয়ন্তী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তো সেটা স্পষ্ট দেখা গেল। ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান সিএবি এর আগেও দিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও দেবে। কিন্তু সঞ্চালকের দক্ষ সঞ্চালনায় বুধবারেরটার মতো নস্ট্যালজিয়ার অনির্বচনীয় মুহূর্তের সব ফ্রেম শেষ কোন সিএবি অনুষ্ঠানে তৈরি হয়েছে, বলা কঠিন। অরুণলালকে ব্লেজার পরিয়ে দিচ্ছেন সৌরভ। যে অরুণের হাত থেকে ভারতীয় ক্রিকেটে বাংলার ব্যাটন তিনি নিয়েছিলেন। প্রণব রায় মঞ্চে উঠতে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, কোয়ার্টারে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করার পর বাবা কী বলেছিলেন? সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রণব বলে ফেললেন, সে দিন নাকি বাবা পঙ্কজ রায় রাগ করেছিলেন। ‘‘আসলে বাবা কোনও দিন চাইতেন না আমি আউট হই। ওই সময় কোশেন্টের কারণে আমার থাকাটা দরকার ছিল। আর আমি কেন, বাংলার কোনও ক্রিকেটারই আউট হলে বাবার সহ্য হত না।’’ অশোক মলহোত্রকে জিজ্ঞেস করা হল, হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে আপনার রঞ্জি সেমিফাইনালে ডাবল সেঞ্চুরির কথা সবাই জানে। কিন্তু ইডেনে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে কোয়ার্টারে শেষ ওভারটা খেলার সময় মনে মনে কী চলছিল? তখন তো একটা উইকেট গেলে কোশেন্টেই ছিটকে যেত বাংলা? শুনে প্রায় আতঁকে ওঠেন অশোক, ‘‘প্রচণ্ড টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম সে দিন। ওফ্।’’ শরদিন্দু আবার মঞ্চে উঠে বলে দিলেন, সেমিফাইনালের আগের রাতটা তাঁর ঘুমই হয়নি। কিন্তু মাঠে গিয়ে পরের দিন হ্যাটট্রিক এসেছিল!
আপাত-দৃষ্টিতে সুখের ছবি। বাংলার রঞ্জিজয়ী টিমের সংবধর্না অনুষ্ঠানে ব্লেজার উপহার, এক লক্ষ টাকার চেক প্রদান থেকে কেক কাটা— সবর্ত্র যা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকল। কিন্তু পুরোটা সুখস্মৃতি বোধহয় হল না। যেমন উৎপল চট্টোপাধ্যায় একটা খোঁচা দিয়ে গেলেন। ‘বিদ্রোহী’ ডেভিড বলতে বলতে আচমকাই বলে ফেললেন, তিনিই রঞ্জিজয়ী টিমের একমাত্র সদস্য যাঁকে পরের মরসুমে বাদ পড়তে হয়েছিল। বর্তমান বাংলা টিম আর একটা কাঁটা। একমাত্র সৌরাশিস লাহিড়ী বাদে অনুষ্ঠানে কাউকে দেখা যায়নি। অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্ল অসুস্থ, তাই আসেননি। কিন্তু বাকিরা? আইপিএল শিবিরে কেউ কেউ গিয়েছেন, সবাই নয়। কোনও কোনও ক্রিকেটারের অভিযোগ, সিএবি শুধু নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছে। ফোনে একবারও বলা হয়নি। যা শুনে আবার সিএবি বলল, ফোন করে তো কাউকেই বলা হয়নি। প্রাক্তনরা আসতে পারলে বর্তমানদের আসতে অসুবিধে কোথায়?
যদিও অনুষ্ঠানের সার্বিক সুর তাতে কাটেনি। বরং অদ্ভুত টিম স্পিরিটের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। যেখানে পঁচিশ বছর পরেও অধিনায়ক টিমের কাছে স্কিপার থেকে যান। যে অনুষ্ঠান-মঞ্চে নিঃসঙ্কোচে বলে দেওয়া হয়, এগারো জন ভাই মিলে সে দিন রঞ্জি ট্রফি জিতিয়েছিল বাংলাকে। যেখানে অগ্রজ সতীর্থের কাছে সৌরভের সংজ্ঞা থেকে যায় রঞ্জি ফাইনালে পাঁচটা বাউন্ডারি মারা প্রতিশ্রুতিমান এক কিশোর, যে বড় হয়ে কিছু একটা হবে! এঁরা মনেপ্রাণে চান, বতর্মান বাংলা টিমে সেই ট্রফির খিদেটা ফিরে আসুক যা তাঁদের ছিল। এঁদের সেরা ক্রিকেট-প্রতিভূ সৌরভ বেরিয়ে যাওয়ার আগে প্রাথর্না করে যান, বাংলার আর একটা রঞ্জি জিততে যেন আরও পঁচিশ বছর না লাগে।
যে মনোভাব বতর্মান কেন, ভবিষ্যৎ বাংলার কাছেও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে। যা গড়ে দিতে পারে একটা আদর্শ টিম মডেল, তৈরি করে দিতে পারে নতুন বাংলা।
সোনার বাংলা।
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy