অসুস্থ বড়ে মিয়াঁ।
তাঁর পায়ের জাদু দেখার জন্য সত্তরের দশকে ময়দান উন্মুখ হয়ে থাকত। গ্যালারি উপচে পড়ত দর্শকে। তাঁর পা থেকে বেরিয়েছে অসংখ্য সোনার পাস, এসেছে প্রচুর গোল। সেই পা-য়ে দাঁড়াতে এখন কষ্ট হয়। একটু হাঁটলেই শরীর কাঁপে। কাঁপে দুই হাতও।
পারকিনসন্স রোগে যে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন ময়দানের বড়ে মিয়াঁ।
শুধু তাই নয়, সাতষট্টি বছরের মহম্মদ হাবিব এখন অ্যালঝাইমার্স বা স্মৃতিভ্রংশ রোগেও ভুগছেন! মনে রাখতে পারেন না অনেক কথাই! পুরনো স্মৃতিগুলোও ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়, আবার কখনও কখনও ফিরেও আসে তাঁর মুখে। অসংলগ্ন কথাও বলে ফেলেন মাঝেমধ্যে।
ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড যে এখন গুরুতর অসুস্থ, সে কথা হাবিবের পরিবারের লোকেরা চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের। চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘‘হাবিব অসুস্থ। তিনি অ্যালঝাইমার্স ও পারকিনসন্স রোগে ভুগছেন। অর্জুন পুরস্কারের পেনশনও পাচ্ছেন না। ফলে সমস্যা হচ্ছে।’’ সারা জীবন মাথা উঁচু করে এবং শৃঙ্খলিত জীবন কাটিয়েছেন হাবিব। চোখ ধাঁধানো সাফল্যের পরও কখনও মাথা ঘুরে যায়নি। তাঁকে আইডল করে বড় হয়েছেন সমসাময়িক বহু ফুটবলার। দীর্ঘ ফুটবলার জীবনে অর্থের জন্য কখনও বিকিয়ে দিতে চাননি সম্মান। সে জন্যই সম্ভবত চিঠিতে সরাসরি আর্থিক সাহায্যের কথা বলেননি হাবিরের পরিবার। তবে চিঠিতে হাবিবের এই অসুস্থতার সময় ইস্টবেঙ্গলকে পাশে থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। লাল-হলুদের সহ-সচিব শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত বলছিলেন, ‘‘হাবিবের পরিবারের পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠি পেয়েছি। উনি গুরুতর অসুস্থ। হাবিবের মতো ফুটবলার যাতে নিয়মিত পেনশন পান সে জন্য চেষ্টা করছি আমরা। মন্ত্রীদের চিঠিও লিখছি। পাশাপাশি এটাও বলছি হাবিবের মতো কিংবদন্তি ফুটবলারের জন্য কিছু করতে পারলে গর্ব অনুভব করব।’’
হাবিবের অবস্থা ঠিক কেমন? তা জানতে হায়দরাবাদে ফোনে যোগাযোগ করা হলে বোঝা গেল কথা বলতে গেলেই কষ্ট হচ্ছে তাঁর। অথচ কলকাতার নাম শুনে তাঁর গলায় ছেলেমানুষের মতোই উচ্ছ্বাস। বলে ফেললেন, ‘‘কলকাতা আমার বড় প্রিয় শহর।’’ কলকাতা নামটা তাঁকে আলোড়িত করলেও নিজের ফুটবল জীবনের অনেক কথাই এখন ভুলে গিয়েছেন। আপনার জীবনে সেরা ম্যাচ কোনটা ছিল? উত্তর এল, ‘‘মনে করতে পারছি না। এখন অনেক কিছুই মনে রাখতে পারি না। অনেক ম্যাচই তো খেলেছি। ক্লাবে কাউকে ফোন করে জেনে নিন।’’ ক্লাব, দেশ মিলিয়ে জিতেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি ট্রফি। সেরা মরসুম কোনটা? উত্তর তো দিলেনই না, উল্টে বললেন, ‘‘আরে ডাক্তার দেখিয়েছি। এখন ভাল হয়ে গিয়েছি, সবাই তো তাই বলছে।’’ মাঝে মধ্যে ঠিকঠাক কথা বলছেন, আবার কখনও এলোমেলো তিনি।
কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল মোবাইল ফোনটা মাঝেমাঝে হাতের কাঁপুনিতে সরে যাচ্ছে। ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে কথা। বলছিলেন, ‘‘একটু ধরুন, ঠিকঠাক করে বসি।’’
তবে ইস্টবেঙ্গল যে এ বার টানা সাত বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, সে খবর মনে হল তাঁর অজানা নয়। তিনি আরও জানেন, ১৯৭৭-এর পর ইস্টবেঙ্গল আবার সব ম্যাচ জিতে কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তার জন্য শুভেচ্ছাও জানালেন লাল-হলুদ ব্রিগেডকে। ঠিক এর পরই হাবিবের সহজ সরল প্রশ্ন, ‘‘আচ্ছা, কলকাতার লোকজন কি আমাকে মনে রেখেছে? আমার কথা বলে? ইডেনে ফুটবল হয়? আমি কিন্তু খেলেছি।’’ ছেঁড়া-ছেঁড়া কথা। কোনওটার সঙ্গে কোনওটার মিল নেই। আকবরের সেই সতেরো সেকেন্ডের গোলটা মনে আছে? প্রশ্ন শুনে হাবিবের উত্তর, ‘‘ও এখানে থাকে না।’’
ছেলে-মেয়েরা সব বাইরে থাকেন। হায়দরাবাদে স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন হাবিব। একাকিত্ববোধটা তাই বোধহয় আরও বেশি তীব্র হয়ে আঁকড়ে ধরেছে অসুস্থ সত্তরের দশকের সেরা ফুটবলারকে। বলছিলেন, ‘‘আমার বাড়িতে স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই। ছেলেমেয়েরা সব বাইরে। একা একাই জীবন কেটে যাচ্ছে। বেঁচে আছি বলতে পারেন।’’ অবসরে যে পুরনো স্মৃতিগুলো নিয়ে সময় কাটাবেন, সেটাও পারছেন না। কারণ পুরনো কথা যে ঠিক করে মনেই পড়ে না হাবিবের। এটা বোধহয় তাঁর কাছে আরও বড় যন্ত্রণার। কলকাতার তিন প্রধান দাপিয়ে খেলেছেন হাবিব। ফরোয়ার্ডে খেলা শুরু করলেও পরের দিকে স্কিমার হিসেবে খেলেছেন। তাঁর ফুটবল জীবন নিয়ে যে প্রশ্নই করা হোক না কেন, সবেতেই তিনি উত্তর দিচ্ছিলেন, ‘‘আমার কিছু মনে নেই। মনে করতে পারছি না।’’ নতুন লিগ আইএসএলের খবর রাখেন? ‘‘রাখি তো। এই তো সবে মেয়ের কাছ থেকে ঘুরে এলাম। দেড় দু’মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। পাঁচ-ছ’দিন হল হায়দরাবাদে ফিরেছি।’’ কখনও বর্তমানে রয়েছেন, তো কখনও আবার একেবারে অন্য জগতে।
মহম্মদ ‘বড়ে মিয়াঁ’ হাবিবের জীবনে যে এখন অতীত এবং বর্তমান সবই সমান। মস্তিষ্কের অকেজো কোষগুলোই যে ডিফেন্ডার হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে তাঁর সামনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy