গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২৮ জুলাই প্যারিস লা ডিফেন্স এরিনাতে যখন বেঙ্গালুরুর ধিনিধি ডেসাঙ্ঘু নামবে তখন সময় কি পিছিয়ে যাবে? পিছিয়ে যাবে ৭২ বছর? পিছিয়ে যাবে সেই হেলসিঙ্কি অলিম্পিক্সে? ৭২ বছর আগে এই সাঁতারেই ইতিহাস গড়েছিলেন আরতি সাহা। বাঙালি আরতি মাত্র ১২ বছর বয়সে অলিম্পিক্সে অংশ নিয়েছিলেন। ধিনিধি ১৪ বছর বয়সে অলিম্পিক্সে নামছে। এ বার ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী। ৭২ বছর পরে সেই সাঁতারের হাত ধরেই আরও এক কিশোরী বিশ্বমঞ্চে। সেই সাঁতারেই নজির গড়ছে ভারত।
ধিনিধি যখন পুলে নামে তখন নিজের দ্বিগুণ বয়সি প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়তে হয় তাকে। তাতে অবশ্য কোনও সমস্যা হয় না তার। ১৪ বছরের কিশোরীর গলায় প্রত্যয়, “আমি যখন পুলে নামি তখন শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবি। আমার বিরুদ্ধে কারা আছে সেটা দেখি না। কারণ, পুলে আমরা সকলেই সমান। সবাইকেই সাঁতার কাটতে হয়।” গত বছর জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় জাতীয় রেকর্ড গড়েছে ধিনিধি। সাঁতারে আশা বাড়াচ্ছে সে।
৭২ বছর আগে সাঁতারে ভারতীয় মহিলাদের পথ দেখিয়েছিলেন আরতি। বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গিয়েছিলেন দেশকে। ৭২ বছর পরে সেই ব্যাটনই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধিনিধি। অনুপ্রাণিত হচ্ছে আরও অনেক কিশোরী। জলে নেমে পাখনা মেলার অপেক্ষায় তারা।
আরতি ও ধিনিধির সাঁতারের শুরুর গল্পটা অবশ্য দু’রকম। চাঁপাতলা ঘাটে কাকার সঙ্গে স্নান করতে যেত ছোট্ট আরতি। কাকার কাছেই সাঁতার শেখে সে। সাঁতার শিখে যাওয়ার পর আর জল থেকে উঠতে চাইত না সে। মেয়ের সাঁতারে এই উৎসাহ দেখে বাবা পাঁচুগোপাল সাহা আরতিকে হাটখোলা সাঁতার ক্লাবে ভর্তি করে দেন। সেই শুরু।
ধিনিধির সাঁতার শুরু আবার লজ্জা কাটানোর উদ্দেশ্যে। ছোটবেলায় কারও সঙ্গে খুব একটা কথা বলতে চাইত না সে। মেয়ের এই লাজুক স্বভাব কাটানোর জন্য তার বাবা ধিনিধিকে সাঁতারের ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দেন। অল্প কয়েক দিনেই জলকে ভালবাসে ফেলে সে। প্রথমটা মজার ছলে শুরু হলেও কয়েক দিনেই ধিনিধি ঠিক করে ফেলে, সাঁতার নিয়েই এগিয়ে যাবে সে।
সরাসরি প্যারিস অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি ধিনিধি। ইউনিভার্সালিটি কোটায় সুযোগ পেয়েছে। ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল প্রতিযোগিতায় নামবে সে। সরাসরি সুযোগ না পেলেও কোচ বিএম মধুকুমার আশা করছেন, সে ভাল ফল করবে। তিনি বলেন, “ওর সাঁতারের টেকনিক বাকিদের থেকে আলাদা। মাত্র ছ’মাসেই ও অনেক উন্নতি করেছে। জাতীয় স্তরে জিতেছে। ওকে নিয়ে আমরা আশাবাদী।”
মধুকুমারের পাশাপাশি বেঙ্গালুরুর ডলফিন অ্যাকুয়াটিক্স অ্যাকাডেমিতে ধিনিধিকে শেখান নিহার আমিন। তিনি বলেন, “ধিনিধি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ও এশিয়াম গেমসে সাঁতার কেটেছে। তাই অলিম্পিক্সে নামার চাপ আলাদা করে ওর থাকবে না। অলিম্পিক্স নিয়ে সংবাদমাধ্যম একটু বাড়াবাড়ি করে। প্রতিযোগীরা জানে, সব প্রতিযোগিতাই কঠিন। জিততে গেলে সব জায়গায় নিজেদের সেরাটা দিতে হয়। অলিম্পিক্সে ধিনিধি সেটাই করবে।”
বেঙ্গালুরুর কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ধিনিধি অপেক্ষা করছে সেই দিনটির, যে দিন সে প্রথম বার পুলে নামবে। সোনা ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবছে না সে। ধিনিধি বলে, “আমি খুব উত্তেজিত। শুধু সেই দিনটার অপেক্ষা করছি। ভাল সাঁতার কাটতে হবে। দেশের হয়ে খেলার থেকে বড় কিছু হয় না। সোনা জিততেই হবে।”
অলিম্পিক্সে সাত বারের সোনাজয়ী সাঁতারু আমেরিকার কেটি লেডেকির ভক্ত ধিনিধি। নিজের আদর্শের সঙ্গে দেখা করতে চায় সে। ধিনিধি বলে, “সাঁতার শুরু করার পর থেকে কেটিই আমার আদর্শ। ওর জন্য অনেক উপহার তৈরি করেছি। আশা করছি প্যারিসে ওর সঙ্গে দেখা হবে। আমার স্বপ্ন সত্যি হবে।”
এত অল্প বয়সে অলিম্পিক্সের মতো খেলায় ধিনিধির অংশ নেওয়া মনে করিয়ে দিচ্ছে আরতিকে। ছোটবেলায় সাঁতার শুরু করার পরে মাত্র ১১ বছর বয়সে রাজ্য স্তরে ২২টি প্রতিযোগিতায় জিতেছিলেন তিনি। ধিনিধি ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে লড়লেও আরতি ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক ও ৩০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক করতেন। হেলসিঙ্কি অলিম্পিক্সে তিনি ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে নেমেছিলেন। যদিও পদক জিততে পারেননি।
হেলসিঙ্কি অলিম্পিক্সের পরে স্বল্প দৈর্ঘ্যের প্রতিযোগিতার বদলে লম্বা দৈর্ঘ্যের প্রতিযোগিতার দিকে মন দেন আরতি। গঙ্গায় সাঁতার কাটা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে প্রথম ভারতীয় পুরুষ হিসাবে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেছিলেন বাঙালি ব্রজেন দাস। সেই কীর্তি দেখে আরতিও ঠিক করে নেন যে, তিনি ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করবেন। অনুশীলন শুরু করেন। দিনে ৬-৭ ঘণ্টা সাঁতার কাটতেন। ধিনিধিও প্রতি দিন ৬-৭ ঘণ্টাই অনুশীলন করেন। ১৯৫৯ সালের ১৩ এপ্রিল দেশবন্ধু পার্কের পুকুরে টানা আট ঘণ্টা সাঁতার কেটেছিলেন আরতি। প্রথম বার ১৯৫৯ সালের ২৭ অগস্ট ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করতে নামেন আরতি। ২৩টি দেশের ৫৮ জন প্রতিযোগী ছিলেন। ৪০ মাইল সাঁতার কেটে ফেলেছিলেন আরতি। শেষ ৫ মাইলে সমস্যায় পড়েন তিনি। উল্টো দিক থেকে আসা স্রোতের কারণে মাত্র ২ মাইল সাঁতার কেটে উঠতে বাধ্য হন তিনি।
তবে হাল ছাড়েননি আরতি। সে বছরই সেপ্টেম্বর মাসে আবার নামেন তিনি। ফ্রান্সের কেপ গ্রিজ নেজ় থেকে সাঁতার শুরু করে ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিটে ৪২ মাইল অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে পৌঁছন তিনি। সেখানে জাতীয় পতাকা তোলেন। তিনিই প্রথম এশীয় মহিলা, যিনি ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেছেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদ, যিনি পদ্মশ্রী পেয়েছেন। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে জন্ডিস ও এনকেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর।
আরতির মৃত্যুর ৩০ বছর পার হয়ে গিয়েছে। এখনও বাঙালি তথা ভারতীয় সাঁতারুদের কথা উঠলেই তাঁর নাম সকলের আগে আসে। পরবর্তী কালে বুলা চৌধুরির মতো সাঁতারুদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বুলা ছাড়া আর কোনও সাঁতারু সে ভাবে উঠে আসেননি। এতে অবাক আরতির বোনের ছেলে সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “খুব ভাল লাগছে যে ১৪ বছর বয়সি একটা মেয়ে অলিম্পিক্সে যাচ্ছে। কিন্তু আমার ভেবে অবাক লাগছে যে মাসির পরে কারও উঠে আসতে ৭২ বছর লেগে গেল। এর মধ্যে আর কাউকে আমরা কেন পেলাম না? তা হলে নিশ্চয়ই কোথাও গলদ রয়েছে। সেটা দেখতে হবে।” কথায় কথায় উঠে এল মাসির প্রসঙ্গ। সুব্রত বললেন, “মাসির এত গল্প বলতে গেলে দিন কাবার হয়ে যাবে। মা ও মাসি একসঙ্গে সাঁতার কাটত। আমিও অনেক সময় নামতাম। বাবাও থাকত। তখন মাসির ইংলিশ চ্যানেল জেতা নিয়ে কত কথা হত। পুরনো দিনের সে সব স্মৃতি। এখনও মনে পড়লে মনটা ভরে ওঠে।”
শুধু এই রাজ্যের ক্ষেত্রেই নয়, আরতির পর সর্বভারতীয় স্তরেও মহিলা সাঁতারু কেউ উঠে আসেননি। ৭২ বছর পর ধিনিধি। আরতির প্রয়াণের ১৬ বছর পরে জন্মেছে সে। নিশ্চয়ই শুনেছে আরতির কথা। ভারতের মহিলা সাঁতারুদের অনুপ্রেরণা আরতির ব্যাটন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধিনিধি। পদক জয় সেখানে গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে ওঠে স্বপ্ন দেখা ও তা সফল করার লড়াই। বিশ্বের সেরাদের বিরুদ্ধে মাত্র ১৪ বছর বয়সে লড়ার সাহস। যে সাহস দেখিয়েছিলেন আরতি। সেই সাহসই দেখাচ্ছে ধিনিধি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy