Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Wriddhiman Saha

Wriddhiman Saha: কোলে মার্কেট অপেক্ষায় থাকবে, কবে তাদের প্রিয় লাজুক ছেলেটা আবার সেরার ট্রফি নিয়ে ঢুকবে

কখন রোহিত শর্মা পা হড়কে চোট পাবেন আর কোনও রকম আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই টেস্ট অভিষেক ঘটাতে নেমে পড়তে হবে। নাগপুরে সেই টেস্টে এক দিন আগেই তাঁকে বলে দেওয়া হয়, খেলছেন না।

ফাইল চিত্র।

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৭:৫৫
Share: Save:

পছন্দের ঘড়ির ব্র্যান্ড?

ধুর, ধুর, ঋদ্ধিমান সাহার পৃথিবীতে ও সব দামি ঘড়ি-টড়ির অস্তিত্বই নেই।

প্রিয় শার্ট-ব্র্যান্ড?

প্রশ্ন করে লাভ নেই। ঋদ্ধিমান সাহার দুনিয়ায় ও সব মূল্যহীন।

আচ্ছা, কলকাতা শহরে ঋদ্ধিমান সাহার বিলাসবহুল বাড়িটা নিশ্চয়ই খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না! গাড়ি বারান্দায় থাকবে তো মার্সিডিজ়, বিএমডব্লিউ পার্ক করা। ফেসবুক-টুইটারে পোজ় দিয়ে ছবিও থাকবে! দেখে ঠিক পৌঁছে যাওয়া যাবে।

একদম ভুল। শনিবার রাতে কোনও নাইট ক্লাবে তাঁকে আবিষ্কার করার মতোই অসম্ভব গাড়ি-সহ সোশ্যাল মিডিয়ায় পাবলিক পোস্ট দেখতে পাওয়া। ঠিকানা সাউথ সিটি কমপ্লেক্স। কয়েক বছর আগেও আর পাঁচ জনের মতো ছিমছাম ফ্ল্যাটে থাকতেন। এখন সংস্কার করে ‘কাস্টমাইজ়ড’ করেছেন।

ঋদ্ধিমান সাহার পৃথিবী আসলে অপেক্ষার পৃথিবী। মার্সিডিজ় বা বিএমডব্লিউ চড়ে হাইস্পিডে একের পর এক মাইলফলক পেরিয়ে যাওয়া নয়, তাঁর যাত্রা মানে সিগন্যালে ঠোকর খেতে খেতে এগোনো। কখন সিগন্যাল সবুজ হবে আর তাঁর গাড়িও চালু হবে। কবে অস্ট্রেলিয়ায় ড্রেসিংরুমে এসে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি টেস্ট অবসর ঘোষণা করবেন আর তিনিও ওয়েটিং লিস্ট থেকে ‘আরএসি’ টিকিট হাতে পাবেন।

কখন রোহিত শর্মা পা হড়কে চোট পাবেন আর কোনও রকম আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই টেস্ট অভিষেক ঘটাতে নেমে পড়তে হবে। নাগপুরে সেই টেস্টে এক দিন আগেই তাঁকে বলে দেওয়া হয়, খেলছেন না। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি থাকতে কে আর তাঁকে বলবে, তুমি খেলছ! রোহিত চোট পাওয়ায় টসের ঠিক কয়েক মিনিট আগে তাঁর নাম টিমলিস্টে ঢোকাতে হয়, ঋদ্ধি খেলেন ব্যাটসম্যান হিসেবে, কিপিং দস্তানা সেই ধোনির হাতে এবং ব্যাট হাতে ক্রিজ়ে গিয়েই দেখেন সামনে ডেল স্টেন।

সে দিনই জীবনের অমূল্য শিক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন ঋদ্ধি। সুযোগ কবে আসবে, তার জন্য কিছু ফেলে রেখো না। নিজেকে তৈরি রাখো অগ্নিপরীক্ষার জন্য। নাগপুর-উত্তর যখনই ভারতীয় দলে জায়গা পেয়েছেন, সব সময় নিজেকে বলেছেন, এই টেস্টে তুমি খেলছ। তৈরি থাকো। তা সে টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁর জন্য যে বিধানই তৈরি রাখুক। ২৭ বছরের তরতাজা তরুণ হিসেবে যখন দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে, কোনও কোচ সুযোগের ডালি নিয়ে উদয় হননি। পিঠে হাত রেখে বলেননি, তোমার দিন ঠিক আসবে। আজ যখন যৌবনের সেই হারানো সময়কে যতটা সম্ভব পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ছুটছেন তিনি, ভারতীয় কোচ দৌড় থামিয়ে দিলেন! কি না, তিনি ৩৭ হয়ে গিয়েছেন! ফিট আছেন তো কী, উড়ন্ত ক্যাচ নিচ্ছেন তো কী!

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামক কিংবদন্তির গ্রহণে ঢেকে থাকা এক ক্রিকেটজীবন। ধোনি চলে যাওয়ার পরে মাঝে বছর চারেক এক নম্বর কিপার থাকার পরে উদয় হলেন ঋষভ পন্থ। তিনি— ঋদ্ধিমান সাহা যে চিরকালীন দ্বিতীয় হওয়ার বিধান নিয়ে এসেছেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো যেমন। যতই গোল করুন সেই লিয়োনেল মেসিই এক নম্বর। অথবা যিনি ঋদ্ধির কাছে চরম বার্তা নিয়ে উপস্থিত হলেন সেই রাহুল দ্রাবিড়। যতই রান করো, সচিনই এক, তুমি সেই দ্বিতীয়ই। এ বার সেই দ্বিতীয় জায়গাটাও কেড়ে নেওয়া হল। বলে দেওয়া হল, ঋষভই এখন এক নম্বর কিপার। কেন তিনি এক নম্বর? কেন ঋদ্ধি দ্বিতীয় হিসেবেও ব্রাত্য, কেউ ব্যাখ্যা দেবে না। নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ টেস্টেও ওষুধ খেয়ে, ইঞ্জেকশন নিয়ে, সারারাত না ঘুমিয়ে রান করে দলের রক্ষাকর্তা হওয়া তিনি দু’নম্বর কিপার হিসেবেও রাতারাতি অযোগ্য হয়ে গেলেন! চিরকালের নীরব যোদ্ধা তিনি। আজ এতটাই ক্ষতবিক্ষত যে, কণ্ঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন! লাজুক ছেলেটা
মুখ খুলেছে।

ইংল্যান্ডে বাকি থাকা টেস্ট সিরিজ়ের একটি ম্যাচ খেলতে হবে ভারতীয় দলকে। কী হবে যদি ঋষভ পন্থ চোট পেয়ে অনিশ্চিত হয়ে যান? ইংল্যান্ডের পরিবেশে আনকোরা, অনভিজ্ঞ কে এস ভরতকে নামিয়ে দেওয়া হবে? ক্রিকেটীয় যুক্তিতেও তো দ্রাবিড়, চেতন শর্মাদের সিদ্ধান্ত বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে, গা জোয়ারি চলছে। এই তুমি আর ক্যাপ্টেন থাকবে না। এই তুমি আমাদের প্রথম কিপার। এই তোমার জন্য কাল থেকে দরজা বন্ধ, যাও গিয়ে রঞ্জি খেলো। আর সিএবি কর্তারা নীরব দর্শক হয়ে হাসিমুখে তালি বাজাচ্ছেন!

তাঁরা যদি বুঝতেন, ঋদ্ধিমান সাহার পৃথিবী মাটিতে পা রেখে চলা এক পথিকের! যিনি মাঠে উড়ন্ত ক্যাচ ধরে আনন্দ দেন কিন্তু তারকার রঙিন আকাশে ওড়েন না। বঙ্গ কিপারকে বুঝতে গেলে ঢুঁ মারতে হবে শিয়ালদহ স্টেশনের পাশে কোলে মার্কেটের প্লেয়ার্স মেসে। যেখানে শিলিগুড়ি থেকে এসে উঠেছিল এক লাজুক কিশোর। কলকাতায় ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। সাত-আট জনে ঠাসাঠাসি করে একটা ঘরে থাকতে হত। পরবর্তীকালে ভারতীয় দলের উইকেটকিপার হিসেবে দেশ-বিদেশের বিলাসবহুল হোটেলে হয়তো থেকেছেন তিনি। অ্যাটাচ্‌ড বাথ, মখমল বিছানো করিডর, বাফে ব্রেকফাস্ট, সুইমিং পুল স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু কিশোর ঋদ্ধির জন্য সে সব আরামের বালাই ছিল না। কোলে মার্কেটের মেসে ঘর ছিল তৃতীয় তলায়, বাথরুম নীচের তলায়। ওই তিন তলা-এক তলা করতে করতেই এই মন্ত্র গেঁথে যাওয়া শুরু যে, জীবনে কোনও কিছুই সহজে পাবে না তুমি। সবকিছুর জন্য নিরন্তর ওঠা-নামা করতে হবে।

শুরুতেই ক্রিকেট দেবতার বিধান শুনে নিলেন তিনি— জেনে রাখো, সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মাওনি তুমি। জীবনের রাস্তায় এলিভেটর অপেক্ষা করে নেই তোমার জন্য। বোতাম টিপে উপরে ওঠার লাইফলাইন তোমার জন্য নয়, শৃঙ্গ আরোহণ করতে হবে সিঁড়ি ভাঙার কৃচ্ছ্রসাধনায়। এখনও ভোলেননি সেই দিনগুলো যখন মাঝেমধ্যেই বাসে না চড়ে মেস থেকে হেঁটে ময়দানে পৌঁছতেন। তাতে কিছু পয়সা বাঁচানো যেত যে! বেশির ভাগ দিনই প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ সেরে নাও ময়দানের ক্যান্টিনে, প্র্যাক্টিসের দিনে দুপুরে ক্লাব তাঁবুতেই শুয়ে থাকো, সন্ধ্যায় মেসে ফিরে ক্লান্ত-ধ্বস্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ো— ক্রিকেট সাধনার এই কঠিন রুটিন অনুসরণ করেছেন দশ বছরের উপরে। কলকাতায় আসার আগে তাঁর ক্রিকেট অভিজ্ঞতা বলতে বাবার কাছে কিপিংয়ের প্রাথমিক পাঠ। বাবা প্রশান্ত সাহা শিলিগুড়িতে খেলোয়াড় হিসেবে নাম করেছিলেন। ফুটবলে গোলকিপার, ক্রিকেটের ময়দানে উইকেটকিপার— দ্বৈত ভূমিকায় সফল ছিলেন প্রশান্তবাবু। কলকাতা ময়দানে আসব-আসব করেও স্বপ্নপূরণ হয়নি, তাই ছেলের মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ দেখে নিজের অপূর্ণ স্বাদ মেটানোর শপথ নেন।

বাবার মতোই ফুটবলে গোলকিপার হিসেবে শুরু ঋদ্ধির। আর ক্রিকেটে টেনিস বলে আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান ছিলেন কিশোর বয়সে। বাকি দুনিয়া তাঁর আইপিএল সেঞ্চুরি দেখে বিস্মিত হতে পারে, ছোটবেলার সতীর্থদের কাছে বাইশ গজে মারমুখী ঋদ্ধি খুব পরিচিত ছবি। যখন টেনিস বল টুর্নামেন্ট মানেই ম্যাচের সেরার পুরস্কার নিয়ে ফিরতেন তিনি।

কোলে মার্কেট অপেক্ষায় থাকবে, কবে তাদের প্রিয় সেই লাজুক ছেলেটা আবার সেরার ট্রফি নিয়ে ঢুকবে। পারবেন? কঠিন লড়াই, সন্দেহ নেই। কোচ-নির্বাচকেরা যে বিরূপ। বলেই দিয়েছেন, আর দরকার নেই। বোর্ড মদত দিচ্ছে, সিএবি দর্শক। বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় লড়াই করবেন? সম্ভাবনা কম। না করুন, মেসবাড়িটার চার দেওয়ালে তো চিরকালের মতো লেখা থাকল নীরব সাধনার মহাকাব্য!

অন্য বিষয়গুলি:

Wriddhiman Saha Cricket India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy