‘৮৩’ ছবিতে কপিল দেবের ভূমিকায় রণবীর সিংহ।
১৯৮৩ সালে ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয় নিয়ে ছবি। এর পর ২০০৭, ২০১১ সালেও ভারত বিশ্বকাপ জিতেছে। কিন্তু এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, ২০২১ সালে চতুর্থ বার বিশ্বকাপ জিতে নিল ভারত।
তফাত একটাই— বাকি তিন বারই সপ্তাহ দু’য়েকের লড়াইয়ের পর শেষ দিন ভারত বিশ্বকাপ জিতেছিল। কবীর খানের হাত ধরে ‘৮৩’ ছবি চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল প্রথম দিন বল পড়তে না পড়তেই!
গোটা ছবি জুড়ে প্রচুর ক্রিকেট। বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচ তো বটেই, এ ছবিতে উঠে এসেছে প্রতিযোগিতা শুরুর আগে ভারতের দু’টি অনুশীলন ম্যাচও। তবু এই ছবি নিছক কপিল দেব এবং তাঁর বাহিনীর বিশ্বজয়ের গল্প নয়। এই ছবি ব্যাট-বলের যুদ্ধের গল্পও নয়। এই ছবি আসলে ভারতীয় ক্রিকেটের স্বাধীন হওয়ার গল্প।
কপিলদের নিয়ে বিলেতে পৌঁছনোর পর ম্যানেজার পিআর মান সিংহ লর্ডসের পাস চাইতে গিয়েছিলেন। তখন সাহেব উদ্যোক্তারা তাঁকে মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন, যাঁরা ফাইনাল খেলবেন, এই পাস শুধু তাঁদের জন্য! গোরাদের প্রশ্ন ছিল, ভারতীয় দল এই পাস নিয়ে কী করবে! কপিল যখন প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন, সেখানে তাঁর উল্টো দিকে প্রশ্নকর্তা ছিলেন মাত্র তিনজন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইংরেজ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রিথ। কপিলের মুখে ‘আমরা বিশ্বকাপ জিততে এসেছি’ শুনে তিনি বলেছিলেন, এটা সত্যি হলে তিনি তাঁর সব লেখা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন।
ভারত বিশ্বকাপ জেতার পর ফ্রিথকে আক্ষরিক অর্থেই নিজের কথা গিলতে হয়েছিল। বিশ্বকাপ চলাকালীন কপিলের সাংবাদিক সম্মেলনগুলোয় ভিড় বাড়তে শুরু করেছিল। মান সিংহের হাতে আপনা থেকেই পৌঁছে গিয়েছিল লর্ডসে ঢোকার ছাড়পত্র। যা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সাদাদের ঔপনিবেশিকতা থেকে কী ভাবে মুক্ত হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট, এই ছবি আসলে সেই গল্পই বলেছে। ১৯৩২ সালে টেস্ট খেলা শুরু করার পর ৫১ বছর ধরে শাসিত হতে-থাকা ভারতীয় ক্রিকেটও যে ভবিষ্যতে ক্রিকেটদুনিয়া শাসন করতে পারে, এই ছবি আসলে তার গল্প।
কবীরদের লড়াই চলেছিল চার বছর ধরে। অভিনেতাদের বাছতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। শুধু ১৯৮৩-র বিশ্বজয়ের নায়ককে বাছতে সমস্যা হয়নি। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টস জিতলেই অধিনায়করা ফিল্ডিং নিতে যেমন দু’ বার ভাবেননি, তেমনি কপিল দেবের চরিত্রে প্রথমেই কবীরের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠেছিল রণবীর সিংহের মুখ। তাঁকে দু’ বার ভাবতে হয়নি।
কিন্তু আরও ১৩ জনকে তো পেতে হবে! সুনীল গাওস্করের ভূমিকায় তাহির রাজ ভাসিন, মহিন্দর অমরনাথের ভূমিকায় সাকিব সালিম, মদনলালের ভূমিকায় হার্দি সান্ধু, বলবিন্দর সিংহ সান্ধুর ভূমিকায় অ্যামি ভির্ক, সৈয়দ কিরমানির ভূমিকায় সাহিল খট্টর, সন্দীপ পাটিলের ভূমিকায় তাঁরই পুত্র চিরাগ পাটিল, দিলীপ বেঙ্গসরকরের ভূমিকায় আদিনাথ কোঠারে, কীর্তি আজাদের ভূমিকায় দিনকর শর্মা, রবি শাস্ত্রীর ভূমিকায় ধৈর্য কারওয়া, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের ভূমিকায় জিভা, যশপাল শর্মার ভূমিকায় যতীন সরনা, রজার বিনির ভূমিকায় নিশান্ত দাহিয়া, সুনীল ভালসনের ভূমিকায় আর বদ্রী এবং দলের ম্যানেজার মান সিংহের ভূমিকায় পঙ্কজ ত্রিপাঠীকে বাছার কাজ সহজ ছিল না।
সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ মহিন্দরকে এই ৭১ বছর বয়সেও পর্দায় হাজির করিয়েছেন কবীর। তবে ‘রিল’-এ তিনি মহিন্দরের বাবা লালা অমরনাথের ভূমিকায়।
তবু ওই পর্যন্ত ঠিক আছে। পঙ্কজ-রাজ-যতীনরা পরিচিত মুখ। কিন্তু ভিভ রিচার্ডস বা গর্ডন গ্রিনিজ? শুধু এঁদের বেছে নিতেই লেগেছিল দেড়টি বছর! প্রায় দু’ হাজার জনের ‘অডিশন’ নেওয়া হয়েছিল। কাস্টিং ডিরেক্টরের অফিসের বাইরে আস্ত একটা ক্রিকেট পিচ তৈরি করে ফেলা হয়েছিল। সেখানে প্রথমে সবাইকে ক্রিকেটীয় দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়েছিল। পরীক্ষা নিয়েছিলেন বলবিন্দর নিজে। দেড় বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলার পরে যে ফল বেরিয়েছিল, তার চূড়ান্ত রূপ দেখা গেল শুক্রবার। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের আগুনে ফাস্ট বোলার ম্যালকম মার্শালের ভূমিকায় অভিনয়-করা তাঁরই পুত্র মালি মার্শালকেও কি সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল? কে জানে!
তাই শুধু কপিল বা রণবীর নন, প্রত্যেকে ছবিতে সমান নজর কেড়েছেন। ক্রিকেট যে সত্যিই টিম গেম। একা কপিল যেমন দেশকে বিশ্বকাপ দিতে পারতেন না, তেমনই শুধু রণবীরের হাত ধরে এই ‘বিশ্বজয়’ সম্ভব হত না। রণবীর নিজে কপিলের বাড়িতে ১০দিন থেকে খুঁটিনাটি বুঝে নিয়েছিলেন। ছ’মাস ধরে দিনে চার ঘণ্টা করে অনুশীলন করতেন। সিরিজ খেলতে নামার আগে ভারতীয় দল যেমন অনুশীলন শিবির করে, তেমনই বাকি অভিনেতাদের নিয়ে ২০১৯-এর এপ্রিলে ধর্মশালায় শিবির হয়েছিল। যার তদারকি করেছিলেন বলবিন্দর এবং গত জুলাই মাসে প্রয়াত বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য যশপাল শর্মা।
১৯৮৩ বিশ্বকাপে কপিলরা ‘আন্ডারডগ’ ছিলেন। কারও স্বপ্নের ত্রিসীমানাতেও আসেনি সে বছর ২৫ জুনের রূপকথা। সেমিফাইনালের আগেই ভারতীয় দলের ফেরার বিমানের টিকিট কাটা ছিল। ফলে হারানোর কিছু ছিল না। বিরাট কোহলীরা এ বার যে পাহাড়প্রমাণ চাপ নিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে নেমেছিলেন, তার সিকিভাগও কপিলদের উপর ছিল না। কেউ তাঁদের থেকে কিছু প্রত্যাশা করেননি। তাঁদের প্রত্যাশা ছিল শুধু নিজেদের কাছ থেকে।
কবীরের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক উল্টো ছিল। ভারতীয় ক্রিকেটের মোড় ঘুরিয়ে-দেওয়া একটা ঘটনাকে তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা কী ভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন, সে দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা দেশ। তাকিয়ে ছিলেন ’৮৩-র সেই নায়করা। ফলে পান থেকে চুন খসার উপায় ছিল না। এই সিনেমা তৈরির কথা মাথায় আসার পর থেকে অভিনেতা বাছাই, তাঁদের তৈরি করা, প্রতিটি শট নেওয়া, প্রতিটি পদক্ষেপ—এই বিশাল চাপ সামলে এগোতে হয়েছে তাঁকে।
বায়োপিক তৈরি এমনিতেই কঠিন। ‘শোলে’, ‘হাম আপকে হ্যায় কওন’, ‘জব উই মেট’-এর মতো এখানে শেষ পর্যন্ত কী-হয় কী-হয় করার জায়গা নেই। ভারত কত রান তাড়া করে জিতেছিল, কপিল কত পা দৌড়ে ভিভের সেই ক্যাচ নিয়েছিলেন, সবার সব জানা। একুশ শতকের ছোট হয়ে আসা দুনিয়ায় ’৮৩-র বিশ্বজয়ের কাহিনি সবার ঠোঁটস্থ। তার উপর এই ছবি আর পাঁচটা বায়োপিকের থেকে চরিত্রে আলাদা। ‘দঙ্গল’, ‘এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’, ‘ভাগ মিলখা ভাগ’, ‘মেরি কম’, ‘আজহার’-এর মতো এই ছবি কোনও ব্যক্তিবিশেষের জীবনীভিত্তিক ছবি নয়। এর আধার একটি বিশেষ ঘটনা। তার উপর ভিত্তি করে পৌনে তিন ঘণ্টার টানটান নির্মেদ একটি ছবি। এখানে বলতেই হবে চিত্রনাট্যকার অসীম মিশ্রর কথা। তিনি একই সঙ্গে কবীরের ‘যশপাল’, ‘অমরনাথ’, ‘বলবিন্দর’। তিনি না থাকলে এই ছবি উতরোত না।
’৮৩ নিয়ে এই আলোচনা লেখার সময়েই এসে গেল বিরাট কোহলী, অনুষ্কা শর্মার টুইট। তাঁরা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশ্বকাপ জিতলে ২৫ হাজার টাকা বোনাস পাওয়া যাবে শুনে অপুর রেলগাড়ি দেখার মতো বিস্মিত হয়েছিলেন যশপাল-শ্রীকান্তরা। বলবিন্দরের প্রশ্ন ছিল, এটা নিশ্চয়ই সবার মিলিত বোনাস? জানা নেই এ সব দেখে বর্তমান ভারত অধিনায়ক কতটা বিস্মিত হয়েছেন। বাসেই কপিলের টিম মিটিং, লর্ডসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সান্ধুকে ‘পেপটক’ দেওয়া দেখেই বা কোহলী কী ভাবলেন?
খোলা গ্যালারিতে আমজনতার মাঝে বসে থাকা তৎকালীন অধিনায়কের স্ত্রীকে প্রকাশ্যে বারবার বিদ্রুপ করছিলেন বিপক্ষ দলের সমর্থকরা। জানা নেই, এখন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ফার্স্ট লেডি’-র এই দৃশ্য দেখে কী মনে হয়েছে। ১৯৮৩-র ২৫ জুন লর্ডসের গ্যালারিতে কপিল-ঘরনি রোমির সঙ্গে ছিলেন মদনলালের স্ত্রী অনুও। ৩৮ বছর আগে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ওয়্যাগ’-দের (‘ওয়াইভস অ্যান্ড গার্লফ্রেন্ডস’, খেলোয়াড়দের স্ত্রী-বান্ধবীদের এই নামেই অভিহিত করা হয়ে থাকে এখন) যে স্পিরিট এই ছবিতে ধরা পড়েছে, তা দেখে অনুষ্কা-রীতিকারা (রোহিত শর্মার স্ত্রী) কী ভাবছেন, তা-ও জানা নেই।
তবে শেষে একটা খামতির কথা বলে নেওয়া যাক। কোনও সৃষ্টিই সম্পূর্ণ হয় না। তাই কবীরের থেকে আরও একটু প্রত্যাশা করাই যেত। এই প্রজন্ম ভারতীয় ক্রিকেটের হাজারো বিতর্ক দেখেছে এবং দেখছে। সেখানে ১৯৮৩ বিশ্বকাপে গাওস্করকে বাদ দেওয়ার পর কপিলের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক এবং ম্যানেজার মান সিংহ কী ভাবে তা সামলেছিলেন, সেই বিষয়টা আরও একটু গভীরে গিয়ে দেখা যেত।
কিন্তু কবীর তবুও জিতেছেন। কারণ, টি২০, টি১০, পাওয়ার প্লে, সুপার ওভার, রঙিন জামা, ফ্লাড লাইটের যুগে বাস করা এই প্রজন্মকে কবীর ৩৮ বছর আগের আপাত-ম্যাড়ম্যাড়ে স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়ে বিশ্বজয়ের স্বাদ দিয়েছেন। দিতে দিতে ক্রিকেট-স্বাধীনতার গল্প শুনিয়েছেন।
সেখানেই বল মাঠে পড়তে না পড়তেই ’৮৩ চ্যাম্পিয়ন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy