এ বারের রঞ্জি ট্রফিতে বিরাট কোহলি এবং রোহিত শর্মা। —ফাইল চিত্র।
খারাপ আম্পায়ারিং, খারাপ উইকেট এবং ভুল সূচি। রঞ্জি ট্রফি মানেই এই সমস্যাগুলি কোনও না কোনও দল বা ক্রিকেটারকে ভোগাবে। সঙ্গে থাকে ফাঁকা মাঠ। রঞ্জি ট্রফি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ দিন দিন নিম্নমুখী। বিনামূল্যে খেলা দেখা গেলেও শ’খানেক দর্শকও হয় না। সম্প্রচারও হয় না সব খেলা। যে কারণে ধীরে ধীরে রঞ্জি নিয়ে উত্তেজনা কমে গিয়েছে। সেই ধারায় হঠাৎ ভিন্ন ছবি। কারণ রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলির মতো তারকাকে আবার রাজ্যের জার্সিতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাতে রঞ্জির ছবিটা পাল্টাবে কি?
কোহলি খেলবেন বলে বার বার টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে রঞ্জি ম্যাচের। কবে, কখন, কোথায় দেখাবে সেই ম্যাচ তা নিয়ে আগ্রহ তুঙ্গে। বার বার সম্প্রচারকারী সংস্থা বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাচ্ছে যে, খেলা দেখা যাবে জিয়োসিনেমায়। কোহলির কল্যাণে তাই রঞ্জি ট্রফি একটু প্রচার পেল। না হলে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের নাম যে আইপিএল হয়ে গিয়েছে এত দিনে।
১৩ বছর আগে শেষ বার রঞ্জি খেলেছিলেন কোহলি। সেই ম্যাচে বীরেন্দ্র সহবাগ, গৌতম গম্ভীর, ইশান্ত শর্মা, আশিস নেহরার মতো ক্রিকেটার ছিলেন দিল্লি দলে। বিপক্ষে উত্তরপ্রদেশের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন মহম্মদ কইফ, সুরেশ রায়না, ভুবনেশ্বর কুমার, প্রবীণ কুমারের মতো ক্রিকেটার। অর্থাৎ, সেই সময় রঞ্জিকে তা-ও গুরুত্ব দিতেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তারকারা। ধীরে ধীরে যা কমতে কমতে শূন্য হয়ে গিয়েছে। কোচ গৌতম গম্ভীর না বললে রোহিতেরা যে এ বারেও রঞ্জি খেলতেন না, তা বলাই যায়।
সূচিতে সমস্যা
প্রশ্ন উঠছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে নিয়েও। যে বোর্ড ক্রিকেটারদের রঞ্জি খেলার জন্য এত জোর দেয়, তারাই এমন সূচি বানায় যে সব ক্রিকেটারের এই প্রতিযোগিতায় খেলাই কঠিন হয়ে যায়। প্রতি বছর সূচি নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। গত বার বাংলার বেশ কিছু ম্যাচ আবহাওয়ার কারণে খেলা সম্ভব হয়নি। শীতের সময় উত্তর ভারতে খেলা রেখেছিল ভারতীয় বোর্ড। কুয়াশার কারণে খেলা শুরু করা যাচ্ছিল না সঠিক সময়ে। সেই সময় বোর্ডকে বাংলার কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্ল-সহ অনেক দলই অনুরোধ করেছিল সূচি বানানোর সময় যেন আবহাওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়। এই বছর সূচিতে বেশ কিছু বদল দেখা গিয়েছে। কিন্তু তা আবহাওয়ার কথা ভেবে না কি আইপিএলের কথা ভেবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
এই মরসুমে রঞ্জি ট্রফি হচ্ছে দু’টি ভাগে। ১১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছিল ভারতের লাল বলের ঘরোয়া ক্রিকেট। প্রতিটি দল পাঁচটি করে ম্যাচ খেলার পরেই সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হয় রঞ্জি। কারণ ওই সময় সৈয়দ মুস্তাক আলি (ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা) এবং বিজয় হজারে ট্রফি (ঘরোয়া এক দিনের প্রতিযোগিতা) খেলানো হয়। আবার ২৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় রঞ্জি ট্রফি। এমন সূচি করার কারণ বোঝা মুশকিল। মধ্যপ্রদেশের কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত বলেন, “আমার মনে হয় বোর্ড অনেক ভেবেই সূচি তৈরি করেছে। তবে কোচ এবং ক্রিকেটারদের দিক থেকে দেখলে বলতে পারি এক বার লাল বল, এক বার সাদা বল, আবার লাল বলে খেলাটা একটু সমস্যার। বোর্ডের নিশ্চয়ই কোনও কারণ রয়েছে এমন সূচি তৈরি করার। সে বিষয়ে আমার পক্ষে বলা কঠিন। হয়তো আইপিএলের নিলামের জন্য এমনটা করা হয়েছে। ক্রিকেটারদের দেখে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে আইপিএলের দলগুলোকে।” আইপিএলের নিলাম ছিল ২৪ এবং ২৫ নভেম্বর। মুস্তাক আলি শুরু হয়েছিল ২৩ নভেম্বর থেকে। যদিও এটাকে সমস্যা বলে মানতে নারাজ শার্দূল ঠাকুর। মুম্বইয়ের অলরাউন্ডার বলেন, “আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো আমাদের মাঝেমধ্যে লাল বলের পর সাদা বলের ক্রিকেট খেলতে হয়। মানসিকতার একটা পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। তরুণদের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ। সূচির এই পরিবর্তনটা আমার মনে হয় ক্রিকেটারদের জন্য ভাল। অনেক লাল বলের ক্রিকেটারেরা বিশ্রামও পাবে।” অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতকে সিরিজ় জিতিয়েছিলেন অজিঙ্ক রাহানে। এখন তিনি আন্তর্জাতিক দলের বাইরে। তবে রঞ্জিতে নিয়মিত খেলেন। রাহানে বলেন, “আমরা লাল বলের ক্রিকেট খেলছিলাম। তার পর সাদা বলের ক্রিকেট খেললাম। এখন বার লাল বলের ক্রিকেট খেলছি। এটা কখনও ম্যাচ হারার অজুহাত হতে পারে না। আমার মনে হয় দলের এর থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। তা হলেই আরও ভাল খেলতে পারব।”
সূচি নিয়ে আরও একটি সমস্যা রয়েছে। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট চলার সময় রোহিতদের অস্ট্রেলিয়া সফর ছিল। তা ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে যেতে হয়েছিল। এখন ইংল্যান্ড এসেছে খেলতে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আন্তর্জাতিক দলে সুযোগ পাওয়া ক্রিকেটারদের পক্ষে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা সম্ভব হচ্ছে না।
সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন এই বিষয়টা দেখা উচিত ভারতীয় বোর্ডের। বাংলার রঞ্জি জয়ী অধিনায়ক বলেন, “সব ভারতীয় ক্রিকেটারদের রঞ্জি না খেলতে পারার জন্য কিছুটা দায়ী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ড এমন ভাবে সূচি করে, যাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারেরা ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে পারে। ভারতের তেমনই করা উচিত। রঞ্জির সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থাকলে রোহিত, কোহলিরা ঘরোয়া ক্রিকেট খেলবে কী করে?”
আম্পায়ারিংয়ের মান
রঞ্জিতে আরও একটি অভিযোগ আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে। সদ্যসমাপ্ত মুম্বই বনাম জম্মু-কাশ্মীর ম্যাচেই এই নিয়ে অভিযোগ ওঠে। জম্মু-কাশ্মীর ম্যাচ জিতলেও বোর্ডের কাছে অভিযোগ জমা দেয়। তাদের অভিযোগ, শ্রেয়স আয়ারের ব্যাট বল লেগে উইকেটরক্ষকের হাতে গেলেও আউট দেওয়া হয়নি। আবার জম্মুর ব্যাটার আবিদ মুশতাককে ভুল এলবিডব্লিউ দেওয়া হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের ক্রিকেট কর্তা অনিল গুপ্তা বলেন, “বোর্ডের কাছে আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছি। বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের বিপক্ষে গিয়েছে। সেই নিয়ে বোর্ডকে জানানো হয়েছে।”
রঞ্জিতে আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন এই প্রথম উঠছে এমন নয়। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারিও অভিযোগ করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারেরা অনেক সময় মদ খেয়েও নেমেছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০ হাজারের বেশি রান করা মনোজ বলেছিলেন, “যদি ক্রিকেটারদের ডোপ পরীক্ষা হয়, তা হলে আম্পায়ারদেরও হওয়া উচিত। বিশেষ করে ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ারদের। অনেক সময়ই আম্পায়ারদের দেখেছি রাতের নেশা না কাটিয়ে সকালে মাঠে নামতে। ঘুমজড়ানো চোখে রঞ্জিতে আম্পায়ারিং করতে দেখেছি অনেককে। এমন অবস্থায় ঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন কী করে তিনি?”
একটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছিলেন মনোজ। তিনি বলেছিলেন, “আমি এক বার এক আম্পায়ারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘স্যর, কাল রাতে কী খেলেন?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি বরফ দিয়ে হুইস্কি খেতে পছন্দ করি।’ প্রতি মরসুম শুরুর আগে আম্পায়ারদের চোখ পরীক্ষা করা উচিত বোর্ডের। তাঁদের কানও পরীক্ষা করা উচিত।”
ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারের মানও উন্নত করা উচিত বলে মনে করেন মনোজ। তিনি বলেন, “আম্পায়ারিংটাই আমার কাছে সব থেকে চিন্তার। ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারিংয়ের মান খুব খারাপ। বোর্ডের এই বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত। এটা এক-দুটো মরসুমের ব্যাপার নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই এটা দেখছি। শিশুর মতো ভুল করেন অনেক আম্পায়ার।” ভুল আম্পায়ারিংয়ের কারণেও রঞ্জি ট্রফির মান কমছে।
পিচ এবং মাঠ সমস্যা
আইপিএলের জন্য পিচ তৈরি করতে হবে, সেই কারণে জয়পুরের সওয়াই মানসিংহ স্টেডিয়ামে খেলা হয়নি। যে রঞ্জি ট্রফিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেখানেই এমন সমস্যা। জয়পুরের সওয়াই মানসিংহ স্টেডিয়ামে আইপিএলের ম্যাচ খেলে রাজস্থান রয়্যালস। ঘরোয়া ক্রিকেটে সেই মাঠেই খেলে রাজস্থান। অথচ ২৩ জানুয়ারি থেকে বিদর্ভের সঙ্গে রাজস্থানের ম্যাচ থাকলেও সেটি সওয়াই মানসিংহ স্টেডিয়ামে হয়নি। জয়পুর শহরের প্রান্তে কেএল সাইনি স্টেডিয়ামে খেলা হয়। সেই স্টেডিয়ামে শেষ বার প্রথম শ্রেণির ম্যাচ হয়েছিল ২০১২ সালের ডিসেম্বরে।
২০২৩ সালে ইডেনের পিচ নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন তৎকালীন বাংলার অধিনায়ক মনোজ। পিচ ভিজে থাকায় সে বার একটি ম্যাচ সঠিক সময় শুরু করা যায়নি। যা নিয়ে বিরক্ত হয়েছিলেন মনোজ। বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী রঞ্জিতে পিচ প্রস্তুত করে নিরপেক্ষ পিচপ্রস্তুতকারক। অর্থাৎ, যে মাঠে খেলা হচ্ছে, সেই রাজ্য সংস্থার পিচ প্রস্তুতকারকের বদলে অন্য কাউকে পাঠানো হয় বোর্ডের পক্ষ থেকে। ঘরোয়া দল যাতে বাড়তি সুবিধা না পায়, সেই কারণেই এমন নিয়ম। কিন্তু সেখানেই ঘটে বিপত্তি। অনেক সময় বাইরে থেকে আসা পিচ প্রস্তুতকারক বুঝতে পারেন না সেই পিচের কেমন পরিচর্যা দরকার। কারণ ভারতের বিভিন্ন জায়গার মাটির চরিত্র আলাদা। সেই তফাতের কারণে পিচের পরিচর্যাতেও তফাত থাকে।
মনোজ যে ম্যাচে অভিযোগ করেছিলেন, সেই ম্যাচে ইডেনের পিচ তৈরি করার দায়িত্ব ছিল সার্ভিসেসের পিচ প্রস্তুতকারক অশোক বর্মার। তিনি না বুঝে বেশি জল ব্যবহার করেছিলেন, তাতেই বিপত্তি। ভারতের বিভিন্ন পিচ প্রস্তুতকারকের যে অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে তা স্পষ্ট, যা সমস্যার কারণ হয় ক্রিকেটারদের জন্য। প্রভাব পড়ে খেলার উপর।
কোহলিরা খেলায় সকলের নজর রঞ্জির দিকে ফিরেছে এটা সত্যি। কিন্তু বোর্ডেরও উচিত এই প্রতিযোগিতার মান উন্নত করতে বাড়তি নজর দেওয়া। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যা রঞ্জি ট্রফির উন্নতি করবে। না হলে আগামী দিনে ভাল টেস্ট ক্রিকেটার পাওয়া মুশকিল হবে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। টি-টোয়েন্টিতে দাপট দেখিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে ভারতীয় ক্রিকেটারদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy