নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে দলকে ভরসা দিলেন সরফরাজ় খান। ছবি: পিটিআই।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শতরান। এই দিনটির জন্য কত পরিশ্রম করেছেন সরফরাজ় খান। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক ভাবে রান করে গিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই ভারতীয় দলের দরজা খুলতে পারছিলেন না। এই বছরের শুরুতে অভিষেক হয় তাঁর। আর এই ২০২৪ সালেই করলেন শতরান। তা-ও আবার প্রথম ইনিংসে ৪৬ রানে শেষ হয়ে যাওয়া ভারতকে লড়াইয়ে ফেরানো রান। এই ইনিংস মিডল অর্ডারে শুধু তাঁর জায়গা পাকা করার জন্য নয়, দেশকে বাঁচানোরও।
শুক্রবার সরফরাজ় এবং বিরাট কোহলি মিলে ১৩৬ রানের জুটি গড়েন। তাঁদের সেই জুটি আশা জাগিয়েছিল লড়াইয়ে ফেরার। কিন্তু তৃতীয় দিনের শেষ বলে বিরাট আউট হওয়ার পর দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছিল সরফরাজ়ের। ভারতীয় সমর্থকদের চিন্তা ছিল তিনি শনিবার সকালে সেই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কি না। কিন্তু টিম সাউদির ওভারের তৃতীয় বলটি ব্যাক ফুটে এসে কভারের দিকে ঠেলে দিয়েই দৌড় শুরু করলেন সরফরাজ়। হেলমেট খুলে ফেললেন। বুঝে গিয়েছেন বলটি বাউন্ডারি পার করবে। কাঙ্ক্ষিত শতরানটি এসে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শতরান।
১৭ বছর বয়সে প্রথম বার ক্রিকেটবিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন সরফরাজ়। প্রথমে বাবা নওশাদ খানের অধীনে অনুশীলন শুরু করেন। নওশাদ নিজেও মুম্বইয়ের প্রাক্তন ক্রিকেটার ছিলেন। ২০১৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় সরফরাজ়ের। তিনি সেই বিরল ক্রিকেটারদের এক জন, যিনি দু’টি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছেন। ২০০৯ সালে হ্যারিস শিল্ডের একটি ম্যাচে ৪৩৯ রান করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে সচিন তেন্ডুলকরের ২১ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন। তার পরেই সরফরাজ়কে মুম্বইয়ের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে নিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে ভাল খেলে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও সুযোগ পান। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ইতিহাসে সরফরাজ়ের ৫৬৬ রান তৃতীয় সর্বোচ্চ। তার আগে রয়েছেন শুধু অইন মর্গ্যান এবং বাবর আজ়ম।
সরফরাজ়ের জীবনে বিতর্ক কম হয়নি। বয়স ভাঁড়ানোর অভিযোগে তাঁকে নিলম্বিত করে দেয় মুম্বই ক্রিকেট সংস্থা (এমসিএ)। প্রথমে মানতে না চাইলেও পরে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেন সরফরাজ়। শৃঙ্খলাজনিত কারণে এর পর এমসিএ-র ইন্ডোর অ্যাকাডেমি ক্যাম্প থেকে নির্বাসিত করা হয় তাঁকে। সরফরাজ়ের রাগ তাঁকে বার বার বিপদে ফেলছিল। ২০১৪-১৫ মরসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর ম্যাচ ফি আটকে রাখা হয়। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটের একটি ম্যাচে নির্বাচকদের উদ্দেশে কিছু অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন তিনি। ২০১৪-১৫ মরসুমের পরেই সরফরাজ় মুম্বই ছেড়ে উত্তরপ্রদেশের হয়ে খেলতে চলে যান।
উত্তরপ্রদেশে দুটো মরসুম কাটালেও সে ভাবে সাফল্য পাননি। ফলে জাতীয় দলের দরজা খোলার কোনও সুযোগই ছিল না। ২০১৯-২০ মরসুমে সরফরাজ় আবার ফিরে আসেন মুম্বইয়ে। সেটাই ছিল মোড়ঘোরানো সিদ্ধান্ত। পরের দু’টি মরসুমে যে দাপটের সঙ্গে তিনি ব্যাট করেন তা ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব কম ক্রিকেটারই করতে পেরেছেন। ওয়াসিম জাফর এবং অজয় শর্মার পরে ভারতের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসাবে প্রথম শ্রেণির ঘরোয়া ক্রিকেটে পর পর দু’বার ৯০০-এর বেশি রান করেন। গত মরসুমেও ভাল খেলেছেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পর রান করেও সুযোগ না পাওয়ায় বার বার প্রতিবাদ করেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন ‘বিদ্রোহী’ ক্রিকেটার। ২০২২-এর বাংলাদেশ সিরিজ়ে তাঁকে সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই সফর তো দূর, পরের অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়েও সুযোগ পাননি। সেই সময় রঞ্জিতে একটি ম্যাচের পর বলেছিলেন, ‘‘গত রঞ্জির ফাইনালে সেঞ্চুরির পরে নির্বাচকদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ওঁরা বলেছিলেন, বাংলাদেশ সফরে সুযোগ পাব। তৈরি থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু পাইনি।’’ তৎকালীন নির্বাচক প্রধান চেতন শর্মার কথাও টেনে এনেছিলেন সরফরাজ়। বলেছিলেন, ‘‘কয়েক দিন আগেই চেতন স্যরের সঙ্গে দেখা হল। উনি বললেন, আমি খুব তাড়াতাড়ি সুযোগ পাব। নির্বাচকেদের কথায় বার বার আশা জাগছে। কিন্তু বার বার হতাশ হচ্ছি। এ ভাবে আগে থেকে আশা জাগানো ঠিক নয়।’’
ভারত ‘এ’ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ভাল খেলতে পারেননি। সেই কারণেই কি জাতীয় দলে জায়গা পেতে দেরি হচ্ছে সরফরাজ়ের? এ কথা মানতে চাননি মুম্বইয়ের ক্রিকেটার। বলেছিলেন, ‘‘কয়েকটা ম্যাচ ব্যর্থ হতেই পারি। আমি তো ভগবান নই। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে লাল ও সাদা বল, দু’ধরনের ক্রিকেটেই ধারাবাহিক ভাবে রান করেছি। আমাকে এক দিনের দলেও সুযোগ দিতে পারে বোর্ড। এত দিন ধরে খেলছি। জাতীয় দলে সুযোগ পেতে আর কী করব?”
গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সুযোগ না পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন সরফরাজ়। কিন্তু তার পরে মনকে বুঝিয়েছিলেন, তাঁর কাজ শুধু খেলা। সরফরাজ় বলেছিলেন, ‘‘দলে নাম না দেখে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কেঁদে ফেলেছিলাম। কিন্তু তার পরে মনকে বোঝালাম, আমার কাজ শুধু খেলা। ঘরোয়া ক্রিকেটে আরও ভাল খেলার চেষ্টা করব। তাতে যদি নির্বাচকদের মনে জায়গা করতে পারি।’’
এই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারিও কেঁদেছিলেন সরফরাজ়। তাঁর বাবা এবং স্ত্রীর চোখ দিয়েও জল বেরিয়েছিল। তবে সেই চোখের জল বঞ্চনার নয়, ছিল আনন্দের। সতীর্থদের মাঝে দাঁড়িয়ে অনিল কুম্বলের হাত থেকে টেস্ট অভিষেকের টুপি নিয়েছিলেন সরফরাজ়। ছেলের কেরিয়ারের সবচেয়ে বড় মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন তাঁর বাবা। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন ছেলের মাথায় টেস্ট টুপি। যা দেখে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি সরফরাজ়ের বাবা নওশাদ। কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। সরফরাজ়কে টুপি নিতে দেখে প্রথমে হাসছিলেন নওশাদ। তার পরেই কেঁদে ফেলেছিলেন। জামা দিয়ে চোখ ঢাকেন। টুপি পেয়ে প্রথমেই বাবার কাছে গিয়েছিলেন সরফরাজ়। তাঁকে টুপি দেখিয়েছিলেন। যে টুপি পাওয়ার জন্য দীর্ঘ দিন বাড়ির সামনে নেট বানিয়ে অনুশীলন করে গিয়েছিলেন তাঁরা। ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বাবা। বোঝা যাচ্ছিল, এত বছরের অপেক্ষার অবসানের পরে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন না তাঁরা। চোখের জল বাধ মানছিল না নওশাদের। ছেলের টেস্ট টুপিতেও চুমু খেয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন সরফরাজ়ের স্ত্রীও। বাবার পরে স্ত্রীকেও জড়িয়ে ধরেছিলেন সরফরাজ়। শনিবার সেই আনন্দ আরও এক ধাপ বাড়ল।
সরফরাজ়ের সঙ্গে বঞ্চনার ইতিহাস বেশ লম্বা। গত বছরও তাঁকে হতাশ হতে হয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি ওয়েস্ট ইন্ডিজ়গামী দলেও নেওয়া হয়নি সরফরাজ়কে। তার পরে তিনি পাশে পেয়েছিলেন সুনীল গাওস্করকে। একটি সাক্ষাৎকারে ভারতীয় দল নির্বাচন নিয়ে মুখ খুলেছিলেন গাওস্কর। তিনি বলেছিলেন, ‘‘গত তিন মরসুম ধরে ১০০ গড়ে রান করেছে সরফরাজ়। এর পরেও দলে সুযোগ পায়নি। সুযোগ পেতে ওকে আর কী করতে হবে? প্রথম একাদশে না খেলালেও ওকে অন্তত দলে নেওয়া উচিত ছিল।’’
সেই সুযোগ সরফরাজ় পেলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন কেন আরও আগে সুযোগ পেতে পারতেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চলতি টেস্টের আগে তিন ম্যাচে ২০০ রান করেছিলেন তিনি। শনিবার তাঁর ব্যাটে এল তিন অঙ্কের রান। তার পরেও ক্রিজ়ে টিকে থাকলেন। দলকে যে তখনও বিপদ থেকে বার করা বাকি রয়েছে। সেই লক্ষ্যেই অবিচল সরফরাজ়। দলে সুযোগ না পাওয়ার জন্য যিনি বার বার বিদ্রোহ করতেন, সেই সরফরাজ় বেঙ্গালুরুতে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন। হার না মানা লড়াই করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy