গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় ধোনির সঙ্গে দাহানি। ছবি: টুইটার।
দেশের হয়ে উইকেট পেলে কী ভাবে উৎসব করবেন, তা এখনও ঠিক করতে পারেননি। যদিও সামনের দিকে হাত ছুড়ে শাহনওয়াজ দাহানির উচ্ছ্বাস প্রকাশ জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে পাকিস্তানে। দাহানি চান তাঁর উইকেট প্রাপ্তির উৎসবের নির্দিষ্ট একটা ধরন তৈরি হোক। তাই প্রতি দিন নেটে বোলিং অনুশীলনের পাশাপাশি এটিও পালন করেন পাকিস্তানের জোরে বোলার। ক্যারিবিয়ান বোলারদের উল্লাসের ধরণ দেখে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করার চেষ্টা করছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাহানির অভিজ্ঞতা এখনও পর্যন্ত পাঁচটি ম্যাচের। দু’টি এক দিনের ম্যাচ এবং তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন ১০টি। সে অর্থে ২৪ বছরের জোরে বোলারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবন সবে হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে। এখনই বোলিংয়ের থেকেও উইকেট পাওয়ার আনন্দ কী করে করবেন, তা নিয়ে আগ্রহ বেশি!
সিন্ধ প্রদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশের ছোট্ট শহর লারকানার কাছে দাহানির গ্রাম। নাম, খওয়ার খান দাহানি। গুগল ম্যাপে এই গ্রামের অস্তিত্ব নেই। পাকিস্তানের ওই অঞ্চলের প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে গত বছর জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন দাহানি। তাতেই কি তাঁর মাথা ঘুরে গিয়েছে? না হলে নেটে উইকেট প্রাপ্তির উৎসবের অনুশীলন কেন! তরুণ জোরে বোলারকে এই অভিনব অনুশীলনের পরামর্শ দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন অলরাউন্ডার আজহার মেহমুদ। তিনি চেয়েছেন দাহানির মধ্যে উৎসব পালনের নেশা ধরিয়ে দিতে। তাতে তাঁর উইকেট নেওয়ার জেদ আরও বাড়বে। জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত সর্ষে ক্ষেতে কাজ করা জোরে বোলারের ভাবনা অন্য রকম। তিনি বলেছেন, ‘‘জীবন তো উদ্যাপন করার জন্যই। আমার কাছে জীবন মানে বল করা। সিরিয়াস থাকা জরুরি। পাশাপাশি একটু আনন্দও তো দরকার।’’
দাহানির জীবন কিন্তু এমন উৎসবমুখর নয়। এশিয়া কাপ খেলতে এখন দুবাইয়ে। রাতের ঘুম উড়িয়েছে পাকিস্তানের বন্যা। বাড়িতে মা, দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না ঠিক মতো। বন্যায় ভেসে গিয়েছে তাঁদের এলাকা। বিদ্যুৎ নেই। প্রতি দিন কঠিন হচ্ছে জীবনযাপনের লড়াই। দাহানির শরীরটাই শুধু পড়ে রয়েছে দুবাইয়ের বিলাসবহুল অভিজাত হোটেলে। মনের ঠিকানা জলমগ্ন পাকিস্তান। তার মধ্যেই এশিয়া কাপে দেশের জন্য নিজের সবটুকু নিংড়ে দিতে চান। বিপক্ষের ব্যাটারদের আউট করাই তাঁর এক মাত্র লক্ষ্য নয়। দাহানি বলেছেন, ‘‘পুরো শক্তি দিয়ে বল করি। শুধু উইকেট পাওয়াই লক্ষ্য থাকে না। প্রতিটি বলের গতিতে ব্যাটারকে ভয় পাওয়াতে চাই।’’
দিন কয়েক আগে দাহানির বলের গতি টের পেয়েছেন আসিফ আলি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর নেটে বল করার ডাক পান দাহানি। দলের নতুন সদস্য। তাই নেটে সুযোগ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করাটাই দস্তুর। দীর্ঘ অপেক্ষা তাঁর জেদ বাড়িয়ে দেয়। তাঁর প্রথম বলেই টলে যান আসিফ। বলের গতি সামলাতেই পারেননি পাক ব্যাটার। শাহিন আফ্রিদির অনুপস্থিতি ঢাকতে দাহানিকে ভারতের বিরুদ্ধে খেলানোর সিদ্ধান্ত তখনই নিয়ে নেন কোচ সাকলাইন মুস্তাক।
অথচ বছর তিনেক হল বুক ফুলিয়ে বোলিং করতে পারছেন দাহানি। তার আগে পর্যন্ত ক্রিকেট খেলতে হত লুকিয়ে। তাঁর বাবা চাননি ক্রিকেট খেলুক ছোট ছেলে। দাহানি বলেছেন, ‘‘বাবা চাইতেন না ক্রিকেট খেলি। বলেছিলেন মন দিয়ে পড়াশোনা করতে। লারকানায় সরকারি চাকরি করতে। কারণ, আমাদের এলাকা থেকে কেউ কখনও পাকিস্তানের হয়ে ক্রিকেট খেলেনি। আগের নির্বাচকরা বোধ হয় ও দিকে তাকাতেন না। বাবা বলতেন, ক্রিকেট খেলে লাভ নেই। পাকিস্তানের হয়ে খেলার সুযোগ পাবে না। পড়াশোনা কর।’’ বাবার অবাধ্য হননি দাহানি। মন দিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বাবা-দাদাকে চাষের কাজে নিয়মিত সাহায্য করেছেন।
লারকানা প্রাকৃতিক ভাবে অত্যন্ত শুষ্ক। চাষের কাজ বেশ কঠিন। সব সামলে ক্রিকেট খেলতেন লুকিয়ে। বাবার অবাধ্য হতে না চাইলেও পাকিস্তানের হয়ে খেলার স্বপ্ন চাষের জমিতে পুঁতে দেননি।
হাসতে হাসতে দাহানি বলেছেন, ‘‘বাবা জানতেন, আমি ক্রিকেট খেলি না। তাই ক্রিকেটের সরঞ্জাম কেনার উপায় ছিল না। ব্যাট, জামা বন্ধুদের বাড়িতেই থাকত। আমার জুতো ছিল না। বন্ধুদের জুতো পরে খেলতাম। দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরেও খেলেছি কোনও কোনও দিন। ক্লাবের সবাই ভাবতেন, আমি খুবই অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান। প্রচুর জুতো আমার। তাই একেক দিন একেকটা পরে খেলি।’’
নিজে জোরে বোলার হলেও ওয়াসিম আক্রম বা ওয়াকার ইউনিসরা তাঁর প্রিয় ক্রিকেটার নন। দাহানির প্রিয় ক্রিকেটারের নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তান দলে ছিলেন দাহানি। সেই ম্যাচে জয় পায় পাকিস্তান। সে বার ভারতীয় দলের সঙ্গে ছিলেন ধোনিও। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ককে দেখেই তাঁর কাছে চলে যান দাহানি। ধোনির সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দ নেটমাধ্যমে ভাগ করে নিয়েছিলেন তিনি।
ছোট বেলায় চাষের জমিতে ক্রিকেট খেলতেন দাহানি। কখনও প্লাস্টিকের বল, কখনও টেনিস বলে খেলেছেন বন্ধুদের সঙ্গে। তা-ও না পেলে কাগজ আর টেপ দিয়ে নিজেরাই বল তৈরি করে নিতেন। তা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ বাড়তে শুরু করে তাঁর। সমান্তরাল ভাবে বাড়তে থাকে বলের গতিও। এক সময় কাগজের বলের গতিকেও ভয় পেতেন দাহানির গ্রামের বন্ধুরা। ভাইয়ের ক্রিকেট খেলার প্রতি ভালবাসাকে উসকে দিয়েছিলেন দাদা মজিদ। বাবাকে এড়িয়ে তিনি ভাইকে আলাপ করিয়ে দেন এক বন্ধুর সঙ্গে। তিনি লারকানার আল শাহবাজ ক্রিকেট ক্লাবে খেলতেন। এই ক্লাবই দাহানির ক্রিকেটের আঁতুরঘর। সেখানেই প্রথম চোখে দেখেন ক্রিকেট বল। তরুণ জোরে বোলার বলেছেন, ‘‘প্রথমে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এত শক্ত বল!’’ চামড়ার বল দেখার দু’বছর পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন। তার দু’বছর পর ডাক পান পাকিস্তান জাতীয় দলে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সুযোগ পাওয়ার পর বাবা কিছুটা নরম হয়েছিলেন। যদিও বিশ্বাস করতেন না ছেলে পাকিস্তানের হয়ে খেলার সুযোগ পাবে।
গত বছর মাঝামাঝি লাহৌর থেকে লারকানা ফেরার সময় ভিড় বাসে জাতীয় নির্বাচকদের ফোন পান। জানতে পারেন স্বপ্নপূরণের কথা। দাহানি বলেছেন, ‘‘ফোনটা ছাড়ার পরেই প্রথম বাবার কথা মনে পড়েছিল। বাবাকে প্রথম সুখবরটা দিতে চেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, বাবা শুনলে খুব খুশি হবেন।’’ দেরি করেননি। বাস থেকে নেমেই দাহানি ছুটেছিলেন বাবার কাছে। কবরের কাছে মুখ নামিয়ে বাবার কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন সুখবর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy