টানা এগারো প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচে জয়। গোল খেয়েছে দুটো। গোল করেছে পঁচিশটা। সতেরো ম্যাচ পরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের এক নম্বরে।
এ তো গেল নিছক পরিসংখ্যান।
কিন্তু শুকনো কিছু সংখ্যা কিছুতেই সবটা বোঝাতে পারে না যে, আন্তোনিও কন্তে পুড়ে যাওয়া এক সাম্রাজ্যকে কী ভাবে আবার ঝাঁ চকচকে করে তুলেছেন!
বোঝাতে পারে না, দিয়েগো কোস্তার আগুনে ফর্মের সামনে কী ভাবে ঘুম উড়েছে বিপক্ষ ডিফেন্ডারদের।
বোঝাতে পারে না, এডেন হ্যাজার্ড কী ভাবে গত মরসুমের দুঃস্বপ্ন ভুলে একের পর এক অভিনব স্কিল উপহার দিচ্ছেন।
এ মরসুমের প্রিমিয়ার লিগ শুরুর সময় স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে কন্তে মানে ছিলেন ইপিএলে অপরীক্ষিত এক বিদেশি কোচ। কিন্তু সতেরো ম্যাচ পরে চেলসিতে কন্তে নামটাই পাকাপাকি ইতিহাস হওয়ার মুখে। কন্তে কোচ হয়ে আসার সময় চেলসি জুড়ে মোরিনহোকে হারানোর শোক। দলের সেরা প্রতিভারা ক্লাব ছাড়ার মুখে। ক্লাব কর্তারা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে যোগ্যতা অর্জন না করার ক্ষতিপূরণ গুণতে ব্যস্ত।
কিন্তু ওই যে কথায় আছে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে!
কন্তের একটা ছোট্ট চাল, ৩-৪-৩ ফর্মেশনে নীল জার্সিকে পাল্টে দেওয়া। আর তাতেই উলটপুরাণ!
ইপিএলে ফের নীল বিপ্লবের পিছনে তাই তো কন্তের মগজকেই সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর মানা হচ্ছে। মোহনবাগানকে আই লিগ-ফেড কাপ দেওয়া কোচ সঞ্জয় সেনের কাছে যা প্রায় অলৌকিক প্রত্যাবর্তন। ‘‘কন্তে যা করছেন সেটা অনেকটা অলৌকিক! ইউরোপে ইপিএল হচ্ছে সবচেয়ে বেশি রেজাল্টের লিগ। চেলসি এমন একটা ক্লাব যেখানে তুমি যতই ভাল কোচ হও না কেন রেজাল্ট না দিতে পারলে চেয়ার বাঁচানোর কোনও সময় পাবে না। কন্তে সেই চাপটা ভাল ভাবে নিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে চেলসিতে আসার অনেক আগে থেকে দলটার প্ল্যানিং শুরু করে দিয়েছিল,’’ বললেন সঞ্জয়।
একজন কোচের সবচেয়ে বড় গুণ ম্যান ম্যানেজমেন্ট। ফুটবলের ভাষায় কোচ হচ্ছেন একজন সেলসম্যান। ফুটবলারদের কাছে কত দ্রুত নিজের আইডিয়া বিক্রি করতে পারলেন সেটার উপর সাফল্য নির্ভর করছে। কন্তে সেই জিনিসটা নিঁখুত ভাবে করেছেন। সঞ্জয় বলছেন, ‘‘গত মরসুম থেকে এ বার চেলসির দল এমন কিছু পাল্টায়নি। কোর গ্রুপটা এক রয়েছে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে কন্তের স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে পুরোপুরি মানিয়ে নিয়েছে প্লেয়াররা। হ্যাজার্ড, কোস্তাদের মতো প্লেয়ারদের অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছে। যার মানে কন্তে খুব দ্রুত নিজের আইডিয়াগুলো দলের মধ্যে ভরে দিতে পেরেছেন।’’
নীল ঝড়
শেষ ১১ ম্যাচ
জয় ১১
গোল ২৫
গোল খেয়েছে ২
ক্লিনশিট ৯
ইপিএলে ১
স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবেও কন্তে কারও থেকে কম যান না। শুরুতে চেলসির পছন্দের ফর্মেশনে খেলতেন কন্তে। আর্সেনাল আর লিভারপুলের বিরুদ্ধে হারার পর ‘প্ল্যান বি’-তে চলে যান প্রাক্তন ইতালি কোচ। নিজের ট্রেডমার্ক ফর্মেশন ৩-৪-৩ নিয়ে আসেন ‘মেন ইন ব্লু’-তে। যার পর থেকে চেলসি অপ্রতিরোধ্য। সঞ্জয়ের কথায়, ‘‘এই ফর্মেশনে এ বছর ইউরোয় ইতালিকেও খেলিয়েছেন কন্তে। উইংব্যাকরা থাকলে হ্যাজার্ড আর কোস্তার মতো আক্রমণাত্মক প্লেয়ারদের ট্র্যাক ব্যাক করতে হয় না। এতে চেলসির খেলায় ব্যালান্স থাকছে।’’
চেলসির পুনর্জন্মের পিছনে কন্তের বুদ্ধি ছাড়াও রয়েছে কোস্তার গোল। মরসুম শুরুতে ফুটবলবিশ্বের কাছে কোস্তা ছিলেন ‘ফ্লড জিনিয়াস’। যাঁর মাথা গরম আর মাঠে ঝামেলা করার প্রবণতা নিজের যাবতীয় প্রতিভার উপর জল ঢেলে দিত। কিন্তু ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ করা হোক সেই সতেরো ম্যাচ। প্রিমিয়ার লিগের বিতর্কিত চরিত্র সেখানে এক বিশ্বমানের স্ট্রাইকার। যিনি রাগ ভুলে গোল করছেন। হলুদ কার্ড দেখার বদলে সতীর্থদের গোল সাজিয়ে দিচ্ছেন। ১৩ গোল করে ইপিএলে সোনার বুটের দৌড়ের শীর্ষে কোস্তা-ই। ভারতের প্রাক্তন ফরোয়ার্ড বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘কোস্তা হচ্ছে ফুটবলের সেই ক্লাসিক সেন্টার ফরোয়ার্ড। পায়ে শট আছে। পেনাল্টি বক্সের আশেপাশে থাকতে ভালবাসে।’’
একটা ছবি ব্লকবাস্টার হওয়ার পিছনে যেমন প্রধান চরিত্রের অবদান থাকে, তেমনই সাপোর্টিং কাস্টেরও পরিশ্রম থাকে। চেলসির ভিক্টর মোজেস আর মার্কোস আলোন্সো যেমন। উইংব্যাকের ভূমিকায় যাঁরা চেলসির ইঞ্জিন হয়ে উঠেছেন। দাভিদ লুইজ আবার আগের মতো সেই ‘প্লে স্টেশন ডিফেন্ডার’ নেই। কন্তের অধীনে তাঁকে এখন সেন্টার ব্যাক লাগছে। হ্যাজার্ডও যা করে অভ্যস্ত সেটাই করছেন। ড্রিবল এবং গোল। কঁতেও ট্যাকলের পর ট্যাকল করে বিপক্ষের মুভ নষ্ট করছেন।
চেলসির শীর্ষে থাকার পিছনে সামান্য সাহায্য অবশ্যই চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এ বার তাদের না থাকা। অধিকাংশ সপ্তাহে মাত্র একটা করে ম্যাচ খেলতে পারছে। ক্লান্তি ঢুকছে না দলে। বিশ্বজিৎ বলছেন, ‘‘হ্যাঁ, একটা টুর্নামেন্টে মন দিলে সুবিধে হয়। কম ম্যাচ খেললে ফ্রেশ থাকে প্লেয়াররা।’’
তবে সবে সতেরো ম্যাচ হয়েছে। এখনও অনেক টুইস্ট বাকি। কিন্তু চেলসি যদি এই ফর্ম ধরে রাখতে পারে তা হলে গতবারের মতো ইপিএলের রং নীলই থাকবে। শুধু পাল্টাবে দলের নামটা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy