পরামর্শ: ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টের প্রস্তুতির ফাঁকে আলোচনা ভারতের কোচ রবি শাস্ত্রী ও অধিনায়ক বিরাট কোহালির। শুক্রবার নটিংহ্যামে। ছবি: এএফপি।
হ্যারল্ড লারউ়়ডের কাউন্টি নটিংহ্যাম। কিন্তু বিরাট কোহালির সতীর্থদের জন্য চিন্তার তথ্য হচ্ছে, লারউডের বডিলাইন বোলিং নয়, এখানকার ট্রেন্ট ব্রিজের মাঠে পেসারদের মারণাস্ত্রের নাম সুইং।
আর কে না জানে, এই ভারতীয় ব্যাটিংয়ের দুর্বলতা দুরন্ত গতি বা বাউন্সে নয়, তাঁদের কুলকিনারাহীন দেখায় বল বাতাসে নড়াচড়া করলে। তিন ওপেনার থেকে শুরু করে মিডল অর্ডারের দুই স্তম্ভ চেতেশ্বর পূজারা এবং অজিঙ্ক রাহানেকে পর্যন্ত সুইংয়ের সামনে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে।
ভারতীয় ব্যাটিংয়ের এমন বেহাল অবস্থা যে, দ্বিতীয় নতুন বলও নিতে হচ্ছে না ইংল্যান্ডকে। ওয়ান ডে-তে পঞ্চাশ ওভারের খেলা হয়। টেস্টে সেই ওভারটুকুও টিকতে পারছে না ইনিংস, পঁয়ত্রিশ ওভারেই শেষ করে দেওয়া যাচ্ছে বিজয়, রাহুলদের। এই অবস্থা থেকে কী ভাবে ফিরে আসবেন ব্যাটসম্যানেরা? তা-ও আবার এমন একটা জায়গায়, যেখানে ইংল্যান্ডের সুইং সম্রাটরা সেরা সাফল্য উপভোগ করেছেন।
ক্রিকেটের ইতিহাসে ০-২ পিছিয়ে পড়ে শুধু এক বারই কোনও দল পাঁচ টেস্টের সিরিজে জিতেছে। ১৯৩৬-’৩৭ মরসুমে ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া হারিয়েছিল ইংল্যান্ডকে। ভারত অধিনায়ক যদিও মনে করছেন, তাঁর দলের পক্ষে এই দুঃসাহসিক কাণ্ড করে দেখানো সম্ভব। অধিনায়ক হিসেবে দু’বার এ রকম পরিস্থিতি দেখেছেন কোহালি। শ্রীলঙ্কায় ২০১৫ সালে। গলে প্রথম টেস্টে জেতা ম্যাচ হেরে যান তাঁরা। বাকি দুই টেস্ট জিতে সিরিজ ছিনিয়ে নেন। শেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও প্রথম দুই টেস্ট হেরে সিরিজ হেরে যাওয়ার পরে ওয়ান্ডারার্সে বিপজ্জনক পিচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয় ভারত।
ওয়ান্ডারার্স অবশ্যই এই দুঃসাহসিক প্রত্যাবর্তন অভিযানে টগবগে করে তোলার মতো উদাহরণ হতে পারে। টিমের মধ্যে ওয়ান্ডারার্সকে উদাহরণ করার কথা বার বার আলোচিতও হচ্ছে। কোহালি স্বয়ং এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বলে গেলেন, ‘‘দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে গিয়েছে, তখন তো একটাই দিকে যেতে পারে মানুষ। আমাদের মধ্যেও তাই একটাই বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। এই টেস্ট জেতা নিয়ে। আর কোনও রাস্তা খোলা নেই সামনে।’’
কোহালির ক্রিকেটীয় দক্ষতা বা উৎকর্ষ নিয়ে সংশয় নেই। তাঁর হার-না-মানা মানসিকতা সম্পর্কেও এত দিনে মানুষ ওয়াকিবহাল। কিন্তু জোরাল প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে তাঁর সতীর্থদের নিয়ে। কোহালিকে (গড় ৬০) বাদ দিলে চলতি সিরিজে প্রথম দুই টেস্ট মিলিয়ে ব্যাটিং গড়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারতীয় ক্রিকেটারের নাম অশ্বিন। চার ইনিংসে ৮৫ রান করেছেন অফস্পিনার। গড় ২৮.৩৩। কোহালি চার ইনিংসে ২৪০। এর মধ্যে শুধু এজবাস্টনে প্রথম টেস্টেই দুই ইনিংস মিলিয়ে করেন ২০০ রান। ব্যাটিং গড়ে তৃতীয় স্থানে হার্দিক পাণ্ড্য (২২.৫)। তিনিও বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান নন, অলরাউন্ডার হিসেবে রয়েছেন।
বাকি যাঁরা ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন, দলকে সম্মানজনক স্কোরে পৌঁছে দেওয়া যাঁদের দায়িত্ব, তাঁদের অবস্থা শোচনীয়। এম বিজয় চার ইনিংসে করেছেন মোট ২৬। গড় ৬.৫। সঙ্গী ওপেনার কে এল রাহুলের চার ইনিংসে সংগ্রহ ৩৫। গড় ৮.৭৫। শিখর ধওয়ন প্রথম টেস্টে খেলার পরে বাদ পড়েন। দুই ইনিংসে তাঁর সংগ্রহ ৩৯। সব চেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ মিডল অর্ডারে দুই স্তম্ভ— চেতেশ্বর পূজারা এবং অজিঙ্ক রাহানের ফর্ম। এজবাস্টনে বাইরে বসার পরে লর্ডসের দুই ইনিংস মিলিয়ে পূজারা করেছেন ১৮ রান। আর যাঁকে মনে করা হত বিদেশের মাটিতে সেরা ভরসা, সেই রাহানে চার ইনিংসে করেছেন ৪৮ রান। গড় ১২। সর্বোচ্চ ১৮। অফস্টাম্পের বাইরে বল হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
এমন মেঘলা আকাশ ভিড় করে রয়েছে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের মাথার উপরে। তার মধ্যেই এমন তথ্য হাতে পেয়ে নিশ্চয়ই স্বস্তিতে থাকা যায় না যে, ইংল্যান্ডের প্রিয় শিকার ভূমিতে সিরিজ রক্ষার লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে। নটিংহ্যামে শেষ ন’টি টেস্টের সাতটিতে জিতেছে ইংল্যান্ড। গত গ্রীষ্মে শুধু এ মাঠে তারা হেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে।
নটিংহ্যামে যেমন রবিনহুড ক্যাসল পাওয়া যাবে, তেমনই মাঠ হিসসেবে ট্রেন্ট ব্রিজ পরিচিত। অ্যান্ডারসন লর্ডসে একশো উইকেট নিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু ট্রেন্ট ব্রিজে তাঁর সাফল্যের হার আরও বেশি। এখানে মাত্র ৯টি টেস্টে ১৮.৯৫ গড়ে তিনি নিয়েছেন ৬০ উইকেট। স্টুয়ার্ট ব্রডের ঘরের মাঠ এটা। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০১৫-র অ্যাসেজে কেরিয়ারের সেরা বোলিং, ১৫ রানে আট উইকেটের স্পেল ছিল এখানেই। ২০১১-তে ভারত যখন ইংল্যান্ড সফরে এসেছিল, ট্রেন্ট ব্রিজেই হ্যাটট্রিক ছিল ব্রডের।
ট্রেন্ট ব্রিজকে বলা হয় সুইংয়ের দুর্গ। ইংল্যান্ডের মাঠগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বেশি করে বল সুইং করে ট্রেন্ট ব্রিজে। সকাল থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে থাকে। বৃষ্টি কমতে পারে, মেঘলা আকাশ সরে গিয়ে উজ্জ্বল রোদ্দুর দেখা যেতে পারে। কিন্তু কখনও বন্ধ হয় না এই জোরাল বাতাস। ইংল্যান্ড জুড়ে উষ্ণ প্রবাহের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছিল, ঠাণ্ডা হাওয়া থাকবে কি না। কিন্তু আবহাওয়ায় পরিবর্তন ভারতের চিন্তা বাড়িয়ে ট্রেন্ট ব্রিজকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে তার পুরনো মেজাজে।
সুইংয়ের দুর্গে দুই সুইং সম্রাটকে সামলাতে হবে। দু’জনের মিলিত শিকার প্রায় এক হাজার টেস্ট উইকেট। অ্যান্ডারসনের সংগ্রহ ৫৫৩ টেস্ট উইকেট, ব্রডের ৪২৪। সর্বকালের সেরা পেস জুটিদের সঙ্গে তাঁদের তুলনা করা শুরু হয়ে গিয়েছে। ০-২ পিছিয়ে পড়ে ধুঁকতে থাকা কোনও দলের কাছে এর চেয়ে কঠিন রণক্ষেত্র আর কিছু হতে পারে না। কোহালি সেই কারণেই বার বার জোর দিচ্ছেন মানসিকতার উপরে। তুমি পারবে মনে করলেই তোমার জন্য রাস্তা খোলা— এই হল তাঁর মন্ত্র। লর্ডসে হারের পরে তিনি জোর দিয়েছেন ইতিবাচক মনন গড়ে তোলা এবং টিম একাত্মতা বাড়ানোর উপরে। মনোবিদের ভূমিকা পালন করে হেড কোচ রবি শাস্ত্রী এবং তিনি প্রত্যেক ক্রিকেটারের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন। সেখানে মানসিক শক্তি বাড়ানোর উপরেই জোর দেওয়া হয়। এ দিন কোহালি বলে গেলেন, ‘‘এ রকম পরিবেশে একটা দারুণ বল যে কোনও মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে পারে। আর তাতেই চলে যেতে পারে প্রাণ। কিন্তু সেই ঘাতক বলটার কথা ভেবে ব্যাট করতে নামলে তো খেলতেই পারব না। আমাদের কাজ ইতিবাচক থেকে ভাবা যে, পরিবেশ যতই কঠিন হোক আমি পারব।’’ নটিংহ্যামের নায়ক মানেই দুঃসাহসিক চরিত্র। তির-ধনুক নিয়ে গরিবের পাশে দাঁড়ানো রবিনহুড। কয়লার খনিতে কাজ করার ফাঁকে বোলিং করে উঠে আসা বডিলাইনের মুখ্য চরিত্র হ্যারল্ড লারউড। ট্রেন্ট ব্রিজে জিততে গেলে ভয়ডরহীন হতে হবে কোহালির দলকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy