মায়ের সঙ্গে লাভলিনা
আমার কাছে স্বাধীনতার অর্থ— অলিম্পিক পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে থাকা আমি, দেশের জন্য জয় করা মেডেল, উড়তে থাকা তেরঙা আর জনগণমন অধিনায়ক জয় হে।
আমার কাছে স্বাধীনতার অর্থ এমন এক সমাজ, যেখানে পর পর তিনটি মেয়ের জন্ম দেওয়ার পরেও মা গর্বের হাসি হাসতে পারেন।
আমার কাছে স্বাধীনতার সার্থকতা সেখানেই, যখন ঘরের মেয়ে অলিম্পিক্সে পদক না জিতলেও প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছবে পাইপের জল, রাস্তা হবে পাকা।
আমার বয়সি মেয়ের যে সব স্বাধীনতা থাকে, তা থেকে গত আট বছর নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। ফাস্ট ফুড খাইনি। সময় নষ্ট করিনি। বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে ইচ্ছে হত খুব। ঘুমোইনি। সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ হল, নিজের পরিবারের সঙ্গে গত আট বছর সে’ভাবে সময় কাটাতে পারিনি। মা-বাবার লড়াই দূর থেকে দেখেছি। পাশে থাকতে পারিনি। মায়ের অপারেশনের দিন থাকতে পারিনি। শুধু একটা স্বপ্নের পিছনে দৌড়েছি। সেই স্বপ্নটা আগে আমার নিজের ছিল। কিন্তু টোকিয়োয় পা দিয়ে বুঝতে পারছিলাম আমার একটা পদক গোটা দেশের স্বপ্ন হয়ে উঠেছে।
প্রশিক্ষণের এত গুলো বছর ধরে সব রকম আবেগকে দমন করে চলেছি। কিন্তু অলিম্পিক্সে নেমে দেশের মানুষের যে সমর্থন, ভালবাসা অনুভব করছিলাম, তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। কোয়ার্টার ফাইনালে জয়ের পরের চিৎকারের ভিতর দিয়ে সেই সব অনুভূতি বেরিয়ে আসতে চাইছিল। মেডেলটা পাওয়ার পরে দু’দিন গলা থেকে খুলিনি। রাতেও গলায় পরেই শুয়েছিলাম।
স্বাধীনতা দিবসের আগে দেশের জন্য অলিম্পিক্স ব্রোঞ্জ আর আমার রাজ্যের জন্য প্রথম অলিম্পিক্স মেডেল এনে দিতে পেরে ভাল লাগছে। আগেও আন্তর্জাতিক পদক জিতেছি। কিন্তু অলিম্পিক্সের ব্রোঞ্জ জীবনটাই বদলে দিয়েছে। অবশ্য আমি বদলাব না। শুধু আমার মেডেলের রং বদলাবে। প্যারিসে।
এই যে মেডেল জেতায় বিখ্যাত হয়েছি, প্রধানমন্ত্রী দেখা করবেন, কিন্তু আসল সত্যিটা হল, একুশ শতকেও মেয়ে জন্মালে এখনও মানুষ মুখ বেঁকায়। বাড়িতে তিন মেয়ে বলে লোকে তো কম কথা শোনায়নি। মা বলেছিলেন, এমন কিছু করবি যাতে বড় মুখ করে বলতে পারি। বাবা-মায়ের ছেলের অভাব প্রতি পদে পূরণ করেছিলাম। বাড়িতে খেতে আনাজ ফলাতাম। আনাজ বিক্রি করতে বাজারে যেতাম বাইক চালিয়ে।
আমার মতে, মেয়েরা অনেক সময় নিজেরাই নিজেদের দাবিয়ে রাখে। ধরেই নেয় যে একটা পর্যায়ের বেশি তাদের ওঠার অধিকার নেই। সেই আত্মবিশ্বাসের অভাবটাই কাটিয়ে উঠতে হবে। আজ আমরা তিন বোনই দেশের জন্য কাজ করছি। দিদি লিসা ও লিমা সিআইএসএফ এবং বিএসএফে রয়েছে। আর আমি বক্সিং রিঙে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চেষ্টা করছি।
একটা ভাঙাচোরা, কাদামাখা রাস্তা পার হয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়েছিলাম। এ বার যখন ফিরছি, তখন কুচকুচে কালো পিচ রাস্তায় ঝকঝকে একরাশ মুখ আমায় স্বাগত জানাচ্ছে। উড়ছে ফুলের পাপড়ি, উড়ছে পতাকা। শুনেছি, ঘরে-ঘরে পৌঁছে যাবে পাইপলাইনের পরিষ্কার জলও। অদূরে তৈরি হচ্ছে ক্রীড়া প্রকল্প! আমার স্বাধীনতা তো এটাই। আরও ভাল লাগবে যদি আশপাশের সব গ্রামের লাভলিনারাও এমন ভাবেই পিচের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতে পারে।
উত্তর-পূর্ব তার আগের পরিচয় ঝেড়ে ফেলে ক্রীড়া-হাব হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। কিন্তু খেলার পরিকাঠামো সবই শহরকেন্দ্রিক। কোনও এক হিমা দাস বা লাভলিনার পদক জেতার অপেক্ষায় না থেকে ছোট ছোট ক্রীড়াকেন্দ্র হলে আরও অনেক প্রতিভা বেরিয়ে আসবে।
মায়ের সঙ্গে দেখা হতে এখনও দিন কয়েক দেরি। শান্তিতে, বাড়িতে মায়ের কাছে বসে ঘরের খাবার খেতে চাই। ছোটবেলায় কষ্টের দিনেও জিভে জল আনা কচু পিটিকা দিয়ে এক থালা ভাত সাবাড় হয়ে যেত। মাকে বলেছি, “বাড়ি ফিরে তোমার বিকু সবার আগে সেই কচু পিটিকাই খাবে।”
অনুলিখন: রাজীবাক্ষ রক্ষিত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy