Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

যন্ত্রণা সয়েও শেষ বলে ভারতকে এশিয়া কাপ এনে দিলেন কেদার

এশিয়া কাপ ফাইনালের সাত ঘণ্টা পেন্ডুলামের মতো এ দিক, ও দিক দুলেছে। বাংলাদেশ বিনা উইকেটে ১২০। ভারতীয় দর্শকদের গলার আওয়াজকে ছাপিয়ে শোনা গিয়েছে ‘এগিয়ে চলো বাংলাদেশ।’

বিজয়ী: বাংলাদেশকে রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে তিন উইকেটে হারিয়ে সপ্তম বার এশিয়া কাপ জয় ভারতের। জয় এল একেবারে শেষ ওভারের শেষ বলে। জেতার পরে ট্রফি নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটারদের উল্লাস। ছবিতে ট্রফি ধরে আছেন নবাগত খলিল আহমেদ। ছবি: এএফপি।

বিজয়ী: বাংলাদেশকে রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে তিন উইকেটে হারিয়ে সপ্তম বার এশিয়া কাপ জয় ভারতের। জয় এল একেবারে শেষ ওভারের শেষ বলে। জেতার পরে ট্রফি নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটারদের উল্লাস। ছবিতে ট্রফি ধরে আছেন নবাগত খলিল আহমেদ। ছবি: এএফপি।

কৌশিক দাশ
দুবাই শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:৩৪
Share: Save:

মরুভূমির অন্ধকার আকাশকে আলোয় ভরিয়ে দিয়ে ফাটছে একের পর এক আতসবাজি। অবিশ্বাস্য একটা ম্যাচের সাক্ষী থেকে গ্যালারি কোথাও গর্জন করছে, কোথাও স্তব্ধ হয়ে আছে।

শেষ ওভারে ভারতের দরকার ছিল ছয় রান। হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পাওয়া কেদার যাদব তখন আবার নেমেছেন। সঙ্গী কুলদীপ যাদব। চাই পাঁচ বলে পাঁচ। তিন বলে দুই। এবং এক বলে এক। আবার একটা টাইয়ের সম্ভাবনা তখন সামনে চলে এসেছে। মাহমুদুল্লার করা ওই শেষ বলটা কেদারের প্যাড ছুঁয়ে চলে গেল ফাইন লেগে। সঙ্গে সঙ্গে মরুশহরে এশিয়া সেরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হল ভারতীয় ক্রিকেট। মরুভূমির বুকে প্রায় নতুন এক আরব্যরজনী লিখে ফেলা এগারো বাঙালি তখন বিধ্বস্ত। কারও মুখের হাসিটা টিভি-তে তখন খুবই করুণ দেখাচ্ছিল।

একটা ড্রেসিংরুমে আবেগের বিস্ফোরণ। অন্য ড্রেসিংরুম ডুবে শোকে, অন্ধকারে। ঠিক এখান থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের একটা স্টেডিয়ামের মতো। যার নাম শারজা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। সে তো আজ স্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া অবস্থায় দেখল, ক্রিকেট কৌলীন্যের ব্যাটন ধীরে ধীরে হাত বদল হচ্ছে। দুবাইয়ে ঐশ্বর্য আছে, কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাসের যে বড় অভাব। কিন্তু শুক্রবারের এই ফাইনালের পরে কি শারজার প্রতিবেশীও বলতে পারবে না, আমরাই বা কম কী।

অদম্য: হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল ইনিংসের মাঝপথে। ফিরে এসে সেই কেদার যাদবই জেতালেন এশিয়া কাপ। ছবি: এপি।

একটা ম্যাচে কম ঘাত-প্রতিঘাত তো দেখা গেল না। কোথাও যন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করে, জীবনকে বাজি রেখে মাঠে নেমে পড়া। কোথাও প্রতিযোগিতার সেরা ম্যাচেই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া। কোথাও হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট অগ্রাহ্য করে দলের স্বার্থে নিজেকে তুচ্ছ করা। যেমন মাশরফি মর্তুজা, যেমন লিটন দাস, যেমন কেদার যাদব।

এশিয়া কাপ ফাইনালের সাত ঘণ্টা পেন্ডুলামের মতো এ দিক, ও দিক দুলেছে। বাংলাদেশ বিনা উইকেটে ১২০। ভারতীয় দর্শকদের গলার আওয়াজকে ছাপিয়ে শোনা গিয়েছে ‘এগিয়ে চলো বাংলাদেশ।’ আবার দশ ওভারের মধ্যে মর্তুজাদের চার উইকেটের পতন, গ্যালারিতে স্লোগান— ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা।’ রোহিত মেরেছেন, ভারতীয়রা গর্জেছেন। ধোনি আউট, বাংলার বাঘের হুঙ্কার শোনা গিয়েছে। রাতের মরুভূমিতে আবেগের রামধনু খেলা করেছে গ্যালারিতে।

প্রেস বক্সেও কি একটু বিভাজন দেখা যায়নি? সম্ভবত গিয়েছে! শারজায় প্রথম এশিয়া কাপে তাঁর অধিনায়ক সুনীল গাওস্করের হাতে ট্রফি তুলে দিয়েছিলেন সুরিন্দর খন্না। সে দিনের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিতে ডুব দেন সুরিন্দর। ‘‘পাকিস্তানের বোলিংটা খুব ভাল ছিল। সরফরাজ নওয়াজ, আব্দুল কাদির। উইকেট ব্যাটিংয়ের পক্ষে ভাল ছিল না। ওপেন করতে নেমে ঠিক করি, দলকে ভাল জায়গায় পৌঁছে দিতেই হবে,’’ ফোনে সে বারের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের গলাটা কেমন যেন আবেগপ্রবণ শোনায়।

চৌত্রিশ বছর পরে আরও একবার এশিয়ার তাজ দখলে নামার সময় রোহিত শর্মার মনেও কি সে রকম কোনও শপথ ছিল না? বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাট করে থেমে গিয়েছে ২২২ রানে। রোহিতও কি ভাবেননি, ম্যাচটা শেষ করেই ফিরবেন? রোহিত ব্যাটে শুরু করেও শেষ করতে পারেননি। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে একটা মাস্টারস্ট্রোক নেন। চোট পাওয়া কেদারকে তুলে নিয়ে। কেদার দৌড়তে না পারায় খুচরো রান আটকে যাচ্ছিল। ভুবনেশ্বর কুমার নামতে সে সমস্যা আর হয়নি। বাংলাদেশ ইনিংসে প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দু’উইকেট। ব্যাট করতে নেমে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে উঠে যাওয়া। রবীন্দ্র জাডেজা আউট হওয়ার পরে ফের নামা। তবে কেদারের কাছে এটা নতুন নয়। শেষ আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে একই ভাবে চোট পেয়ে উঠে গিয়েছিলেন। আবার ফিরে এসে শেষ ওভারে চেন্নাই সুপার কিংসকে ম্যাচ জেতান কেদার। ঠিক যেমন এ দিন ভারতকে জেতালেন। সংখ্যার বিচারে কেদারের অবদান হয়তো বিশাল নয়, কিন্তু সে দিনের সুরিন্দরের মতো এ দিন তিনিই রোহিতকে ট্রফিটা তুলে দিলেন। শারজা ক্রিকেটের প্রাণপুরুষ আব্দুল রহমান বুখাতির এখন আর বেশি প্রকাশ্যে আসেন না। না এলেও বুখাতির নিশ্চয়ই দেখছেন, একটা মাঠ থেকে আর একটা মাঠে কী ভাবে কৌলীন্যের ব্যাটন বদল হচ্ছে। এই মহানাটকীয় ফাইনাল সেই ছবিটাই তুলে ধরল। যে ছেলেটা এ দিন ভারতীয় বোলারদের দিশাহারা করে দিলেন, তাঁর এত দিন সর্বোচ্চ রান ছিল ৪১! লিটন দাসের (১১৭ বলে ১২১) নাম বাংলাদেশের বাইরে ক’টা লোক জানত? এখন জানবে। জানবে এক বাঙালি ছেলে আসল ম্যাচটাই বেছে নিয়েছিলেন নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। ছিল, ফেভারিটদের ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য আন্ডারডগদের মরিয়া চেষ্টা। যে চেষ্টার আঁচ পাওয়া গিয়েছে ফাইনালের ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশের হোটেলে গিয়ে। দেখা গিয়েছে, ডান হাতের কড়ে আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘুরছেন অধিনায়ক মর্তুজা। আঙুলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। ব্যথা কমানোর ওষুধকে অস্ত্র করে লড়াই চালিয়েছেন। মুশফিকুর রহিমকে টিভি-তে কিপিং করতে দেখছে সবাই। কিন্তু কেউ জানে না, ওই সবুজ শার্টের তলায় তাঁর বুক পুরো স্ট্র্যাপে জড়ানো। পাঁজরে ব্যথা নিয়ে খেলে চলেছেন তিনি।

আর কেদার যাদব বোধহয় আবার কিছু দিনের জন্য ছিটকে গেলেন ক্রিকেট থেকে। এ তো ইতিহাসেরই অঙ্গ হয়ে যাওয়ার মতো কাহিনি। এ তো দুবাই ক্রিকেটকে কৌলীন্য দেওয়ারই রূপকথা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE