Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Anustup Majumdar

সেই বিপর্যয়, সেই এক ত্রাতা

ক্লাব হাউসের দু’পাশের গ্যালারি প্রায় ভর্তি। পোস্টার, ফেস্টুন নিয়ে মাঠে হাজির ক্রিকেটপ্রেমীরা। স্লোগান ধেয়ে আসছে, ‘‘বেঙ্গল... বেঙ্গল...।’’

নায়ক: সেঞ্চুরি করে উচ্ছ্বাস অনুষ্টুপের। ইডেনে শনিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

নায়ক: সেঞ্চুরি করে উচ্ছ্বাস অনুষ্টুপের। ইডেনে শনিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২০ ০৪:১২
Share: Save:

রঞ্জি ট্রফি ক’জন দেখেন? ক’জনই বা জানেন ইডেনে ম্যাচ চলছে? এ ধরনের বহু মন্তব্য শোনা যায় কোনও এক আড্ডার আসরে। শনিবারের ইডেন এ ধরনের প্রশ্ন ও ধারণার যোগ্য জবাব।

ক্লাব হাউসের দু’পাশের গ্যালারি প্রায় ভর্তি। পোস্টার, ফেস্টুন নিয়ে মাঠে হাজির ক্রিকেটপ্রেমীরা। স্লোগান ধেয়ে আসছে, ‘‘বেঙ্গল... বেঙ্গল...।’’ এই পরিস্থিতির মধ্যে বর্তমান বাংলা দলের অনেকেরই খেলার অভিজ্ঞতা নেই। গ্যালারিশূন্য মাঠে তাঁদের ইতিহাস গড়া মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে পারেন না অনেকেই। কিন্তু শনিবারের ইডেন দেখতে পেল এক অভিজ্ঞ সৈনিকের হার-না-মানা লড়াই। যাঁকে কঠিন পরিস্থিতি আরও কঠোর করে তোলে। দায়িত্ব নিয়ে দলকে ম্যাচে ফেরানোই যাঁর নতুন স্বভাব। তিনি অনুষ্টুপ মজুমদার।

৬৭ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে বাংলার উপরের সারির ব্যাটসম্যানেরা যখন প্যাভিলিয়নে বসে নিজেদের আউটের অজুহাত খুঁজতে ব্যস্ত, তাঁদের ব্যর্থতা কাঁধে নিয়ে একা কুম্ভ হয়ে সেঞ্চুরি করে মাঠ ছেড়ে বেরোলেন অনুষ্টুপ। তাঁকে এখনও আউট করতে পারেনি রঞ্জি ট্রফির সেরা বোলিং আক্রমণ। দিনের শেষে ৯ উইকেট হারিয়ে বাংলার রান ২৭৫। অনুষ্টুপ অপরাজিত ১২০ রানে। রঞ্জি মরসুমে ৫৭১ রান হয়ে গেল তাঁর। সঙ্গ দিচ্ছেন ঈশান পোড়েল (০)।

কর্নাটকের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের সকালে এক অদ্ভুত ঘটনা দলের মনোবলে বেশ আঘাত করে। ঝাঁপিয়ে ক্যাচ নিতে গিয়ে কাঁধে চোট পান ওপেনার কৌশিক ঘোষ। প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে প্রথম একাদশে নেওয়ার সময়ও ছিল না। তাই কৌশিকের পরিবর্তে প্রত্যাবর্তন ঘটে সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের। দিনের দ্বিতীয় ধাক্কা, টসে হার। ঘাসের হাল্কা স্তরে ঢাকা পিচে সকালে ব্যাট করতে হয় বাংলাকে। তিন নম্বরে ব্যাট করার পরিকল্পনা বদলে অভিষেক রামনের সঙ্গে ওপেন করতে বাধ্য হন অধিনায়ক অভিমন্যু ঈশ্বরন। কিন্তু প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ, অভিমন্যু মিঠুনের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই নড়বড়ে দেখাচ্ছিল তাঁদের। ১৭ রানের মধ্যে দুই ওপেনার উইকেট ছুড়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান। রামন যদিও ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিলেন। রঞ্জি ইতিহাসে প্রথম ডিআরএস-এর ব্যবহারে আউট হন তিনি। সুদীপ ও অর্ণব নন্দীর চেষ্টাও যায় বিফলে। ধৈর্য হারিয়ে কৃষ্ণাপ্পা গৌতমের বল মিড-অফের উপর দিয়ে মারার পরিকল্পনায় ব্যর্থ মনোজ তিওয়ারি। কে এল রাহুলের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান আট রান করে।

দলের স্কোর যখন ৬২-৪। ক্রিজে আসেন অনুষ্টুপ। তাঁকে দেখে মনেই হয়নি, পিচে কোনও জুজু আছে। অথচ উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে একের পর এক বলে পরাস্ত হয়ে চাপ সৃষ্টি করেন সুদীপ। ৪১তম বলে প্রথম রান নেন। তাঁর ইনিংসের প্রথম বাউন্ডারি আসে ৭১তম বলে। শেষমেশ ৮৩ বলে ২০ রান করে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান এক সময়ের সহ-অধিনায়ক। উইকেটকিপার শ্রীবৎস গোস্বামীও শূন্য রানে প্যাভিলিয়নমুখী হন। সেখান থেকেই শুরু হয় দুই যোদ্ধার অদম্য লড়াই। প্রতিআক্রমণ শুরু করেন শাহবাজ। ঢাল হয়ে দাঁড়ান অনুষ্টুপ। এক সময় ডেনিস লিলি, জেফ থমসনের রূপ ধারণ করা প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ ও অভিমন্যু মিঠুন মুহূর্তের মধ্যে নির্বিষ হয়ে যান। যে উইকেট দেখে এক সময় মনে হচ্ছিল ক্রাইস্টচার্চ, নিমেষে তা ওয়াংখেড়ের ব্যাটিং সহায়ক পিচে পরিণত হয়।

শাহবাজ যদিও দিনের সেরা বলের শিকার। মিঠুনের ভিতরে আসা বল পিচে পড়ে দিক পরিবর্তন করে স্টাম্পে আছড়ে পড়ে তরুণ ব্যাটসম্যানের। ৫০ বলে ৩৫ রান করে ফিরে যান শাহবাজ। ৭২ রানের জুটি ভেঙে যাওয়ার পরে কেউই আশা করেননি, এই দল ২৫০ পেরোবে। ধারাভাষ্যকার রোহন গাওস্কর আলোচনা করছিলেন, ‘‘কর্নাটকের বিরুদ্ধে এই পরিস্থিতি থেকে ফেরা কঠিন।’’ প্রত্যেকের ধারণা বদলে জীবনের সেরা ইনিংস উপহার দেন আকাশ দীপ। অনূর্ধ্ব-১৫ বিভাগে যে তিনি ওপেন করতেন, এই তথ্য হয়তো জানা ছিল না মিঠুনদের। আকাশকে হয়তো হাল্কা ভাবে নিয়ে ফেলেছিলেন কে এল রাহুলরা। অনুষ্টুপের নির্দেশ মেনে ক্রিজ কামড়ে পড়েছিলেন আকাশ। সপ্তম উইকেটে ১০৩ রানের জুটি গড়ে ম্যাচের রং পাল্টে দিয়ে গেলেন। ৪৪ রানের মাথায় কৃষ্ণাপ্পা গৌতমকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে ফিরতে না হলে আরও ভাল জায়গায় থাকত বাংলা।

আকাশ আউট হওয়ার সময় অনুষ্টুপের রান ৯৫। আগে তিন বার ৯০-এর ঘরে আউট হয়েছেন। এ বছরই দিল্লির বিরুদ্ধে ৯৯ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন। অনুষ্টুপকে চাপে পড়ে যেতে দেখে স্লোগান ওঠে গ্যালারিতে। ‘‘অনুষ্টুপ... অনুষ্ঠুপ...’’ ধ্বনিতে গর্জে ওঠে ইডেন। সমর্থকদের এই উৎসাহই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের অষ্টম সেঞ্চুরি পেতে সাহায্য করে তাঁকে। ৮০তম ওভারে মিঠুনকে পুল করে ৯৯ থেকে ১০৩ রানে পৌঁছন অনুষ্টুপ। গ্যালারিতে বসে সেই ইনিংসের সাক্ষী তাঁর বাবা। সেঞ্চুরি করে ইডেনের বাইশ গজের মাটি হাতে তুলে ঠোঁটে ছোঁয়ালেন। অনেকেই বলবেন, সংস্কার। কিন্তু এটাই ক্রিকেটের প্রতি শ্রদ্ধা। যে পিচ তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্তের সাক্ষী, তাকে কুর্নিশ জানানোর এটাই তো ছিল সেরা মুহূর্ত।

বাংলা যদিও এখনও স্বস্তিতে নেই। উইকেট অনেকটাই প্রাণ হারিয়েছে। বল দ্রুত ব্যাটে আসছে। এ ধরনের পিচ কে এল রাহুল, মণীশ পাণ্ডেদের জন্য আদর্শ। এমনকি ব্যাটসম্যানের কাছে রান করার আদর্শ ম্যাচের দ্বিতীয় দিন। কিন্তু এই বাংলাও চমক দিতে জানে। বড় নামের ভয় দেখিয়ে তাদের কি আটকে রাখা যায়?

অন্য বিষয়গুলি:

Anustup Majumdar Ranji
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy