Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
এ যুগের সেরা স্টেন, একান্ত সাক্ষাৎকারে মাইকেল হোল্ডিং

‘শ্রেষ্ঠ হতে গেলে সব দেশেই জিততে হবে’

রবিবার বৃষ্টিভেজা নিউল্যান্ডস মাঠে কমেন্ট্রি বক্স থেকে বেরিয়ে এসে সময় দিলেন আনন্দবাজার-কে। তাঁর কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এখনও যেন সেই বিধ্বংসী পেসারই আছেন মাইকেল হোল্ডিং।

রবিবার বৃষ্টিভেজা নিউল্যান্ডসে হোল্ডিং। নিজস্ব চিত্র

রবিবার বৃষ্টিভেজা নিউল্যান্ডসে হোল্ডিং। নিজস্ব চিত্র

সুমিত ঘোষ
কেপ টাউন শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:১৭
Share: Save:

এত নিঃশব্দে বোলিং রান-আপ ধরে দৌড়ে আসতেন যে, কেউ বুঝতেও পারত না কখন বোলিং ক্রিজের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। আম্পায়ার ডিকি বার্ড একবার ঘাড় ঘুরিয়ে হঠাৎ দেখেন, বোলার এসে গিয়েছে। তড়িঘড়ি মাথা ঘুরিয়ে ফের ব্যাটসম্যানের দিকে তাকাতে হয় বার্ড-কে। তার পরে কিংবদন্তি আম্পায়ারই নামকরণ করেন ‘হুইসপারিং ডেথ্’। যাঁর ৬০ টেস্টে ২৪৯ উইকেট। গড় ২৩.৬৮। ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা সেই ছন্দময় পেসার রবিবার বৃষ্টিভেজা নিউল্যান্ডস মাঠে কমেন্ট্রি বক্স থেকে বেরিয়ে এসে সময় দিলেন আনন্দবাজার-কে। তাঁর কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এখনও যেন সেই বিধ্বংসী পেসারই আছেন মাইকেল হোল্ডিং। ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা বা প্রশাসকদের তোয়াজ করার কোনও ব্যাপারই নেই। যা মনে করেন, বিশ্বাস করেন, তা-ই খুল্লমখুল্লা বলে দিতে থাকলেন।

প্রশ্ন: প্রথম দু’দিন ভারতের পারফরম্যান্স দেখে কী বলবেন?

মাইকেল হোল্ডিং: ভারত ভাল টিম, সেটা সবাই জানে। কিন্তু ‘গ্রেট টিম’ হতে গেলে সব জায়গায় ভাল খেলার অভ্যেস তৈরি করতে হবে। দেশে, বিদেশে সব জায়গায়। সেটা মনে হল প্রথম দু’দিনে ধাক্কা খেয়েছে।

প্র: এখন এটাই যেন ক্রিকেটের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে যার নিজেদের দেশে কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে। আপনি কি একমত হবেন?

হোল্ডিং: একমত বলেই তো শুরুতেই বললাম যে, ‘গ্রেট টিম’ হতে গেলে সব দেশে গিয়ে জিততে হবে। না হলে ভাল দলের আখ্যাই পাবে বড়জোর। এই মুহূর্তে সে রকম কোনও ‘গ্রেট টিম’ দেখছি না। যারা সব দেশে গিয়ে শাসন করতে পারে।

প্র: স্বর্ণযুগের ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম সেটাই করত। ভারতের স্পিন-বন্ধু পিচে এসেও শাসন করে গিয়েছে ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারি।

হোল্ডিং (হাসি): ইতিহাস এবং রেকর্ড তো সে রকমই বলে বোধ হয়।

প্র: যদি নিজেদের আধিপত্যের কথা নিজে মুখে বলতে না-ও চান, এটা অন্তত জিজ্ঞেস করতে চাই যে, এই নিজেদের দেশে দাপট দেখানোকে আপনি কী চোখে দেখেন?

হোল্ডিং: মাঝে-মধ্যে খুব বিরক্তিকর হয়ে যায়। ঘরের মাঠে টিম ডেকে এনে তাদের হারাচ্ছি— এর মধ্যে আর কী বীরত্ব আছে? সব দেশই তো এখন তা-ই করছে। শুধু ভারতের কথা উঠবে কেন, সব দেশের অবস্থাই তো সে রকম। যে যার নিজের দেশে জিতছে। ওখানেই ‘গুড’ আর ‘গ্রেট’-এর তফাত। আমরা খেলার সময় লক্ষ্য স্থির করেছিলান, সব দেশে গিয়ে জিতব। জানতাম, সেটা পারলে তবেই আমাদের টিম শ্রেষ্ঠ আখ্যা পাবে।

প্র: ভারতের এই দলটাকে অনেকে ভাল বলছে। তাদের ‘গ্রেট’ হতে গেলে কী করতে হবে?

হোল্ডিং: পরিষ্কার কথা— দেশের বাইরে গিয়ে জিততে হবে। ওদের তো এখন এক বছর ধরে বেশির ভাগ ক্রিকেটই খেলতে হবে বিদেশে। এই সময়টাকে ওদের কাজে লাগিয়ে সব জায়গায় জিততে পারলে তবেই ‘গুড’ থেকে ‘গ্রেট’ হতে পারবে ওরা।

প্র: ভারতীয় দলকে কোথায় উন্নতি করতে হবে বলে আপনার মনে হয়?

হোল্ডিং: ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই উন্নতি করা দরকার। বিদেশের মাঠেও ভারতের ব্যাটসম্যানদের রান করতে হবে। তবেই কিন্তু ওরা সেরা হিসেবে গণ্য হবে। তেমনই বোলারদেরও বিদেশের পরিবেশ কাজে লাগানোর কায়দাটা জানতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে যদি পেসাররা উইকেট না তুলতে পারে, তা হলে কোথায় পারবে? ভুবনেশ্বর কুমার ছাড়া কোনও ভারতীয় পেসারকে দেখে তো মনে হল না, ওরা প্রতিপক্ষের ত্রাস হয়ে উঠতে পারে। শামি ভাল বোলার। গতি আছে, সুইং আছে। কিন্তু উইকেটও তো তুলতে হবে। বিদেশে এসেও যদি উইকেট নেওয়ার জন্য স্পিনারদের উপরই নির্ভর করতে হয়, সেটা পেস বিভাগের পক্ষে খুব ভাল বিজ্ঞাপন নয় নিশ্চয়ই। আমার তো মনে হয়, এখানেও দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট তোলার জন্য অশ্বিনের উপর নির্ভর করতে হবে ভারতকে।

প্র: আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, ভারতের থেকে আরও অনেক ভাল পারফরম্যান্স আশা করেছিলেন?

হোল্ডিং: এখানে কিন্তু ভারতের হাতে দু’টো সুবিধে তুলে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। একে তো পিচটা যা দিয়েছে, খুব ফাস্ট বা বাউন্সি বলা যাচ্ছে না। তার উপর টস জিতে ওরা নিজেরা ব্যাটিং করল। গুলিয়েই যাচ্ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা কি নিজেদের দেশে খেলছে? চার ফাস্ট বোলারে খেলছে? এখানে যদি ডেল স্টেন-রা আগে বল করত, ভারতের ব্যাটসম্যানদের আরও সমস্যায় ফেলতে পারত। সেটা কেন করতে চাইল না, কে জানে। যাই হোক, সেই সুবিধেটা পেয়ে ভারতীয় দল কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে, সে রকমই তো সকলে আশা করেছিলাম, তাই না? সেটা ওরা করতে পারল কোথায়!

প্র: এ যুগের ফাস্ট বোলারদের মধ্যে আপনার সবচেয়ে প্রিয় কে?

হোল্ডিং: ডেল স্টেন। খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, আবার চোট পেয়ে ছিটকে গেল সিরিজ থেকে। আমার মতে, এ যুগের সেরা ফাস্ট বোলার স্টেন। যেমন গতি, তেমন সুইং, তেমনই বৈচিত্র, তেমনই আগ্রাসী শরীরী ভাষা। ওকে দেখে আমার সত্যিকারের ফাস্ট বোলার মনে হয়। যদি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিই না থাকে, তাকে কী করে ফাস্ট বোলার বলব!

প্র: এখনকার ক্রিকেটারদের এত বেশি চোট-আঘাতের কারণ কী?

হোল্ডিং: অতিরিক্ত ক্রিকেট! বড্ড বেশি খেলা হচ্ছে। প্রশাসকদের তো সে সব নিয়ে ভাবারই সময় নেই দেখছি। যে কারও যে কোনও সময় ব্রেকডাউন হতে পারে। আর স্টেনের সমস্যা হচ্ছে, কাঁধের অস্ত্রোপচার হওয়ায় দীর্ঘ সময় বাইরে থাকতে হয়েছে। এত দিন বাইরে থাকার পরে ফিরে আসার সময়টায় ঝুঁকি থাকেই। বেচারা, আবার চোট পেয়ে গেল!

প্র: কিন্তু এখনকার ক্রিকেটারেরা তো ফিটনেস চর্চাও অনেক বেশি করেন। তাঁরা নিয়মিত জিমে যাচ্ছেন, ওয়েট ট্রেনিং করছেন। পাওয়ারলিফটিং পর্যন্ত করেন।

হোল্ডিং (থামিয়ে দিয়ে): হ্যালো, জিমে আমরাও যেতাম। শক্তিশালী না হলে জোরে বল করা যায় না। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, আমার কোনও অ্যাটলাস হওয়ার দরকার নেই যে, পৃথিবীকে কাঁধে নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। আমাকে ফাস্ট বোলার হতে হবে, ফাস্ট বোলারের স্কিল থাকাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গা, হাত-পা ফুলিয়ে বডিবিল্ডার হয়ে তো লাভ নেই, শক্তিশালী হলেই চলবে।

প্র: ফাস্ট বোলারের সেই স্কিল হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?

হোল্ডিং: আমি বলতে চাই না, স্কিল হারিয়ে গিয়েছে। কী দরকার? লোকে বলবে, আমি নিজের যুগকে আঁকড়ে ধরে বসে আছি। বলবে, অন্য প্রজন্মকে সহ্য করতে পারছি না। আমি তাই আমাদের সময়ের সঙ্গে অন্য সময়ের তুলনায় যেতে চাই না।

প্র: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে বাড়তে থাকা উৎসাহ কেমন লাগে?

হোল্ডিং: ধুর, টি-টোয়েন্টি কোনও খেলাই নয়। আমার মনে হয়, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলাটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আইসিসি-র উচিত সাবধানতা নেওয়া। প্রশাসকেরা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকে, তা হলে কী আর হবে?

প্র: কিন্তু টি-টোয়েন্টি যে লোকে বেশি করে দেখতে চাইছে। আর ক্রিকেটে টাকাও আনছে টি-টোয়েন্টি।

হোল্ডিং: লোকে তো কাল এটাও বলতে পারে যে, নিউল্যান্ডসে আর টেস্ট ম্যাচটার দরকার নেই। দু’দলের মধ্যে টি-টোয়েন্টি খেলিয়ে দাও। সেটা কি শোনা হবে? তা হলে আর প্রশাসকদের দরকার কী আছে?

প্র: আচ্ছা, এই যে গোলাপি বলে দিন-রাতের টেস্ট করার কথা হচ্ছে বা চার দিনের টেস্ট শুরু করে দেওয়া হয়েছে পরীক্ষামূলক ভাবে, সেটা নিয়ে আপনার মত কী?

হোল্ডিং: রাবিশ! টি-টোয়েন্টি নামে কী একটা ছেলেখেলা তো শুরু করেছে প্রশাসকগুলো। গোলাপি বলে দিন-রাতের তামাশাটা ওই খেলাটার জন্যই রেখে দিক না! টেস্ট ক্রিকেট বলতে আমি বুঝি সকাল সাড়ে ন’টায় শুরু, সাদা জামাকাপড়, লাল বল। এর পর তো ওরা বলবে, তিন স্লিপ আর দুই গালি নিয়েও ফাস্ট বোলার বল করতে পারবে না। টেস্ট ক্রিকেটকে পরিহাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনছে একদম। আর যুক্তি দিচ্ছে, দর্শক নাকি এই বদলটা চাইছে। ওদের কে বলল? এই তো নিউল্যান্ডসে সাদা পোশাকে, লাল বলের টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে। সকাল বেলায় শুরু হচ্ছে। লোকে আসেনি? সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। হাউসফুল মাঠ ছিল দু’দিনই। আজকেও খেলা হচ্ছে না কিন্তু মাঠে প্রচুর লোক। বৃষ্টির মধ্যেও তারা মাঠ ছেড়ে যায়নি টেস্ট ক্রিকেট দেখবে বলে। তা হলে প্রশাসকগুলো উল্টোপাল্টা বকে যাচ্ছে কেন!

প্র: হার্দিক পাণ্ড্য-কে কেমন লাগল আপনার?

হোল্ডিং: ছেলেটার মনোভাবটা দারুণ লেগেছে। আগ্রাসী ক্রিকেট খেলে গেল। ওর দলের ঠিক সেটাই দরকার ছিল। দেখাল, প্রবল চাপের মুখে দুঃসাহসিক হতে পারে। এই সাহসটা দেখাতে পারলে কিন্তু ও অনেক দূর যাবে, অনেক যুদ্ধ জিতবে। খুব ডাকাবুকো একটা ইনিংস খেলে দলকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাল। বাহবা জানাতেই হবে ছেলেটাকে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE