দেশের ভরসা আজিজি।
প্রতিটি ম্যাচে মাঠে নামার ঠিক আগে প্রয়াত বাবাকে আকাশে খোঁজেন আফগানিস্তানের গোলকিপার উভাইস আজিজি। বাবার উদ্দেশে শূন্যে চুম্বন ছুড়ে দিয়ে তবেই নিজের গোললাইনে গিয়ে দাঁড়ান ৬ ফুট ২ ইঞ্চির আফগান গোলকিপার। ১৪ নভেম্বর ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচের ঠিক আগেও একই ছবির পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে তাজিকিস্তানের মাঠে।
আজিজির জীবনে এই মেঘ তো এই রোদ! সেই কোন ছোটবেলায় আফগান গৃহযুদ্ধে বাবাকে হারিয়েছেন। তার পর কখনও ইরান, কখনও ডেনমার্কে শরণার্থী হিসেবে দিন কাটিয়েছেন। ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে আফগানিস্তানের জাতীয় দলের গোলকিপার আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘আমি তখন খুব ছোট। সেই সময়ে আমার বাবা গৃহযুদ্ধে মারা যান। সেই ঘটনা আমি আর মনে করতে চাই না। খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমাদের পরিবারকে যেতে হয়েছিল। পাঁচ ভাইবোনকে নিয়ে মা দেশ ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে চলে যান ইরানে। সেখানে কয়েক দিন থাকার পরে ডেনমার্কে চলে আসি। ডেনমার্কেই আমার বেড়ে ওঠা। সেখানেই পড়াশোনা, ফুটবলের হাতেখড়ি। ডেনমার্কের মানুষ আমাকে আপন করে নিয়েছেন। কিন্তু, দেশের কথা ভাবতে বসলে অন্যরকমের একটা অনুভূতি কাজ করে। আমার যুদ্ধবিধ্বস্ত, অশান্ত দেশের দিকে তাকালে অদ্ভুত একটা ভাল লাগা কাজ করে।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন মলদ্বীপের মাজিয়া ক্লাবে খেলা গোলকিপার।
গুগল সার্চ ইঞ্জিনে আফগানিস্তান নামটা ফেললেই বেরিয়ে আসে বোমা হামলা, গোলাগুলি, হতাহতের খবর। মোরগের ডাকে নয়, সকালে মানুষের ঘুম ভাঙে বোমা-গুলির শব্দে। এ রকম এক দেশের বারের নীচে দাঁড়িয়ে সতীর্থদের নির্ভরতা দিচ্ছেন আজিজি। বলছিলেন, “আমার দেশে নিরাপত্তা কোথায়? সবার মা-বাবাই চান তাঁদের সন্তানরা যেন ভাল থাকে। এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে সেই পরিস্থিতি নেই। দেশের বেশির ভাগ ফুটবলার ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন ক্লাবে খেলছে। দেশের ফুটবল লিগের কাঠামোও শক্তিশালী নয়। ৬-৭ মাস লিগ চললেও নিয়মিত ম্যাচ নেই, নিয়মিত ট্রেনিং নেই। সেই কারণেই দেশের বাইরের ক্লাবে খেলাটাই ভাল। বাইরের ক্লাবে খেলেই দেশের হয়ে নামার প্রস্তুতি নিয়ে থাকি আমরা।’’
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টা আগেও জানতেন না টেস্ট খেলবেন! রূপকথার অভিষেক শাহবাজ নাদিমের
বিশ্বকাপের যোগ্যতা পর্বে কাতার, বাংলাদেশ ও ওমানের বিরুদ্ধে খেলা হয়ে গিয়েছে আফগানিস্তানের। তিনটির মধ্যে দু’টি ম্যাচেই হারতে হয়েছে আজিজিদের। ১৪ নভেম্বর আফগানিস্তান হোম ম্যাচে নামছে সুনীল ছেত্রী-গুরপ্রীত সিংহ সান্ধুদের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচের আগে ইগর স্তিমাচের ভারতকে নিয়ে হোমওয়ার্ক করা হয়ে গিয়েছে আজিজির। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচটা দেখে আফগান গোলকিপার বলছেন, ‘‘আমাদের গ্রুপটা খুবই কঠিন। কাতারকে রুখে দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশ আবার থামিয়ে দিচ্ছে সুনীলদের। এটাই তো ফুটবলের সৌন্দর্য। সব দেশই সবাইকে হারানোর ক্ষমতা ধরে। আমরা অবশ্য শক্তিশালী কাতার ও ওমানের কাছে হেরে গিয়েছি। একটা কথা মনে রাখবেন, কাতার-ওমান শক্তিশালী দল জেনেই আমরা খেলতে নেমেছিলাম। দশ জন মিলে ডিফেন্স করিনি। ম্যাচটা হারলেও নিজেদের ফুটবল সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছি মাঠে। বাংলাদেশকে আমরা হারিয়েছি। পরের ম্যাচগুলোয় ওমান-কাতারকে আমরাও হারাতে পারি। ফুটবলে সবই সম্ভব।’’
শূন্যে বল ধরতে দক্ষ আজিজি।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গুরপ্রীত সিংহ সান্ধুর গোল হজম করার ধরন দেখে হতবাক প্রাক্তন ফুটবলাররা। পঞ্জাবতনয় কী ভাবে বলের ফ্লাইট মিস করে দলকে বিপন্ন করলেন, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না অনেকে। ভারতের গোলকিপারের পাশে দাঁড়িয়ে আজিজি বলছেন, ‘‘নরওয়ের ক্লাব স্তাবেকে খেলার সময়ে গুরপ্রীতের কথা শুনেছি। আমি তখন ডেনমার্কের ক্লাবে খেলছি। ২০১৬ সাফ ফাইনালে গুরপ্রীত আমার উল্টোদিকের গোলে দাঁড়িয়েছিল। শুনেছি ও এখন অনেক উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ফ্লাইটটা মিস করায় সবাই ওর সমালোচনা করছেন। হয়তো বলটা ধরার সময়ে ওর চোখে আলো পড়েছিল। সেই কারণে বলের গতিপথ ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। অন্য কোনও সমস্যা হয়তো হয়ে থাকবে। তবে দল হিসেবে খুবই শক্তিশালী ভারত। ওদের ফুটবলে সাম্প্রতিক কালে অনেক অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। ওরা উন্নতি করছে। গুরপ্রীতের পাশাপাশি সুনীলকেও (ছেত্রী) নজরে রাখতে হবে। সাফ ফাইনালে সুনীল এমন একটা ফ্রি কিক নিয়েছিল, সেটা এখনও আমার মনে রয়েছে। সে যাত্রায় আমি শটটা বাঁচিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু ১৪ তারিখ সুনীলকে কড়া পাহাড়ায় রাখতেই হবে।’’
অনুশীলনে আফগান গোলকিপার আজিজি।
ভারতের বিরুদ্ধে কি পুরোদস্তুর প্রস্তুতি নিয়ে নামতে পারবে আফগানিস্তান শিবির? ২০১৫ থেকে জাতীয় দলের গোল আগলানোর দায়িত্ব সামলানো আজিজি শোনাচ্ছেন এক অন্য সমস্যার গল্প, ‘‘আমাদের দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভাল নয়। তাই বড় কোনও টুর্নামেন্টে খেলার আগে ভাল প্রস্তুতি ম্যাচই পাই না। ভারত যদি ১০ দিনের প্রস্তুতি শিবির করে খেলতে নামে, তা হলে আমরা প্রস্তুত হওয়ার জন্য অল্প কয়েক দিন সময় পাই। সবাই দেশের বাইরের লিগে খেলে। সেই সব দেশের ফুটবল লিগের চরিত্র একেক রকম। ইউরোপের ক্লাবগুলো ম্যাচের রাশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে খেলে। এশিয়ার ক্লাবগুলো আবার অনেক বেশি প্রতি আক্রমণ নির্ভর এবং প্রেসিং ফুটবলের উপরে জোর দেয়। ফলে অল্প কয়েক দিনের প্রস্তুতি শিবিরে ফুটবলারদের মধ্যে সে ভাবে বোঝাপড়া গড়ে ওঠে না। মাঠেও তার প্রভাব পড়ে। এই সমস্যাগুলো রয়ে গিয়েছে।’’
সেই সব সমস্যা নিয়ে সুনীলদের বিরুদ্ধে নামবে আজিজির দেশ। হোম ম্যাচ হলেও তার সুবিধা পাবেন না তাঁরা। নিরাপত্তার অভাবে আফগানিস্তানকে ম্যাচ আয়োজনের অনুমতিই দেয় না ফিফা। সেই কারণেই নিরপেক্ষ দেশ তাজিকিস্তানের মাঠে চলে যায় ম্যাচ। পরভূমই যে এখন আজিজিদের ঠিকানা।
আরও পড়ুন: প্রক্সি পাঠিয়েও টসে হার দক্ষিণ আফ্রিকার, রাঁচীতে অভিষেক নাদিমের
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy