চর্চায়: জোকোভিচই ফেভারিট। ফাইল চিত্র
নোভাক জোকোভিচ, মেলবোর্ন পার্কে বৃহস্পতিবার আপনি শুধু ম্যাচই জিতেছেন। রেকর্ড অষ্টম বার অস্ট্রেলীয় ওপেন জয়ের জন্য ঝাঁপাতে পারছেন। কিন্তু ভক্তদের হৃদয় জিততে পারলেন কোথায়? বরাবরের মতোই তা ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন যে আপনার প্রতিপক্ষ!
এক-এক সময় সত্যিই মনে হচ্ছিল, ভালবাসা যদি টেনিস কোর্টে পয়েন্ট হয়ে ঝরে পড়ত, তা হলে রড লেভার এরিনায় এই মহারণে এক জনই বিজয়ী ছিলেন— রজার ফেডেরার। প্রথম সেটে যখন রাজকীয় রজার ‘এস’ সার্ভিসের বোমাবর্ষণে আপনাকে জেরবার করে তুলছেন, গ্যালারি থেকে ব্যানার তুলে ধরলেন এক ভক্ত— ‘পারফেক্ট’। কিছু ক্ষণ পরে অমর সেই ফোরহ্যান্ড আছড়ে পড়ল! এ বার আর এক জন তুলে ধরলেন— ‘গোট’ (গ্রেটেস্ট অব অল টাইম)। ফেডেরার যদি সর্বোত্তম না হন, কে হবেন!
রজার ফেডেরার— আহা, টেনিসের হ্যারি পটার। যাঁর ফোরহ্যান্ড উইনার দেখে মনে হয়, তাঁর র্যাকেট কোনও সাধারণ খেলাধুলোর সরঞ্জামের স্টোর থেকে কেনা হয়নি। বরং তা যেন বানানো হয়েছে ডায়াগন অ্যালির অলিভ্যান্ডার্স নামক দোকানে। যেখান থেকে তাঁর জাদুদণ্ড কিনেছিলেন হ্যারি!
বিশ্ব জুড়ে জনতার ডার্লিংয়ের বিরুদ্ধে খেলতে নামা নোভাক জোকোভিচ— আপনাকে কী করেই বা ভালবাসা যায়? ফেডেরারের যেমন বিখ্যাত ফোরহ্যান্ড, নাদালের যেমন টপ-স্পিন, আপনার নামাঙ্কিত কোনও বিশেষ শটই তো কখনও তৈরি হল না! ফেডেরারের শিল্প নিয়ে কথা হয়, নাদালের শক্তি আলোচিত হয়, আপনার দুর্গ কী, কেউ খুঁজেই পায় না। তা হলে কী করে হৃদয়ে ঠাঁই পাবেন, নোভাক জোকোভিচ?
আরও পড়ুন: বন্ধু জেরেভের বুম বুম সার্ভিস থামিয়ে ট্রফির লড়াইয়ে থিম
তবে, ইয়ে, বিশেষজ্ঞেরা বলেন, আপনার খেলায় দুর্বলতার সন্ধানও পাননি কেউ। তাঁরা বলেন, কোনও কিছুতেই আপনি ‘পারফেক্ট টেন’ না-হতে পারেন, কিন্তু সব কিছুতেই দশে আট। এমন কোনও বিভাগ নেই, যেখানে অন্যদের মতো আপনাকে দশে চার দেওয়া যাবে। মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা এক বার বলেছিলেন, ‘‘আমার মস্তিষ্কের সুইচ অফ করে দিই, কিন্তু শরীর সব সময় সচল থাকে।’’ মার্টিনার মতো আপনিও টেনিসকে অনেক বেশি ফিটনেস-নির্ভর করে দিয়েছেন। দু’পা প্রসারিত করে কী ভাবে যে-কোনও বলের কাছে পৌঁছে যান, তা টেনিস দুনিয়ার বিস্ময়। শরীরের এমন নমনীয়তা দেখা গিয়েছে গাম্বির কাছ থেকে। কে গাম্বি? কোনও প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় নন। সবুজ মাটির এক টিভি অ্যানিমেশন চরিত্র!
আরও পড়ুন: আজ অন্য ফাইনাল দুই বিস্ময়-কন্যার
অ্যাজমা-আক্রান্ত আপনি সার্বিয়ার ডাক্তারের সঙ্গে বসে ডায়েট থেকে গ্লুটেন আর ল্যাকটোজ ছেঁটে ফেলেছিলেন। সে-দিনই সম্ভবত জন্ম নেয় ভবিষ্যতের এক চ্যাম্পিয়ন। বাবা-মায়ের পিৎজা ও প্যানকেকের রেস্তরাঁয় বড় হওয়া বালকের পক্ষে খাবার নিয়ে এমন সংযম দেখানো সহজ ছিল না। আপনার সঙ্গে ফেডেরারের ম্যাচ মানেই যন্ত্র বনাম শিল্পীর লড়াই। জনতার হৃদয় সব সময় শিল্পীর দিকে। বৃহস্পতিবারেও অবিশ্বাস্য কয়েকটি শট যখন খেললেন, রড লেভার এরিনা উঠে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। প্রথম সেটে টাইব্রেকে মারা একটি ড্রপ শট যেমন। বেসলাইন থেকে ছুটে এসে নেটের সামনে পোস্টের দুরূহ কোণ থেকে আলতো টোকায় রিটার্ন। বল প্রতিপক্ষের কোর্টের ভিতরে পড়ে বাইরে চলে গেল। ফেডেরারও তাকিয়ে দেখলেন! শিল্পীর সামনেই কিনা শিল্পের প্রদর্শন!
কিন্তু তাতে ভালবাসার দাঁড়িপাল্লায় কোনও নড়চড় হয়নি। ম্যাচের পরে ইন্টারভিউ নিতে এসে জিম ক্যুরিয়ার পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘‘দু’জনের পঞ্চাশতম দ্বৈরথ হয়ে গেল। রজার ফেডেরার আপনাকে কী ভাবে উন্নত খেলোয়াড় হতে সাহায্য করেছে?’’ বুঝতে বাকি রইল না, যতটা না আপনার জয়, তার চেয়ে বেশি করে ফেডেরারের হার হিসেবেই দাগ কেটেছে বিশেষজ্ঞদের মনেও। রজার ফেডেরার এমনই এক বিরল চরিত্র, যাঁর চৌম্বক আকর্ষণ ভেঙে দিয়েছে সব লাইন অব কন্ট্রোল। কেউ মনেই রাখে না, তিনি সুইৎজ়ারল্যান্ডের। যেমন আপনি সার্বিয়ার বা রাফায়েল নাদাল স্পেনের। ফেডেরারের পকেটে থাকে বিশ্বতারকার পাসপোর্ট। যে দেশেই তিনি খেলেন, তাঁদের নাগরিক হয়ে যান। না-হলে ৭৫ বছর পেরিয়ে উইম্বলডন জয়ের লক্ষ্যে অ্যান্ডি মারে খেলছেন অল ইংল্যান্ডের কোর্টে আর জনতা চেঁচাচ্ছে ফেডেরারের জয় দেখার জন্য— এর কী ব্যাখ্যা?
সেই ফেডেরার যখন প্রথম সেটে ৪-১ এগিয়ে, তাঁর চোটের কথা ভুলে জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন শিল্পের ভক্তেরা, নিজের সার্ভে আপনি ০-৪০ পিছিয়ে, অন্য একটা মুখ মনে পড়ল। বেলগ্রেডের এক আতঙ্কিত কিশোরের মুখ। এগারো বছর বয়সে এক রাতে নিজের বিছানায় ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় যে লাফিয়ে উঠেছিল। বাইরে হঠাৎই বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ! ঝনঝন করে কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ। সাইরেন বেজে ওঠে। ২৪ মার্চ, ১৯৯৯। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচকে ‘শিক্ষা’ দিতে সার্বিয়ার রাজধানীতে সেই রাতেই শুরু হল নর্থ অতলান্তিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (ন্যাটো) যুদ্ধবিমানের হানা। বিস্ফোরণের শব্দে জ্ঞান হারালেন মা। তাঁর জ্ঞান ফিরতেই পড়িমরি করে কাছের বাঙ্কারে ছুটল সবাই। হঠাৎই কিশোর আবিষ্কার করে, রাস্তায় সে একা। আর ঠিক তখনই তাদের অ্যাপার্টমেন্টের ছাদের উপর দিয়ে উদয় হল দৈত্যটি— এফ ১১৭ বোমারু বিমান! দু’টি মিসাইল মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ‘হিট’ করল কাছের হাসপাতালে।
কে জানত, আতঙ্কের সেই রাস্তা পেরিয়ে সেই রাতে সাহসী কিশোর শুধু বাবা-মায়ের কাছেই পৌঁছে যাবে না, এক দিন উঠে পড়বে চ্যাম্পিয়নের দুর্গম শৃঙ্গেও। জীবনযুদ্ধে হার-না-মানা কিশোরের সন্ধান পাওয়া যায় আপনার আত্মজীবনীতে, নোভাক। তাতে রোম খাড়া হলেও ভালাবাসার জন্ম হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বেলগ্রেডে আপনার এবং ছোটবেলার কোচের টেনিস অনুশীলনের জায়গা খুঁজে বেড়ানোটা যদিও সেরা অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে পারে। কোথায় বোমারু বিমান হানা দিল কাল রাতে? আপনারা দু’জনে লিখে রাখতেন। পরের সকালে সেখানেই চলবে টেনিসের ক্লাস। কারণ, কে যেন বলে দিয়েছিল, বোমারু বিমান কখনও এক জায়গায় পরপর দু’বার আক্রমণ চালায় না!
জীবনের রাস্তায় যিনি এমন গোলাগুলি সামলে এসেছেন, তিনি যে টেনিসের দ্বৈরথে ১-৪ পিছিয়ে পড়ে বেসামাল হবেন না, আশ্চর্যের কী! আপনার কাহিনিটাই যে দুঃসাহসীর। বরাবরই আপনি খেলে চলেছেন ফেডেরার এবং তাঁর বিপুল ভক্তসংখ্যার মিলিত শক্তিকে। যুদ্ধবিমানের সামনে পড়ার পাশে তা কী আর এমন চ্যালেঞ্জ! যুদ্ধের সাইরেন শুনতে শুনতে কখন যে নিজেই যোদ্ধায় পরিণত হয়েছেন!
আপনি শুধু ভালবাসাটাই পাননি, নোভাক। বাকি সবই ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন বৃহস্পতিবারের মহারণ থেকে। ম্যাচ, শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম। সেই সঙ্গে ১৭টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের দিকে এক পা বাড়িয়ে রাখা। জিতলে ফেডেরারের (২০) থেকে তিন ও নাদালের (১৯) থেকে দুই দূরে। টেনিসের ভক্তকুল উঠে না-দাঁড়ালেও নীরবে, নিভৃতে সকলেই মেনে নিতে বাধ্য আপনার র্যাকেটের বশ্যতা।
নোভাক, নব্য যুগে আপনিই টেনিস! না-মেনে উপায় কী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy