Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মেসিচ্যুত নয়, বিশ্বকাপে অটুট মেসিয়ানাই

নেইমার দ্য সিলভাকে রক্ষা করেছিল ক্রসবার। লিওনেল মেসিকে টাইব্রেকারের অশুভতম আতঙ্কের থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল সাও পাওলো মাঠের পশ্চিম দিকের সাইডপোস্ট। সুইৎজারল্যান্ডের ১-১ করে দেওয়ার অব্যর্থ হেড সাইডপোস্টে লেগে ঝুলে থাকল। ম্যাচের পর দেখছিলাম অ্যাল্পাইন মেসি নামে খ্যাত জারদান শাকিরি-সহ সুইসরা অনেকে কাঁদছেন। কাঁদার মতোই চিত্রনাট্য। দুটো টিম যা সুযোগ পেয়েছিল তাতে মেসিরা ম্যাচটা ২-৩ হেরে ফেরেন। আজই বিশ্বকাপ হয়ে যায় মেসিচ্যুত।

গোলের পাস এল সেই মেসিরই পা থেকে। অতিরিক্ত সময়ে গোল করে আর্জেন্তিনাকে শেষ আটে তুললেন দি’মারিয়া (ছবিতে নেই)। মঙ্গলবার সাও পাওলোয়।

গোলের পাস এল সেই মেসিরই পা থেকে। অতিরিক্ত সময়ে গোল করে আর্জেন্তিনাকে শেষ আটে তুললেন দি’মারিয়া (ছবিতে নেই)। মঙ্গলবার সাও পাওলোয়।

গৌতম ভট্টাচার্য
সাও পাওলো শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০৩:৩৩
Share: Save:

নেইমার দ্য সিলভাকে রক্ষা করেছিল ক্রসবার। লিওনেল মেসিকে টাইব্রেকারের অশুভতম আতঙ্কের থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল সাও পাওলো মাঠের পশ্চিম দিকের সাইডপোস্ট।

সুইৎজারল্যান্ডের ১-১ করে দেওয়ার অব্যর্থ হেড সাইডপোস্টে লেগে ঝুলে থাকল। ম্যাচের পর দেখছিলাম অ্যাল্পাইন মেসি নামে খ্যাত জারদান শাকিরি-সহ সুইসরা অনেকে কাঁদছেন। কাঁদার মতোই চিত্রনাট্য। দুটো টিম যা সুযোগ পেয়েছিল তাতে মেসিরা ম্যাচটা ২-৩ হেরে ফেরেন। আজই বিশ্বকাপ হয়ে যায় মেসিচ্যুত।

এ দিনের মতো অবশ্য চ্যুত নয়। মেসিয়ানা অটুট থেকে গেল ব্রাজিল বিশ্বকাপে। ইরানেরটা ছিল শেষ সেকেন্ডে। আজকেরটা অতিরিক্ত সময় শেষ হওয়ার আড়াই মিনিট আগে। একটা হাফলাইনের কাছে বল ধরে তিন জনকে দুলিয়ে দিয়ে দি’মারিয়াকে যে বলটা রাখলেন ফুটবলার, তার একটা নাম আছে ফাইনাল পাস!

দ্বিধাহীন ভাবে আবার তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ। চার ম্যাচে এই নিয়ে চার বার। ছিয়াশির মারাদোনারও এই রেকর্ড ছিল না। মারাদোনা বলতে গিয়ে আবার মনে পড়ে গেল পেলে!

পেলেকে সেই উদ্বোধনের পর আবার সাও পাওলো মাঠের ভিভিআইপি বক্সে দেখা গেল। কী ভাবছিলেন তিনি মধ্যবিত্ততা আর টাফ ট্যাকলিংয়ে ভরা ম্যাচটা দেখতে দেখতে? অনুমান করার চেষ্টা করছি। একটা হতে পারে ভাবছিলেন মেসি, যাকে নিয়ে এরা এত হাইপ তোলে, সে থেকেও কি না সুইস অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড বার করতে মাথা খুঁড়ে মরে। অথবা উল্টোটাও হতে পারে যে ভাবছিলেন, ভাগ্যিস এই সময় আমাকে ফুটবল খেলতে হচ্ছে না।

আধুনিক ফুটবল যে গতি আর ফিটনেসে পৌঁছে গিয়েছে, প্রত্যেকটা প্লেয়ার এমন রুদ্ধশ্বাস ওঠানামায় অভ্যস্ত যে, ফাঁকা জমি পাওয়াই যায় না। পেলের সময় ট্যাকল করার জন্য ববি মুররা থাকতেন। এখন হলে ববি চার্লটনরাও ট্যাকল করতেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্কিলের ওপরও কোথাও না কোথাও গতির গ্রহণ হতই।

একে তো জাতীয় দলের প্র্যাক্টিসে যথেষ্ট কম্বিনেশন তৈরির সময় হয় না। তার ওপর ক্লাবের চাপ নিয়ে নিয়ে ক্লান্তি। অ্যাঞ্জেল দি’মারিয়া জয়সূচক গোলটা করলেন। ক্লাব পর্যায়ে যাঁকে এত দৃপ্ত লাগে, শুরুর দিকে তাঁকেও তো দেখলাম সুইস টিমের মতো লোভনীয় নকআউট প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে আল্পসের শিখর দেখছেন!

দিয়েগো মারাদোনাকে দেখতে পেলাম না। তিনি, পেলে, মেসি এক মাঠে, স্বর্গীয় বাতাবরণ রাজ করত। শুনলাম মারাদোনার সামান্য দ্বিধা টিমে আগেরোর উপস্থিতি নিয়ে। মারাদোনার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আগেরোর। সেটা ভেঙে গিয়েছে খুব তিক্ততার মধ্যে। ইরান ম্যাচে একেবারেই ভাল খেলেননি আগেরো। তার পর নাকি টিমে তাঁর কোনও কোনও বন্ধু বলেছে, তোর প্রাক্তন শ্বশুরের বদ নজরের জন্য এটা হয়েছে। এ দিন যদিও আগেরোর চোটের জন্য খেলার প্রশ্নই ছিল না। তবু কি বিরক্ত হয়েই এলেন না মারাদোনা? এলে অবশ্য দেখতেন আর্জেন্তিনার এই টিমটা খারাপ খেলার জন্য কারও বদ নজরের অপেক্ষায় থাকে না! তাদের টিমে মেসি ছাড়া পুরনো সেই আর্জেন্তিনীয় সুগন্ধটাই নেই!

মারাদোনার বিশ্বকাপে বল প্লেয়াররা রেফারির অনেক নিরাপত্তা ভোগ করেছিলেন। সে বার মারাদোনার মতো এ বারের মেসি বা নেইমার কিন্তু সুরক্ষা পাচ্ছেন না। এমন মারছিল সুইসরা মেসিকে যে, এক বার নিজে হাত ঘুরিয়ে ডিফেন্ডারের মুখে মারলেন। মেসির মাথা গরম ফুটবল মাঠের বিরলতম ছবি আর সেটাই মঙ্গলবার ঘটছিল একাধিক বার।

কলকাতার অনেক ছোট ছোট দোকানে লেখা থাকে ধার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না। এ বারের বিশ্বকাপের ছোট ছোট টিমগুলো যেন একটা দৃশ্য সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে ঐতিহ্যের ডিসকাউন্ট চেয়ে লজ্জা দেবেন না।

একটা টিমের ফুটবল ঐতিহ্য যত কুলীনই হোক, এই বিশ্বকাপে কেউ যে মানছে না, বারবার প্রমাণ হচ্ছে। স্পেন, ইতালির পর পরশুর ব্রাজিল, কালকের জার্মানি আর মঙ্গলবারের আর্জেন্তিনা ব্রাজিল বিশ্বকাপ ঐতিহ্যকেই বরং আরও জমাট বাঁধাল, কেউ বড় নয়। কেউ ছোট নয়। খেলা শুরু হয় ড্র দিয়ে। নব্বই মিনিটের পরেও দেখায় ড্র চলছে।

জার্মান কোচ অটমার হিৎজফেল্ডের অধীনে সুইসরা আরও অনুদার ফুটবল খেলতে শিখেছে। জাতীয় ফুটবল কৌলীন্য শেষ যখন ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এই কোচ তাদের শিখিয়েছেন ব্যক্তিগত নৈপুণ্য না থাকলে কী ভাবে ফিটনেস দিয়ে সেটাকে ম্যানেজ করতে হয়। কী ভাবে

আপ্রাণ সারা ম্যাচ দৌড়তে হয়। শুরুর দিকে তো সুইসরাই দু’বার নিশ্চিত গোল পেয়ে যাচ্ছিল। একটা সের্জিও রোমেরো বাঁচালেন। আর একটা জোসিপ ড্রমিচ এমন হাতে তুলে দিলেন যেন জন্মদিনে সুইস ঘড়ি হাতে তুলে দিচ্ছেন। ব্রাজিলের ক্রসবারের মতোই এটাও চূড়ান্ত ভাগ্য!

দুই মেসির লড়াইয়ে ঠিক হওয়ার কথা ছিল ম্যাচের ভাগ্য। এর মধ্যে আল্পসের মেসিকে কড়া নজরে রেখেছিল আর্জেন্টাইন ডিফেন্স। বল নিয়ে গোলের দিকে ঘোরার আগেই ট্যাকল করেছে। আর মেসি ওয়ানের জন্য পোস্টিং ছিলেন মারাদোনার পুরনো ক্লাব নাপোলির ডিফেন্ডার ভালোন বেরামি। বাঁ পাশে আর এক জন ছয় ফুটের তীব্র ট্যাকলার। মেসি তারই মধ্যে তিন-চার বার ছিটকে বেরিয়েছিলেন কিন্তু আজ তিন জনের কঠোরতম বীরত্বকে পেরোতে পারেননি। বিরতির সময় ভালোন দেখলাম মেসির পিঠে হাত রেখে সৌজন্যসূচক কিছু বলতে গিয়েছিলেন। এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক।

১১৮ মিনিটের চমকের বারুদ হয়তো তখনই জ্বালা হয়ে গিয়েছিল! কে জানে!

ছবি: উৎপল সরকার

অন্য বিষয়গুলি:

fifaworldcup gautam bhattacharya sao paolo messi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE