হাওড়া সালকিয়ার ধূলিমলিন যুবক আড়াইশো গ্রামের এক জোড়া গলদা চিংড়ি বুকে ঝুলিয়ে শনিবার সাতসকালে হাজির সঞ্জয় সেনের অনুশীলনে।
চিৎকার করছিলেন, ‘‘কাল ডার্বি জিতব। তার পর এই দু’টো খাব।’’ আর হারলে? ‘‘খাব, তবে পুজো করে। পরের বছর কলকাতা লিগ জেতার পুজো করে।’’
প্রয়াত উমাকান্ত পালোধিকে ওই যুবকের চেনার কথা নয়। তাঁর সমুদ্রসম আবেগের কথা ভুলে গিয়েছেন সবাই। চল্লিশ বছর পর আবার টানা ছয় বার লিগ জয়ের ইতিহাস ছোঁয়ার সামনে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু পঁচাত্তর সালের কথা উঠলেই উমাকান্ত আর তাঁর সুইসাইড নোটের কথা ঘুরেফিরে আসে। সে বার লিগ হারানোর শিল্ড ফাইনালের ডার্বিতে পাঁচ গোলে হেরেছিল মোহনবাগান। যে লজ্জা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন উমাকান্ত। প্রিয় ক্লাবের দুঃখে আত্মাহুতি দেওয়ার আগে লিখে গিয়েছিলেন, ‘‘পরের জন্মে মোহনবাগান ফুটবলার হয়ে এর শোধ তুলব।’’
আবেগের চেহারা বদলে গিয়েছে এখন। ‘উমাকান্ত’রা এখনও আছেন। তবে অন্য ভাবে। ফেসবুকে ফ্যানস ক্লাবের খেউরের কথা না হয় বাদ দেওয়াই গেল। ওটা তো হাইটেক-আবেগ। তার বাইরেও যে রয়েছে আরও অনেক। নিয়মিত খেতে না পেলেও আবেগের টানেই এখনও চারশো টাকার চিংড়ি কিনে মাঠে আসেন বাগান-সমর্থক। কেউ দেড় হাজার টাকার জোড়া ইলিশ কিনে এনে সেটা লাল-হলুদের কোরিয়ান সুপারস্টার ডংকে দেখিয়ে বলে যান, ‘‘কাল জিতলে তোমাকে দেব এই দুটো। আজই কিনে রাখলাম।’’
কলকাতা লিগ ইস্টবেঙ্গলের কার্যত মুঠোয়। দরকার মাত্র এক পয়েন্ট। তা হলেই হেক্সা লিগ জেতা সম্পূর্ণ। ছোঁয়া যাবে ইতিহাসও। আর মোহনবাগান ডার্বি জিতলেও তাদের লিগ জেতার সম্ভাবনা নেই। তবুও ডং-মেহতাবদের অনুশীলনে যত সমর্থক হাজির তার চেয়ে সামান্য হলেও বেশি উপস্থিত গঙ্গাপারের বাগানে ডুডু-লালকমলদের প্র্যাকটিসে। টিকিটের হাহাকারও প্রায় সমান-সমান। বাঙালির দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার চিরদিনের ফুটবল ম্যাচের মাহাত্ম্য এতটাই যে, লিগ জিতব না জানা সত্ত্বেও শুধু ডার্বির টানেই বাগানে সকাল সাড়ে সাতটায় হাজির কয়েকশো সমর্থক। তাঁদের চিৎকার শুনলে মনে হবে, ডার্বি জিতলে বুঝি লিগটাও পাওয়া যাবে।
কিন্তু কীসের টানে বাগান সমর্থকদের লিগ হারিয়েও এই উপচে পড়া আবেগ? সেটা বোঝা যায় যখন প্রবল হাততালির মধ্যে রবিবাসরীয় বিকেলের ম্যাচের সম্ভাব্য ক্যাচলাইন বলে যান সঞ্জয় সেন। ‘‘কী সব হেক্সা লিগ জয়-টয়ের কথা বলা হচ্ছে শুনছি! আমরা কাল ডার্বি জিতলে ওই হেক্সায় তো কালো দাগ পড়বে।’’
টানা হেক্সা লিগ জয়ের ইতিহাস ছোঁওয়া বনাম কালো দাগ লাগানোর মরিয়া চেষ্টা!
ছবি উৎপল সরকার, শঙ্কর নাগ দাস।
প্রায় এক যুগ পর দুই বঙ্গসন্তান কোচের হাতে কলকাতার দুই মেগা টিমের রিমোট কন্ট্রোল থাকবে বড় ম্যাচে। এবং পরিস্থিতি যা, তাতে চেতলা ব্রিজের দুই প্রান্তের দুই বাসিন্দার বিশ্বটা দু’রকম হয়ে দেখা দেবে আজ যুবভারতীর নব্বই মিনিটে। ইতিহাসে ‘কালো দাগ’-লাগানোর বাইরে সঞ্জয়ের আপাতত কোনও স্বপ্ন নেই। বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের প্রত্যাশার আকাশ অবশ্য দিগন্ত বিস্তৃত। অপরাজিত থেকে লিগ জয়। একক ভাবে কোচের দায়িত্ব নিয়ে লিগ জয়। প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তি কোচের প্রাপ্ত সম্মানকে ছোঁওয়া। সফল কোচ হিসেবে আই লিগের মঞ্চে উত্তরণ এবং প্রতিষ্ঠা।
১৯৭০-৭৫ আর ২০১০-১৫। মশালধারীদের চার দশকের ব্যবধানে হেক্সা লিগ জেতার মধ্যে বৈসাদৃশ্য বরং বেশি। তখন সত্তর মিনিটের ম্যাচ ছিল। এখন নব্বই। সুধীর-সমরেশদের সময় লিগে টিমের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ম্যাচও। লিগে বিদেশি ফুটবলার খেলানোর নিয়ম ছিল না পিকে-র জমানায়। এখন সেখানে ডং আর ডুডুদের নিয়েই বেশি নাচানাচি। হইচই। আবার কাকতালীয়— সে বার ছ’বারের টিমেই ছিলেন দু’জন—সমরেশ চৌধুরী আর সুধীর কর্মকার। এ বারও দু’জন— মেহতাব হোসেন আর সৌমিক দে।
বদলায়নি কোচের ভাষাও। ভোকাল টনিকের স্টাইল।
কালীঘাটের বিরুদ্ধে ’৭৫-র ১৭ সেপ্টেম্বর টানা ছ’বার লিগ নিশ্চিত করার আগের দিন সুভাষ-গৌতমদের কী বলেছিলেন কোচ পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়? ৪-০ ম্যাচটার দু’নম্বর গোল এসেছিল যাঁর পা থেকে সেই গৌতম সরকার বলছিলেন, ‘‘ক্লাবকে যদি মায়ের মতো ভালবাস, যদি বাঘের বাচ্চা হও তা হলে ইতিহাস তৈরি করে মা-র পায়ে সমর্পণ করো, বলেছিলেন প্রদীপদা।’’ আর শনিবার সকালে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের টিম মিটিংয়ে মেহতাবদের জন্য বিশ্বজিতের ভাষাও যে প্রায় সে রকম। ‘‘ডাবলের সামনে দাঁড়িয়ে তোমরা। অপরাজিত লিগ জয় এবং ইতিহাস। তোমরাই পারো দু’টোকেই বাস্তব করতে। ডার্বিকে ডাবল করার মঞ্চ ক’জন পায়?’’
বিশ্বজিতের টিম অন্তত তিনটে জায়গায় আজ এগিয়ে বাগানের চেয়ে। এক) আট ম্যাচে দশ গোল করা ডংয়ের মতো ভয়ঙ্কর গোল-অস্ত্র আছে তাঁর টিমে। দুই) ০-২ পিছিয়ে নিশ্চিত হারা ম্যাচও জেতার ক্ষমতা। তিন) মেহতাব, খাবরা, সৌমিক, তুলুঙ্গা, গুরবিন্দর, বেলোর মতো অভিজ্ঞ ফুটবলার আছে টিমে। ডার্বির চাপ যাঁদের কাছে জল-ভাত।
মুখোমুখি মহাযুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল জয়ী ১১৭, মোহনবাগান ৮৬ (সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে)।
২০০৫-এ প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ শুরু হওয়ার পর থেকে ডার্বিতে আবার মোহনবাগান এগিয়ে। ১৪ ম্যাচে মোহনবাগান জিতেছে ৯। ইস্টবেঙ্গল ৩।
লিগ ডার্বিতে সর্বোচ্চ গোলদাতা মোহনবাগানের
ব্যারেটো। ৭ গোল।
যুবভারতীতে লিগের ৫৩ ডার্বিতে মোহনবাগান এগিয়ে। সবুজ-মেরুন জিতেছে ১৬ বার। ইস্টবেঙ্গল ১৩।
লিগে রবিবার প্রথম ডার্বি হয় ২০১৪-তে। ইস্টবেঙ্গল ৩-১ জেতে।
তথ্য: হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
বাগানের ভরসা বলতে শিল্টন, লালকমল আর ডুডু। বাকি প্রায় সবাই নতুন। আজহারউদ্দিন, কেন লুইস, সঞ্জয় বালমুচু, আসিফ, সুমন হাজরা...। তবে ভাল দিক, আগের ম্যাচগুলোতে কেনরা গোল পেয়েছেন। সাধারণ লিগ ম্যাচ আর ডার্বি এক নয়। সত্তর হাজারের যুবভারতীর শব্দব্রহ্মের সামনে পড়ে তাঁদের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলে সমস্যায় পড়বেন দেশের সেরা কোচ।
ডংকে আটকানোর জন্য আজ জোনাল কভারিংয়ে যাবেন বাগান কোচ। প্রয়োজনে ডাবল কভারিং। ‘‘ছেলেটার একটা চোরা স্পিড আছে। হঠাৎ হঠাৎ খেলা থেকে হারিয়ে যায়। আবার হঠাৎ ফিরে আসে,’’ বলছিলেন সঞ্জয়। আবার ডুডুকে ভোঁতা করতে লাল-হলুদেও মার্কিংয়ের অঙ্ক কষা চলছে। ‘‘ডুডুকে কেউ ছেড়ে রাখে নাকি? ক্লাসে সব বলে দিয়েছি,’’ বলছিলেন বিশ্বজিৎ।
দু’দলেই গোল করার লোক আছে। কিন্তু প্রয়োজনে গোল খাওয়া রুখবে কে? ডিফেন্সই যে শিক্ষক দিবসের দিনেও দুই হে়ডমাস্টারকে চিন্তায় রেখেছে মনে হল। অপরাজিত থাকলেও ইতিমধ্যেই বেলোরা হজম করেছেন আট গোল। বাগানের গোলে ঢুকেছে পাঁচ। বাগানে আবার তাঁর দ্বিতীয় ম্যাচেই ডার্বি-অভিষেক হচ্ছে নতুন বিদেশি হাইতি ডিফেন্ডার আভাস্কা জুদেলিনের। এক বছর আগে এই কলকাতা লিগের ডার্বিতেই একেবারে নতুন আসা আল আদিসা ফাতাইকে নামিয়ে ডুবেছিলেন সুভাষ ভৌমিক। সঞ্জয়ের ভাগ্যে কী আছে কে জানে!
এত সমস্যা নিয়েও সঞ্জয় যদি জিতে যান, তা হলে তেরো বছর পর বাগানের আই লিগ জেতার মতোই বড় ঘটনা হবে।
আর বিশ্বজিৎ জিতলে? তৈরি হবে ইতিহাস। পঁচাত্তরে হেক্সা লিগ জেতা নিশ্চিত করার দিন আনন্দবাজারের হেডিং ছিল—‘নতুন গৌরবের দ্বারে’।
রবিবার সন্ধ্যায় ডংয়ের হাতে ইলিশ উঠলে কী লেখা হবে, তা জানার জন্য এক রাত অপেক্ষা করা যেতেই পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy