সায়ন্তনী মহাপাত্র। বাড়িতে ছোট দুই ছেলেমেয়ে। কারও দুধের তৈরি খাবারে অ্যালার্জি। কারও বা সমস্যা গ্লুটেনে। ফলে জন্মদিনই হোক বা স্কুলের রোজকার টিফিন, কিংবা বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান, বাইরের দোকানের উপরে ভরসা না করে নিজেই বাড়িতে বানিয়ে ফেলেন কেক, কুকি, টার্ট, পেস্ট্রি।
বন্দনা প্রামাণিক। ছোটবেলা থেকেই শখ রান্নাবান্নার। মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ার পরে রীতিমতো কোর্স করে এখন অবসর কাটান খাবার বানিয়ে। আর বরাতও পান দেদার।
মধুমিতা উপাধ্যায়। তাঁর বেশি টান আবার চকলেটের দিকে। চকলেট দিয়ে বাড়িতে হাজারো পদ বানিয়ে বিক্রি করতেন। এখন নিজের হাতের তৈরি জিনিস বিক্রির জন্য দক্ষিণ কলকাতার এক শপিং মলে খুলে ফেলেছেন চকলেটের কাউন্টার।
বাড়িতে বসে উপার্জন করার হাজারো পথ দেখিয়েছে কলকাতা। এমনকী, অনেক দিন ধরেই হোম ডেলিভারির মাধ্যমেও বহু মানুষ সংসার চালান। কিন্তু রীতিমতো দোকানের মতো দেখতে কেক, কুকি, চকলেট বাড়িতে বানানোর চলটা নতুন। আর এ ভাবেই এই ‘হোম বেকার’রা তাঁদের শখকে কাজে লাগিয়ে উপার্জন করছেন দেদার। শহরে ‘হোম বেকার’দের সংখ্যাটা রোজ বেড়েই চলেছে। সপ্তাহান্তে ৪-৫টি কেকের বরাত কোনও ব্যাপারই নয়। আর উৎসবের মরসুমে বরাতটা বাড়ে। কেকের দাম ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ছুঁতে পারে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত। তার ওজন, সাজের উপরে নির্ভর করে দামটা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আরও বাড়ে।
‘হোম বেকার’দের রমরমার আর একটি কারণ অবশ্যই মেনুকার্ড। প্রতিটি দোকানেই নির্দিষ্ট কিছু খাবার পাওয়া যায়। মরসুম অনুযায়ী তা কিছু ক্ষেত্রে বদলালেও, সংখ্যাটা খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু ‘হোম বেকার’দের মেনুকার্ড নির্দিষ্ট না হওয়ায় ক্রেতার পছন্দ মতো খাবার তাঁরা বানিয়ে ফেলতে পারেন যে কোনও সময়ে। যেমন, দোকানে সাবেক ফ্রুট কেকের চল বেশি। সায়ন্তনী ড্রাই ফ্রুটস্ আর মাখনের গন্ধে ভরপুর, নরম তুলতুলে ফ্রুট কেকে ব্যবহার করেন ফ্রেশ ক্রিম। অথবা সাবেক টার্টের ফিলিংয়ে অবলীলায় দিতে পারেন মালয়েশিয়ান কারি। ফলে এই খাবারের স্বাদ যেমন সাবেকিয়ানার বেড়াজাল ভাঙে, তেমনই নানা ‘এক্সপেরিমেন্ট’ অন্য স্বাদের খাবারের সঙ্গে পরিচয়ও করায়।
বন্দনা আবার কড়াইয়ে ডুবো-তেলে ডিমের ডেভিল বা মাংসের সিঙাড়া না ভেজে, সামান্য তেল লাগিয়ে আগুনের গনগনে আঁচে বেক করে নেন। স্বাদ একই রকম কুড়মুড়ে থাকে, তবে ক্যালোরির পরিমাপ হয় নিয়ম মেনেই। যার জন্য স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে অনায়াসে পাতে তুলে দেওয়া যায় এই ‘বেক্ড’ খাবার। আবার ক্রেতার ইচ্ছে মতো থিম কেক বানিয়ে দেন ফনড্যান্ট দিয়ে। ক্রেতা চাইলেই পেয়ে যেতে পারেন ‘গয়নার বাক্স’। কেকের উপরে সোনালি বাক্স থেকে সীতাহার, পাশা, চূড় উঁকি মারলেও স্বাদ কিন্তু অনবদ্য, সাবেক কেকের মতোই।
হোম বেকারদের মতোই ‘চকলেটিয়ার’ মধুমিতা আবার নানা আকারের চকলেট বানিয়েই থামেননি। আমসত্ত্বে মোড়া ডার্ক চকলেট কিংবা রোস্টেড তিল ভরা মিল্ক চকলেট— তাঁর তৈরি নানা ধরনের ফিউশন চকলেট অন্য মাত্রা পেয়েছে। কেক, কুকির মতোই শুধুমাত্র বাহারি চকলেটের ব্যবসার স্বপ্ন নিয়েই মধুমিতা শুরু করে ফেলেছেন তাঁর দোকান।
তবে এঁদের তৈরি খাবারের দামটা দোকানের তুলনায় খানিকটা বেশি। তবু দোকানের চেয়ে অনেকে কেন এঁদের কাছেই খাবারের অর্ডার দেন?
এঁদের দাবি, ভেজাল ছাড়া, ভাল মানের উপকরণ দিয়ে ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি খাবারের দিকে ঝুঁকছেন অনেকেই। বন্দনা জানান, তিনি কখনও মাখন, ক্রিম ইত্যাদির গুণমানে আপস করেন না। তেমনই সায়ন্তনীর বক্তব্য, তাঁর প্রয়োজনীয় ভ্যানিলা এসেন্স আসে কেরল থেকে। এগ হোয়াইট পাউডারের জন্য লন্ডন বা কেক ডেলিভার করার বাক্সের জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন বেঙ্গালুরুকে। ‘‘ইদানীং অবশ্য অনলাইনেও ভাল মানের জিনিস পাওয়া যাচ্ছে, যা কলকাতার সর্বত্র মেলে না’’— বলছেন সায়ন্তনী।
নিউ মার্কেটের বেকিংয়ের সামগ্রীর দোকানে রোজই থাকে উপচে পড়া ভিড়। দোকানের মালিক বললেন, ‘‘এখন কেউ কেউ একটা-দুটো ক্লাস করেই বিক্রির অর্ডার নিয়ে জিনিস কিনতে আসেন। আবার কেউ নিজেই শেখাতে শুরু করেন। তবে হোম বেকার এবং হোম বেকিং ক্লাসের জন্য আমাদের ব্যবসায় লাভ ভালই।’’ আর ঠিক এই জায়গাটাতেই আপত্তি অনেক হোম বেকারের। সায়ন্তনী যেমন বললেন, ‘‘যে জিনিসটা শিখতে বছর ঘুরে যায়, একটা বা দুটো ক্লাসে সেটা কখনওই রপ্ত হয় না। তাই ভাল করে শিখে শেখাতে শুরু করলে বা অর্ডার নিলে তার মান অনেক ভাল হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy