মনে প্রাণে নারী হতেই চেয়েছিলেন জারা। ছবি: ফেসবুকের সৌজন্যে্
ছেলে হয়েই জন্মেছিলেন তিনি। যৌনাঙ্গ সেই তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই সেটাই বিশ্বাস করতেন। ছোট থেকে হাফপ্যান্ট পড়া ছেলেটার বয়ঃসন্ধিতে হালকা গোঁফ-দাড়িও একদিন সেই বিশ্বাসকেই আরও পাকাপোক্ত করে তুলেছিল। কেউ জানতেও পারেনি কী প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে ছেলেটার থুড়ি মেয়েটার মনে, বা অন্য কিছু…অচেনা কোনও সত্তার গভীরে।
পুরুষের শরীর নিয়েই জন্মেছিলেন জারা শেইখা। কিন্তু মনের কুলুঙ্গিতে বাসা বেঁধে থাকা নারী মনটাও যে নিজের অস্তিত্ব জানান দিত সময়ে অসময়ে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত কুঁড়ি থেকে আস্ত চারাগাছ হয়ে উঠছিল সত্ত্বাটা। কেরলের জারা শেইখা, বুঝতেই পারতেন না কোনটা বড়? তাঁর আসল পরিচয়? নাকি লোকলজ্জা, সমাজ আর কটূক্তির ভয়টা?
আরও পড়ুন: অনেক লড়াইয়ের পর ইনিই দেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার পুলিশ অফিসার
লড়াইটা প্রাথমিক ভাবে শুরু হয়েছিল মনের ভিতর। সেই যুদ্ধ আজ এসে থেমেছে নামী বহুজাতিক সংস্থার দরজায়। কাল পর্যন্ত যেখানে তাঁর রূপান্তরকামী পরিচয়ে নাক সিঁটকাতো বড় বড় অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ‘ম্যানার্স’, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি যোগ্যতা থাকলেও তাঁকে চাকরিতে নিতে থাকত প্রবল আপত্তি, জারার জেদের কাছে হার মেনে সেই অফিসেই কাচের দেওয়ালের ওপারে আজ তাঁর নেম প্লেট— ইউএসটি গ্লোবালের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট, হিউম্যান রিসোর্স, জারা শেইখা।
কিন্তু নতুন ঘটনা নন জারা। চারপাশে তাকালে এমন উদাহরণ তো ভুরি ভুরি। একটি বহুজাতিক সংস্থার সিনিয়র মার্কেট অ্যানালিস্ট অর্ণবের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। শরীরটা মেয়েদের হলেও, মনে-প্রাণে তিনি পুরুষ। সাজগোজ ও পুরুষেরই মতো। কিন্তু অর্নবের এই দ্বৈত সত্তাতেই আপত্তি তাঁর সহকর্মীদের। কোনও অফিসিয়াল মিটিংয়ে ডাক পড়ে না। অফিস পার্টি, আউটিংয়েও নেই অর্ণব। এমনকী টেবলে কেন তাঁর গার্লফ্রেন্ডের ছবি থাকবে, তাতেও জোরালো আপত্তি ছিল সকলের। হঠাতই একটা জন্মদিনে যেন বদলে গিয়েছিল পৃথিবীটা। আচমকাই পার্টি দিয়েছিলেন সহকর্মীরা। রঙিন কাগজে মোড়া উপহারও ছিল তাঁর জন্য। কিন্তু খুলতেই হাসি মুখে ফের আঁধার। প্যাকেট ভর্তি চুলের ক্লিপ, রাবার ব্যান্ড, হেয়ারব্যান্ড, টিপের পাতা। আবারও মনে করিয়ে দেওয়া তুমি আসলে নারী। পুরুষ সত্তা প্রকট হলেও নারী হয়েই থাকো তুমি।
আরও পড়ুন: মুখ ফিরিয়েছিল বাপ-মা-বাড়িও
২০১১ সালের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, ভারতে মোট রূপান্তরকামীর সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ। তার মধ্যে অর্ধেকই নিরক্ষর। এর পিছনে প্রধান কারণ কী? দেখা গিয়েছে, সমাজের বক্র দৃষ্টি, কটূক্তি, হেনস্থা, বঞ্চনার শিকার হয়ে মাঝ পথেই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয় বেশিরভাগ রূপান্তরকামী ছাত্রছাত্রী। কিন্তু লড়াইটা জিতে অফিসের চৌকাঠ অবধি পৌঁছেও কি মেলে নিস্তার?
টান্সজেন্ডারদের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন শুভ চাকো। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সলিডারিটি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। শুভ জানালেন, যৌনপল্লিতে কাজ করলে অনেক সময় অফিসের থেকেও বেশি টাকা রোজগার করতে পারেন এঁরা। কিন্তু সেখানকার অত্যাচারটা ভয়াবহ। তাই অনেকেই জীবনের মূল ধারায় ফিরতে চান। কিন্তু সমাজ এখনও ততটা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ সময়ই কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার হতে হয় এঁদের। অন্য আর একটা বড় সমস্যা এঁদের স্বাক্ষরতার করুণ দশা।
সহকর্মীর সঙ্গে জারা। ছবি: ফেসবুকের সৌজন্যে
এত অন্ধকারের মধ্যেও আশার কথা শোনালেন নয়না। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশে ভীষণ খুশি নয়না উদুপিও এক সময় তিন বছর যৌন পল্লিতেও কাজ করেছেন। কোনও রকমে সেখান থেকে পালিয়ে এসে নয়না জানালেন, এখন অফিসে সকলেই জানেন তিনি রূপান্তরকামী। সকলে সে ভাবেই তাঁকে গ্রহণ করেছেন। অফিসের পরিবেশে খুশি হতে পেরেছেন জারাও। তাঁর দফতরের ৬৫জন সহকর্মী সকলেই খুব সাপোর্টিভ, নিজের মুখেই স্বীকার করলেন বছর ২৭-এর জারা।
‘‘এত বছর আমি ছেলে হিসেবে কাজ করে এসেছি। তার পরেও কিন্তু আমাকে প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে। এ বার আমার শর্ত ছিল একটাই, আমি যেমন তেমন ভাবেই গ্রহণ করতে হবে আমাকে। এবং পুরুষ নয়, এক জন নারী হিসেবেই কাজে যোগ দেব আমি’’—গলার স্বরে দম্ভ নয়, ঝরে পড়ল আত্মবিশ্বাস।
কোথা থেকে এল এত মনের জোর?
এক জন তথাকথিত সাধারণ পুরুষ বা নারীর থেকে পারদর্শীতায় কোনও অংশে কম যান না জারা। প্রথমে আবু ধাবির একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন তিনি। ২০১৫-তে দেশে ফিরে আসার পর চেন্নাইতে একটি বেসরকারি সংস্থার মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরে সাড়ে চার বছর কাজ করেছেন তিনি। তবে সে সবই নিজের পুরনো পরিচয়ে। জারা জানালেন, তাঁর আসল পরিচয় সামনে আসার পর কেউই কাজে নিতে চাইতেন না। কিন্তু কারও লিঙ্গ, কী ভাবে চাকরির ক্ষেত্রে মাপকাঠি হতে পারে, সেটাই বোধগম্য হত না জারার। জেদটা চেপে যায় তখনই।
আরও পড়ুন: রূপান্তরিত নারীর প্রথম আইনি বিয়ে দেশে, পাত্রী কলকাতার শ্রী
নিরাশার রাজত্বে তখন একটু প্রত্যাশা। জারার পাশে দাঁড়াল কেরলের এলজিবিটি কমিটি আর কুয়েরিথিম (রূপান্তরকামীদের জন্য কাজ করে তিরুঅনন্তপুরমের এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা)। লড়াইটায় আলাদা একটা শক্তি এল যেন। অবশেষে তিন রাউন্ড ইন্টারভিউ পর্ব কাটিয়ে জারার হাতে সেই বহু প্রতীক্ষিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। ৬৫ জনের মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট পদটা কিন্তু কম সম্মানের নয়।
রূপান্তরকামীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণে কেরল সরকার বরাবরই দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য। ২০১৫ সালে রূপান্তরকামীদের সমস্ত অধিকার রক্ষা করতে বিশেষ আইনও এনেছে রাজ্য প্রশাসন। ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন পরিষেবা থেকে শুরু করে মাসিক পেনশন, সেল্ফ এমপ্লয়মেন্ট গ্রান্টস, ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ড— সবটাই সুনিশ্চিত করা হয়েছে। কিছু দিন আগেই ২৩ জন রূপান্তরকামীকে কোচি মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ চাকরিতে নিয়োগ করে দেশের মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ বার বেসরকারি কোম্পানিতে জরার নিয়োগে নতুন দিশা দেখাল কেরল।
২০১৪-র ১৫ এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট তৃতীয় লিঙ্গের সত্তাকে মান্যতা দিয়েছিল। এর পরেই হোমগার্ডের চাকরিতে রূপান্তরকামীদের স্বাগত জানিয়েছিল তামিলনাড়ু সরকার। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অনেক আগে থেকেই, ২০০৮ সাল থেকে ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ড রয়েছে তামিলনাড়ুতে। সম্প্রতি ওড়িশা সরকারও রূপান্তরকামীদের জন্য পেনশন ও আশ্রয়ের সরকারি পরিষেবা চালু করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও রূপান্তরকামীদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে তৈরি হয়েছে ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ড। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলায় রূপান্তরকামীর সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। তবে ২০১৪-র লোকসভা ভোটে ‘অন্যান্য’ বিভাগে নাম উঠেছিল মাত্র ৫১৩ জনের। এ রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটরি রঞ্জিতা সিংহ জানালেন, আসল সংখ্যাটা অনেক অনেক বেশি। তবে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে ওয়েলফেয়ার বোর্ড। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে এ বার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy