চাঁদের পরিবেশের সঙ্গে সত্যিই কি কোনও বিরোধ রয়েছে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়ার?
চাঁদে পা রাখলেই হৃদরোগ? একাধিক মহাকাশচারীর মৃত্যুও তা থেকেই? এমনই তথ্য উঠে আসছে সাম্প্রতিক একটি পর্যবেক্ষণে। এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এই পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছেন। নাসা অবশ্য এই রিপোর্টকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ। যে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরে ফ্লোরিডা স্টেট উইনিভার্সিটির ওই গবেষক রিপোর্টটি তৈরি করেছেন, এমন পর্যবেক্ষণকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার জন্য ওই কয়েকটি উদাহরণ যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে নাসা। কিন্তু রিপোর্টটি নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা মহাকাশচারীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি গবেষণার দায়িত্ব দিয়েছিল ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির কার্ডিওভাসকুলার ফিজিওলজি বিশেষজ্ঞ মাইকেল ডেল্পকে। তাঁর গবেষণা বলছে, চাঁদ থেকে ঘুরে এসেছেন যাঁরা, তাঁদের বেশ কয়েক জনের মৃত্যুর কারণ অদ্ভুত ভাবে মিলে যাচ্ছে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন তাঁরা।
এখনও পর্যন্ত ২৪ জন মহাকাশচারীর চাঁদে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এঁদের মধ্যে ১২ জন চাঁদের মাটিতে হেঁটেছেন। বাকিরা চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছলেও, মহাকাশযান থেকে নামেননি। এই সব মহকাশচারীদের অনেকেরই হৃদপিণ্ডে এবং রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থায় গোলোযোগ তৈরি হয়ে গিয়েছিস বলে মাইকেল ডেল্প দাবি করছেন। তিন মহাকাশচারীর মৃত্যুর উদাহরণ তুলে ধরেছেন মাইকেল ডেল্প।
নিল আর্মস্ট্রং— প্রথম মানুষ যিনি চাঁদে পা রেখেছিলেন। ২০১২ সালে মারা গিয়েছেন। বয়স তখন ছিল ৮২ বছর। হার্ট এবং রক্তসঞ্চালনের সমস্যার জন্য তাঁর একটি অস্ত্রোপচার হয়েছিল। কিন্তু অস্ত্রোপচার সফল হল না। মৃত্যু হল আর্মস্ট্রং-এর।
জেমস আরউইন- ১৯৭১ সালে নাসার অ্যাপোলো মিশনের শরিক হয়ে চাঁদে গেলেন। পৃথিবীতে ফিরলেনও নির্বিঘ্নে। ঠিক তার দু’বছরের মাথায় আরউইনের হার্ট অ্যাটাক হল। বয়স তখন মাত্র ৪৩ বছর। সে যাত্রা বেঁচে যান। কিন্তু ১৯৯১ সালে ৬১ বছর বয়সে আবার হার্ট অ্যাটাক। মৃত্যুর মুখ থেকে আর পিরে আসতে পারেননি আরউইন।
রন ইভানস- অ্যাপোলো-১৭ মিশনের কম্যান্ড মডিউল পাইলট অন বোর্ড হিসেবে চাঁদে গেলেন। সেই শেষ বার চাঁদে মানুষ পাঠাল নাসা। ১৯৭২ সাল সেটা। তিনিও নির্বিঘ্নে ফিরলেন। কিন্তু তার ১৮ বছরের মাথায়, ১৯৯০ সালে, মাত্র ৫৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। বাঁচানো গেল না তাঁকেও।
এই মহাকাশচারীদের কারওরই হৃদপিন্ড বা রক্ত সঞ্চালনের কোনও সমস্যা ছিল না। মহাকাশে পাঠানোর আগে অনেক বার পরীক্ষা করা হয় মহাকাশচারীদের শারীরিক সক্ষমতা। কারও কোনও দুর্বলতা ছিল না। দুর্বলতা থাকলে মহাকাশে যাওয়ার সুযোগও পেতেন না। সুস্থ শরীরেই চাঁদে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর সমস্যা ধরা পড়ল। তবে ডেল্প-এর গবেষণায় ইঙ্গিত, চাঁদ থেকে ফিরে আসার পর নয়, চাঁদের সংস্পর্শে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্যা শুরু হয়েছিল। নিল আর্মস্ট্রং এবং রন ইভানসের ক্ষেত্রে সমস্যা কিছুটা পরে ধরা পড়েছিল। কিন্তু জেমস আরউইন চাঁদের মাটিতে পা রাখার পরই তাঁর হৃদস্পন্দনে অনিয়মিততা ধরা পড়েছিল। বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কিন্তু পরে সেই সমস্যাই বেড়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠল।
বৃহস্পতিবার ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে মাইকেল ডেল্পের গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে। ডেল্প সেখানে লিখেছেন, মহাকাশ থেকে বা চাঁদ থেকে যাঁরা ঘুরে আসছেন, তাঁদের হৃদযন্ত্রের গতিপ্রকৃতির উপর এ বার সতর্ক ভাবে নজর রাখতে শুরু করুক নাসা। মাইকেল ডেল্পের এই নতুন তত্ত্বে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এত দিন পর্যন্ত মহাকাশচারীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, সেগুলির বেশির ভাগই ক্যানসারের আশঙ্কা সংক্রান্ত। মহাকাশে অত্যধিক তেজস্ক্রিয়তার মধ্যে পড়তে হয় বলে মহাকাশচারীদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া নিম্ন মাধ্যাকর্ষণের কারণে হাড় দুর্বল হয়ে পড়ার সমস্যাও তৈরি হয়। কিন্তু চাঁদ থেকে ঘুরে আসার পর হৃদযন্ত্রে গুরুতর গোলোযোগ ঘটে যায়, এমন কথা কিন্তু আগে শোনা যায়নি। ফলে তার প্রতিকার খোঁজার চেষ্টাও হয়নি। কিন্তু নাসা মাইকেল ডেল্পকে মহাকাশচারীদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করতে বলার পর, ডেল্প এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। নাসাকে তাঁর পরামর্শ, মহাকাশচারীদের হৃদযন্ত্রের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হোক।
আরও পড়ুন: কঠিন পিচে দারুণ ব্যাট করছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’!
৪ গ্রহের হদিশ মিলল যেখানে প্রাণ থাকতে পারে
ডেল্পকে নাসা-ই গবেষণার দায়িত্ব দিয়েছিল। তাই ডেল্পের এই রিপোর্টকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ তারা করতে পারছে না। কিন্তু মাইকেল ডেল্প যা বলেছেন, তাকে পুরোপুরি মান্যতাও নাসা দিচ্ছে না। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার পদস্থ কর্তারা বলছেন, এখনও পর্যন্ত ২৪ জন মহাকাশচারী চাঁদে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩ জনের মৃত্যু হৃদরোগের জেরে হয়েছে। এর থেকে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছন যায় না। নাসার সদ্যপ্রাক্তন চিফ সায়েন্টিস ফর হিউম্যান রিসার্চ মার্ক শেলমার বলছেন, যেটুকু নমুনার ভিত্তিতে মাইকেল ডেল্প বলেছেন যে চাঁদে গেলে হৃদযন্ত্রে এবং রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সেটুকু নমুনার ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব নয়। এ রকম ঘটনা আরও ঘটতে থাকলে কোনও উপসংহার টানা যেতে পারে বলে তাঁর মত। শেলমার অবশ্য জানাচ্ছেন, নাসা তার মহাকাশচারীদের সব রকম শারীরিক সমস্যার দিকেই নজর রাখে। আমৃত্যু তাঁদের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা হয়।
মার্ক শেলমার বা নাসার অন্য পদস্থ কর্তারা যা-ই বলুন, মাইকেল ডেল্প কিন্তু পাথুরে প্রমাণও হাজির করেছেন নিজের রিপোর্টের সপক্ষে। তিনি কৃত্রিম ভাবে চাঁদের মতো পরিবেশ তৈরি করেছেন। অর্থাৎ গবেষণাগারে নিম্ন মাধ্যকর্ষণ ক্ষেত্র তৈরি করেছেন এবং তেজস্ক্রিয়তার ব্যবস্থা করেছেন। সেই নিম্ন মাধ্যকর্ষণ এবং তেজস্ক্রিয় পরিসরে ইঁদুর রেখেছেন ছ’মাস। তার পর সেই ইঁদুরের হৃদযন্ত্র এবং রক্ত সঞ্চালনের উপর নিম্ন মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের প্রভাব পরীক্ষা করেছেন। বিশদ গবেষণার পর মাইকেল ডেল্পের দাবি, মহাকাশচারীদের হৃদযন্ত্রে তৈরি হওয়া সমস্যার নিরাময় সম্ভব। তবে অবহেলা হলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy