টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা তুঙ্গে। বসে নেই ভ্যাকসিন-বিরোধীরাও
যুধিষ্ঠিরকে যক্ষরূপী ধর্ম প্রশ্ন করেছিলেন, বাতাসের চেয়েও দ্রুতগামী কে? যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিলেন, মন। দ্বাপরে সমাজমাধ্যম ছিল না। এ যুগে হলে হয়তো যুধিষ্ঠির বলতেন, ফেক নিউজ় বা ভুয়ো খবর। সমাজমাধ্যমের রমরমার সঙ্গে বিগত দেড় দশক ধরে ভুয়ো খবরও রমরমিয়ে চলছে বিশ্ব জুড়ে। কখনও তা রাজনৈতিক কারণে, কখনও ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষ ছড়াতে, কখনও বা বিশেষ কোনও সংগঠনের আদর্শ প্রচারে আর কখনও স্রেফ ভাইরাল হওয়ার নেশায়। করোনাভাইরাস ও কোভিডের মতো অতিমারির ঘটনা তো ভুয়ো খবরের কারবারিদের কাছে একেবারে সোনায় সোহাগা। কোভিডের ক্ষেত্রে ভুয়ো খবর বা দর্শনের আড়ালে মূলত প্রচারিত হয়েছে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। যেমন, করোনাভাইরাস চিনের গবেষণাগারে তৈরি ভাইরাস। কোভিড আসলে সামান্য জ্বর ছাড়া কিছু না, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে। করোনাভাইরাস আদতে ভাইরাসই নয়, ব্যাকটিরিয়া। তবে এখন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ঘুরে গেছে ভ্যাকসিনের দিকে।
ভ্যাকসিন-বিরোধী সংগঠনগুলো মাঠে নেমে পড়েছে ভুয়ো খবর, ভুয়ো তত্ত্ব নিয়ে। এরা বহু কাল ধরেই নিজস্ব বিশ্বাস ও ধর্মীয় কারণে সক্রিয় ভাবে ভ্যাকসিন-বিরোধী প্রচার চালিয়ে আসছে। গত মে মাস থেকে সমাজমাধ্যমে এদের উপস্থিতি ও সরাসরি রাস্তায় নেমে প্রচার অভিযান তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকটি ভ্যাকসিন নিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষায় আশাপ্রদ ফল পাওয়া গেলেও, এবং রাশিয়া প্রথম ভ্যাকসিন তৈরিতে সাফল্য ঘোষণা করলেও সাধারণ মানুষ ভ্যাকসিন কবে পাবেন, তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু ভ্যাকসিন-বিরোধী সংগঠন এই সব ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে দিয়েছে বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে। নিমেষে তাদের প্রচার ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-দেশান্তরে। ফেসবুক, ইউটিউব যখন এ সব ভিডিয়োগুলো সরিয়ে দেয়, তত দিনে কোটিখানেক লোক সে সব ভিডিয়ো দেখে ফেলেছেন এবং ভুয়ো প্রচারে প্রভাবিতও হয়েছেন।
কিছু প্রচার খুব গোদা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। যেমন, করোনাভাইরাসের এই অতিমারি পুরোটাই বিল গেটসের সৃষ্টি। নয়তো দু’বছর আগে বিল গেটস এ রকম অতিমারি আসবে আর লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাবে, সেই কথা কেমন করে জানলেন! বিল গেটস এই ভ্যাকসিনের মধ্যে ন্যানোচিপ ঢুকিয়ে দেবেন, এবং সবাইকে সেই ন্যানোচিপের মাধ্যমে আসলে নজরবন্দি করে রাখা হবে। প্রচার এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, বিল গেটসকে স্বয়ং টিভিতে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানাতে হচ্ছে, এ সব সম্পূর্ণ মিথ্যে প্রচার। হলিউডি চিত্রনাট্যসম এই প্রচারে ন্যানোচিপের ধারণাটা খুব সম্ভবত কোনও কোনও কোভিড ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য যে অত্যাধুনিক ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার হচ্ছে, তার থেকে এসেছে।
তবে মূল যে বিষয়টি বিভিন্ন ভাবে ভ্যাকসিন-বিরোধীরা প্রচার করছেন, তা হল নিরাপত্তা। যেমন, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের নেপথ্যে ব্যবহৃত প্রযুক্তির নিরাপত্তা আগেই প্রমাণিত। কিন্তু ভ্যাকসিন-বিরোধীরা প্রচার করছেন, এই ভাইরাসের ডিএনএ আমাদের নিজেদের ডিএনএ-র সঙ্গে মিশে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটাবে! রাশিয়ার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের আগেই ভ্যাকসিনে সাফল্য ঘোষণা ভ্যাকসিন-বিরোধীদের সন্দেহকে আরও জোরদার করেছে।
কিন্তু এই বিরোধীরা কারা? আমেরিকা ও ইউরোপে সংগঠিত বিরোধী দলগুলি মূলত চরম দক্ষিণপন্থী, কট্টর ধর্মীয় বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকামী। যদিও কোনও ধর্মেই ভ্যাকসিন সম্বন্ধে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই, কিন্তু এঁরা মনে করেন ভ্যাকসিন ব্যবহার ঈশ্বরের ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ। আর এই ধরনের গোষ্ঠীর বাড়বাড়ন্ত আজকে নতুন নয়। ব্রিটেনে এডওয়ার্ড জেনার গুটি বসন্তের টিকাকরণ শুরু করেছিলেন আঠেরোশো শতকের শেষ ভাগে। তখন থেকেই যে বিরোধী গোষ্ঠী সক্রিয়, তার প্রমাণ সেই সময়কার পত্রপত্রিকায় ছাপা একাধিক ব্যঙ্গচিত্র। বিরোধ চরমে পৌঁছয় ১৮৫৩ সালে ভ্যাকসিনেশন অ্যাক্ট কার্যকর হলে। তৈরি হয় অ্যান্টি ভ্যাকসিনেশন লিগ। ১৮৭৯ সালে ব্রিটেনের অনুকরণে গড়ে ওঠে অ্যান্টি ভ্যাকসিনেশন সোসাইটি অব আমেরিকা, যা আজও সক্রিয়। আমেরিকার মতো জার্মানিতেও এই ধরনের সংগঠন সক্রিয়। তারা কোভিড ভ্যাকসিনের তীব্র বিরোধিতা ও লাগাতার প্রচার করছে। এদের বিভিন্ন মনগড়া বা মিথ্যে প্রচারের কুফলও ফলতে শুরু করেছে। মাঝ এপ্রিলে ৭৯% জার্মান ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী ছিলেন, জুনের শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৬৪%-তে। যদি সত্যিই কার্যকর ভ্যাকসিন আসে, আর ৩৬% তা নিতে অস্বীকার করেন, তবে করোনা নির্মূল খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। মে থেকে জুন বিভিন্ন সময়ে আমেরিকাতেও পৃথক পৃথক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২০-৩০% লোক কোভিড ভ্যাকসিন নিতে রীতিমতো অনিচ্ছুক।
অনিচ্ছুকদের সংখ্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ, সংগঠিত প্রচারে বিরোধীরা ভ্যাকসিন পক্ষপাতীদের চেয়ে বহু যোজন এগিয়ে আছেন। যাঁরা ভ্যাকসিন ব্যবহারের প্রসার চান, তাঁরা আলোচনা করেন মূলত নিজেদের বৃত্তেই যা জনগণের কাছে পৌঁছয়ও কম। উল্টো দিকে, কট্টর বিরোধীরা অনেক বেশি সংগঠিত। তাঁরা কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক পরিভাষাযুক্ত অর্ধ সত্য আর মিথ্যে তথ্য ও তত্ত্বে ভরা ঝকঝকে ভিডিয়ো তৈরি করেন, সঙ্গে ব্যবহার করেন নাটকীয় কণ্ঠস্বর।
এঁরা কখনও ‘অভিজ্ঞ ডাক্তার’, বা কখনও ‘এক জন ভুক্তভোগী মা’ ইত্যাদি পরিচয়েও নিজের বক্তব্য রাখেন। তার পর তাঁদের বিভিন্ন শাখা বা সমমনস্ক সংগঠনের মাধ্যমে সে সব ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। ঝকঝকে গ্রাফিক্স আর শব্দের প্রভাবে মানুষ সম্পূর্ণ ভিডিয়োটি দেখতে আগ্রহী হয়। ভ্যাকসিনের পক্ষপাতী সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে এ রকম প্রচেষ্টা বিশেষ চোখে পড়ে না। ভ্যাকসিন যে জীবন বাঁচায়, এ তো প্রমাণিত, এ আবার এত বোঝানোর কী আছে! বিপরীতে, বিরোধীদের দ্বারা একটি বহুল প্রচারিত মিথ্যে তত্ত্ব হল, শিশুদের ভ্যাকসিন দিলে, তাদের অটিজ়মের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। যাঁরা কিছুটা সংশয়ান্বিত ছিলেন, তাঁরা তখন নিরাপত্তার খাতিরে নিজেদের শিশুকে ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে একেবারে বেঁকে বসেন। খালি এই মিথ্যে প্রচারের জন্য আমেরিকায় ২০০০ সালে নির্মূল ঘোষিত হওয়া হাম আবার ফেরত এসেছে।
ভ্যাকসিন নিতে অনিচ্ছুকদের সামান্য অংশই কিন্তু কট্টর ভ্যাকসিন-বিরোধী সংগঠনের সদস্য। এঁরা কেউ মনে করেন, প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট অনাক্রম্যতাই আসলে বেশি কার্যকর। কেউ আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির বিরোধী। তাঁরা ভাবেন, আসলে এটা ওষুধ কোম্পানি আর সরকারের মিলিত ষড়যন্ত্র। দুনিয়াজোড়া কর্পোরেট পুঁজি আর সরকারের মাখামাখি তাঁদের সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে। অনেকে মনে করেন, ভ্যাকসিন নেওয়া বা না-নেওয়া ব্যক্তিগত বিষয়, সরকার চাপিয়ে দিলে তা সংবিধানিক অধিকার হরণের শামিল। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা কোভিড ভ্যাকসিন নিতে অনেকেই অনিচ্ছুক, তাঁদের ক্ষেত্রে সেটা শ্বেতাঙ্গদের মতো ব্যক্তিগত বা সংবিধানিক অধিকার হরণের বিষয় নয়। তাঁরা আতঙ্কিত, যে কোভিড ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করেই তাঁদের ‘গিনিপিগ’ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
তবে অনেকেই আছেন, যাঁদের সংশয় অমূলক বলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেমন, যেখানে অন্য রোগের ক্ষেত্রে কার্যকর ভ্যাকসিন বাজারে আসতে পাঁচ-দশ বছর লেগে যায়, সেখানে করোনার ক্ষেত্রে অনেকে মনে করছেন, ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত গবেষণার দিকটা নিশ্চয়ই আপস করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দায়িত্ব বর্তায়, ঠিক তথ্য সবার মাঝে তুলে ধরা। পুরো ব্যাপারটিতে যত ধোঁয়াশা থাকবে, তত ভ্যাকসিনের প্রতি অনীহা বাড়বে। ফলে কোভিড নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা কমবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ওয়েলকাম ট্রাস্টের সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় ১০০ শতাংশ মানুষই যে কোনও রোগ রুখতে ভ্যাকসিন নেওয়ার পক্ষপাতী। তাই কার্যকর ভ্যাকসিন বাজারে এলে, এই দুই প্রতিবেশী দেশে কোভিড নির্মূল করা খুব কঠিন হবে না বলেই আশা করা যায়।
লেখক স্যানফোর্ড বার্নহ্যাম প্রেবিস মেডিক্যাল ডিসকভারি ইনস্টিটিউট,
ক্যালিফর্নিয়ায় কর্মরত গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy