Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Big Bang Theory

কী দিয়ে তৈরি ডার্ক ম্যাটার? একে শনাক্ত করারই বা উপায় কী? উত্তর এখনও অজানা

ডার্ক ম্যাটার হচ্ছে সেই ধরনের পদার্থ, যেটা আসলে যে কী ধরনের পদার্থ, সে সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।

বিনয় মালাকার
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২১ ০৫:১৪
Share: Save:

আজ থেকে প্রায় ১৩৮০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সমস্ত ভর একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই কেন্দ্রীভূত অবস্থাকে বলা হয় ‘সিঙ্গুলারিটি’। প্রচণ্ড শক্তিতে বিন্দুটি বিস্ফোরিত হল এবং সব ভর এই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। এই বিস্ফোরণকেই বলা হয় বিগ ব্যাং। তার পর এই ছড়িয়ে পড়া চলতেই থাকল, সম্প্রসারিত হতে থাকল মহাবিশ্ব। এই সম্প্রসারণ প্রথম ধরা পড়ে ১৯২৯ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবলের তৈরি হাবল টেলিস্কোপে।

বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি হল, আমাদের চার পাশে গাছপালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, গ্রহ-উপগ্রহ, গ্যালাক্সি-সহ যে সমস্ত দৃশ্যমান জড় পদার্থগুলি আমরা দেখি, তারা এই মহাবিশ্বের মোট ভরশক্তির পাঁচ শতাংশ মাত্র। বাকি ৯৫ শতাংশ সম্পূর্ণ অদৃশ্য, অজানা, রহস্যময় এক অন্ধকার জগৎ। এই মহাবিশ্বের মোট ভর, দৃশ্যমান ভরের চেয়ে অনেক বেশি। জানার চেয়ে অজানাই অনেক বেশি। এই ৯৫ শতাংশের মধ্যে ৭০ শতাংশ হল ডার্ক এনার্জি এবং ২৫ শতাংশ হল ডার্ক ম্যাটার। এখন প্রশ্ন হল, এই ৯৫ শতাংশ গুপ্ত ভরশক্তিকে যাচাই করব কী করে? বিজ্ঞানীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা ৯৫ শতাংশ গুপ্ত ভরশক্তিকে বিজ্ঞানীরা যাচাই করেছেন মহাকর্ষ বলের কষ্টিপাথরে।

ডার্ক ম্যাটার হচ্ছে সেই ধরনের পদার্থ, যেটা আসলে যে কী ধরনের পদার্থ, সে সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। এর উৎস কী আর কী দিয়েই বা এটা তৈরি, তাও সম্পূর্ণ অজানা। আলোর সঙ্গে সম্ভবত এর এক ধরনের শত্রুতা রয়েছে, কারণ ডার্ক ম্যাটার ভুলেও আলোর সঙ্গে পদার্থবিদ্যা সম্পর্কিত কোনও রকম সম্পর্কে জড়ায় না। সে আলো শোষণ করে না, আলো প্রতিফলন, প্রতিসরণ বা বিচ্ছুরণও করে না। ফলে একে দেখাও যায় না। বিজ্ঞানীরা বলেন, ডার্ক ম্যাটার ছড়িয়ে রয়েছে মহাবিশ্বের এখানে-ওখানে সর্বত্র। তবু তাদের দেখা মিলছে না কেন? এর কারণ মূলত তিনটি— এরা অদৃশ্য, কোনও যন্ত্র বা ডিটেক্টর দিয়ে এদের শনাক্ত করা যায় না, এবং অন্য কোনও পদার্থের সঙ্গে কোনও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে না।

ডার্ক ম্যাটার গবেষণার আধুনিক যুগ শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ছায়াপথের ভর মাপতে গিয়ে তখন বেশ কিছু অসঙ্গতি লক্ষ করেন। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন (১৯২৮-২০১৬) সেই সময়কার সবচেয়ে উন্নত স্পেকট্রোগ্রাফ দিয়ে বিভিন্ন ছায়াপথের ঘূর্ণন বেগ মাপতে গিয়ে লক্ষ করেন যে, নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র এ ক্ষেত্রে সঠিক নয়, অথবা ছায়াপথের মোট ভরের একটি বিশাল অংশ গুপ্ত অবস্থায় আছে। তখন থেকেই ডার্ক ম্যাটারের ধারণাটি বিজ্ঞানী-মহলে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সদ্য প্রকাশিত হয়েছে তাঁর জীবনী, ভেরা রুবিন: আ লাইফ।

ডার্ক ম্যাটার কী দিয়ে তৈরি, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা না গেলেও, এটুকু নিশ্চিত করে বলাই যায় যে, আমাদের পরিচিত ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন কণা দিয়ে তৈরি নয়। ডার্ক ম্যাটার এমন কিছু দিয়ে তৈরি, যা বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার করে উঠতে পারেননি। বিজ্ঞান এখনও এর উত্তর খুঁজে চলেছে। কোয়ান্টাম ফিজ়িক্স-এ এক্সিয়ন নামে এক ধরনের পারমাণবিক কণার কথা বলা হয়, যার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ডার্ক ম্যাটারের কিছু মিল রয়েছে। হতে পারে ডার্ক ম্যাটার এক্সিয়ন দিয়ে তৈরি, আবার নাও হতে পারে। একটি হাইপোথিসিস অনুযায়ী, ডার্ক ম্যাটার উইম্প (উইকলি ইন্টার‌্যাক্টিং ম্যাসিভ পার্টিকল) দিয়ে তৈরি, যার বৈশিষ্ট্য হল— সেটা পদার্থের সঙ্গে এতই দুর্বল ভাবে সম্পর্ক স্থাপন করে যে, বিশাল ভরের কোনও ডার্ক ম্যাটার আমাদের দেহ ভেদ করে চলে গেলেও আমরা তা টেরই পাব না। স্টেরাইল বা নির্জীব নিউট্রিনো কণা, যা জড় বস্তুর সঙ্গে ভীষণ দুর্বল ভাবে শুধুমাত্র মহাকর্ষ বল দ্বারাই পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে, ডার্ক ম্যাটার গঠনের একটি সম্ভাব্য কণা। যে হেতু এটি মহাকর্ষ বল ছাড়া অন্য কোনও বলে সাড়া দেয় না, তাই এদের নির্জীব বলা হয়।

১৯৯৮ সালে বিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ ধরনের সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করে অদ্ভুত একটি ব্যাপার লক্ষ করলেন। তাঁরা দেখলেন, সুপারনোভাটি কেবল যে পৃথিবী থেকেই দূরে সরে যাচ্ছে, এমনটা নয়, এই দূরে সরে যাওয়ার গতি সময়ের সঙ্গে বাড়ছে। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের ত্বরণ ঘটছে। এটা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ফলে গতি কমার বদলে, বাড়ছে! এই গতি বাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির কোনও না কোনও উৎস থাকতেই হবে। তা হলে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জন্ম নিল ডার্ক এনার্জির ধারণা।

ডার্ক এনার্জি কী ধর‌নের এনার্জি, তা এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে বেশ কয়েকটি থিয়োরি দাঁড় করানো হয়েছে। সেগুলি হল— ১) ডার্ক এনার্জি হল শূন্যস্থানের একটি বৈশিষ্ট্য, যা দু’টি বস্তুকে দূরে ঠেলে দিয়ে তাদের মধ্যে আরও ফাঁকা জায়গা তৈরি করে, মহাকর্ষ বলের ঠিক বিপরীত। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ফলে যত বেশি শূন্যস্থান বাড়ছে, তত বেশি বাড়ছে ডার্ক এনার্জিও, এবং এর ফলে আরও বেশি শক্তি প্রয়োগ করে গ্যালাক্সিগুলো একে অপরকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে বাড়ছে সম্প্রসারণের গতি। ২) মহাকাশে এক ধরনের কণা শূন্য থেকে ক্রমাগত বুদবুদের মতো সৃষ্টি হয়, আবার বুদবুদের মতোই মিলিয়ে যায়। এই রহস্যজনক কণাটি থেকেই সৃষ্টি হয় ডার্ক এনার্জির।

দেখাই যদি না যায়, স্পর্শ দিয়েও যার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না, পরোক্ষ ভাবেও যার হদিশ মেলে না, তবে সেই বস্তু যে আছে, তা বুঝব কী ভাবে? ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব বোঝা যায় শুধুমাত্র অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় বলের প্রভাব থেকে। আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাকর্ষ হল চার মাত্রার স্থান-কাল জ্যামিতির খেলা। একটি ভারী বস্তু (যেমন নক্ষত্র) তার চার পাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়। এই স্থান-কালের বক্রতার জাল ছিন্ন করতে পারে না ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি। সুতরাং, ধরা না দিয়ে বাছাধন যাবে কোথায়? বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষ প্রক্রিয়া থেকে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছেন।

উইম্প ও ডার্ক ম্যাটার গবেষণার জন্য আমেরিকার স্যানফোর্ড আন্ডারগ্রাউন্ড রিসার্চ ফেসিলিটি-তে বসানো হয়েছে লার্জ আন্ডারগ্রাউন্ড জ়েনন (লাক্স) ডিটেক্টর, মাটির ১৫০০ মিটার গভীরে বিশেষ এক পাথরের চেম্বার। এখান থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মিও বেরিয়ে আসতে পারে না। ৩১০ কেজি জ়েনন ভীষণ শীতল অবস্থায় একটি ট্যাঙ্কের মধ্যে রাখা থাকে, যার নীচের দিকে একটি ইলেকট্রিক ফিল্ড আছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, যখন জ়েনন পরমাণুর সঙ্গে উইম্পের সংঘর্ষ ঘটবে, তখন এক আলোর ঝলকানি নির্গত হবে, যা সহজেই লাক্স-এ রাখা শক্তিশালী লাইট ডিটেক্টরে ধরা পড়বে। ২০১৩ সালে প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে কাজ শুরু হলেও এখনও পর্যন্ত এই পরীক্ষা থেকে উল্লেখযোগ্য কোনও সাফল্য পাওয়া যায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের আশা, হিগস বোসনের মতো উইম্পও এক দিন লাক্সের জালে জড়িয়ে ফেলবে নিজেকে।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে অজ্ঞানতা কখনওই আবিষ্কারের পথে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারেনি, বরং অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার দুর্নিবার আকর্ষণ কৌতূহলী বিজ্ঞানীদের আরও বেশি উৎসাহিত করেছে। তাই তো সভ্যতা আজকে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞান এই সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। লক্ষ্যে পৌঁছোতে গেলে এখনও হয়তো অনেক অচেনা পথ পাড়ি দিতে হবে, পরীক্ষানিরীক্ষামূলক অনেক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করতে হবে, আরও অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করতে হবে।

এই ভাবে মানুষ তার মেধা আর প্রচেষ্টার মাধ্যমে অন্ধকার বস্তু আর অন্ধকার শক্তির মতো বিষয়গুলোকে এক দিন আলোতে নিয়ে আসবে। বিজ্ঞান কৈশোর কাল থেকে সাবালক হয়ে উঠবে! শেষের সেই দিন ভীষণ মসৃণ আর সুন্দর হবে।

বিভাগীয় প্রধান, পদার্থবিদ্যা

নেতাজি মহাবিদ্যালয়,

আরামবাগ, হুগলি

অন্য বিষয়গুলি:

Science and Technology Big Bang Theory
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy