প্রতীকী চিত্র।
সালটা ১৯৫৯। বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক রোয়াল্ড ডাল লিখলেন এক অদ্ভুত ছোটগল্প। গল্পের নাম ‘উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি’। গল্পে দেখা যায় মৃত উইলিয়ামের মস্তিষ্ককে রিঙ্গার দ্রবণে চুবিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। মস্তিষ্কের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একটি চোখ এবং হৃদ্পিণ্ড। সবচেয়ে ভূতুড়ে ব্যাপার, মৃত উইলিয়ামের মস্তিষ্ক স্ত্রী মেরি পার্লের সঙ্গে কথা বলে।
সাহিত্যিকদের কল্পনায় এমনটা ঘটতেই পারে। কিন্তু বাস্তবে? খুলি থেকে বের করে উপযুক্ত দ্রবণে মস্তিষ্ককে সংরক্ষণ করার পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন নয়। তবে সেই মস্তিষ্ক কথা বলবে, এমনটা অলীক কল্পনা, গল্প-উপন্যাসের পাতার বাইরে সম্ভব নয়! ‘উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি’ প্রকাশিত হওয়ার ঠিক ৬০ বছর পরে অবশ্য এই ধারণা ভেঙে পড়ার মুখে। সান ডিয়েগো-র ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাল-এর কল্পনার অনেকটাই বাস্তবে পরিণত।
সেখানকার স্টেম সেল ইউনিটের গবেষণাগারে বিশেষ দ্রবণে চোবানো মস্তিষ্ক কথা বলা শুরু করেছে। তফাত হল, এই কথা বলা মস্তিষ্ক উইলিয়ামের মতো কোনও মৃত ব্যক্তির নয়। মানব কোষ থেকেই কৃত্রিম ভাবে তৈরি।
৩০ অগস্ট ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় টেলিভিশন একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে। সেখানে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় অ্যালিসন মুয়োত্রি-র কথায় ফুটে উঠছিল একরাশ বিস্ময়। তিনি বলছিলেন, ‘‘প্রেসিল্লা এবং ক্লেবার এসে যখন বলল, অরগ্যানয়েড-এ যুক্ত মাইক্রোইলেকট্রোড থেকে যা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তা মানুষের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিন প্রতিক্রিয়ার মতোই জটিল। আমি বিশ্বাস করিনি। ভাবছিলাম নিশ্চয়ই মাইক্রোইলেকট্রোড-এ কোনও গন্ডগোল হয়েছে। অথবা কম্পিউটারে কোনও ভাইরাস প্রবেশ করেছে। ফলে তথ্য বিশ্লেষণে কোনও ভুল হচ্ছে।’’ আসলে অ্যালিসন মুয়োত্রির গবেষণাগারেই ঘটেছে মস্তিষ্কের কথা বলার ঘটনা।
কোন ভাষায় কথা বলেছে মস্তিষ্ক? কোনও প্রচলিত ভাষায় নয়। মস্তিষ্কের কথা বলার ভাষা হল বৈদ্যুতিন সঙ্কেত। এই সঙ্কেতই মস্তিষ্কের ভাবনা, যা স্বরযন্ত্রের সাহায্যে আমরা নিজেদের ভাষায় ব্যক্ত করে থাকি। মুয়োত্রি-র গবেষণাগারের দুই পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক প্রেসিল্লা নেগ্রেস ও ক্লেবার ত্রুজ়িল্লো দীর্ঘ দিন ধরেই মানুষের দেহকোষ থেকে কৃত্রিম মস্তিষ্ক তৈরির চেষ্টায় সফল। তবে এই প্রথম বার তাঁদের তৈরি কৃত্রিম মস্তিষ্ক সত্যিকারের মানুষের মস্তিষ্কের মতো জটিল বৈদ্যুতিন প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহেই এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ‘সেল স্টেম সেল’ জার্নালে। তার পর থেকেই বিশ্ব জুড়ে জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে হইচই পড়ে গিয়েছে।
মুয়োত্রি ও তাঁর গবেষক দলের এই কৃত্রিম মস্তিষ্ক আসলে ঠিক কী? সহজ ভাষায়, মানুষেরই পরিণত দেহকোষকে কাজে লাগিয়ে ছোট পাত্রে (গবেষকেরা যাকে পেট্রিডিশ বলে থাকেন) মস্তিষ্কের কোষ তৈরি করা হয়েছে। সেই মস্তিষ্কের কোষগুলি নিজেরাই জুড়ে গিয়ে ছোট ছোট বলের আকার নিয়েছে। এই বলগুলিকে বলা হয় অরগ্যানয়েড। মস্তিষ্কের কোষ জুড়ে তৈরি এই অরগ্যানয়েডকে মিনি ব্রেনও বলা হয়।
দেহকোষ থেকে এই কৃত্রিম মিনি ব্রেন তৈরির পদ্ধতিটি খুব সহজ নয়। এই কাজে ব্যবহৃত হয় ইনডিউস্ড প্লুরিপোটেন্ট সেল (যে ধরনের স্টেম সেল যে কোনও দেহকোষ তৈরি করতে পারে) প্রযুক্তি। মাতৃগর্ভে যখন মানবদেহ বা অন্য কোনও প্রাণীর দেহ গঠন শুরু হয়, তখন প্রথম কাজ শুরু করে প্রোজেনিটর কোষ বা স্টেম সেলগুলি। স্টেম সেল বিশেষ ধরনের পরিণত কোষে পরিবর্তিত হয় এবং সেই কোষ বিভাজিত হয়ে এক-একটি বিশেষ অঙ্গ তৈরি করে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ডিফারেন্সিয়েশন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, লিভারের কোষ এবং মস্তিষ্কের কোষের যাত্রা শুরু হয় কোনও মূল কোষ থেকেই, তারা পরে আলাদা হয়ে যায়। এই যাত্রাকালে একাধিক জেনেটিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় কোষগুলি, নেপথ্যে কাজ করে একাধিক গ্রোথ ফ্যাক্টর নামক প্রোটিন। ভ্রূণ থেকে পূর্ণাঙ্গ দেহ গঠনে প্রোজেনিটর কোষ থেকে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোষ তৈরি করার গোটা পদ্ধতিটি একমুখী। অর্থাৎ, সাধারণত প্রোজেনিটর কোষ থেকে ডিফারেন্সিয়েটেড বা পরিণত কোষ তৈরি হয়, কিন্তু উল্টোটা হয় না। সহজ ভাবে বলা যায়, প্রোজেনিটর কোষগুলো কাঁচা মাটির মতো, যেগুলো থেকে মাটির ভাঁড়, পাত্র, মূর্তি গড়া যায়। এবং স্থিতিশীলতা প্রদান করার জন্য সেগুলিকে আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বস্তুর মূল উপাদান কাঁচা মাটি হলেও প্রতিটির পূর্ণাঙ্গ রূপ আলাদা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে বস্তুগুলিকে গলিয়ে কাঁচা মাটি তৈরি করা যায় না। ২০০৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানী শিনিয়া ইয়ামানাকা-র এক যুগান্তকারী আবিষ্কার বদলে দেয় এই একমুখী ধারণা। তিনি একগুচ্ছ বিশেষ ধরনের প্রোটিন আবিষ্কার করেন (ইয়ামানাকা ফ্যাক্টরস), যেগুলির পরিমাণ ও কার্যক্ষমতা অদলবদল করে ডিফারেন্সিয়েটেড কোষগুলিকে ফের প্রোজেনিটর কোষে পরিণত করা যায়। অর্থাৎ, কোষগুলি ফিরে যায় যাত্রা শুরুর প্রায় প্রথম অবস্থায়। এই ধরনের কোষগুলিকে বলা হয় ইনডিউস্ড প্লুরিপোটেন্ট সেল বা আইপিএসসি। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার ২০১২ সালে ইয়ামানাকাকে এনে দেয় নোবেল প্রাইজ।
মুয়োত্রি ও তাঁর দল মিনি ব্রেন তৈরিতে কাজে লাগিয়েছেন ইয়ামানাকার পদ্ধতি। তাঁরা ত্বকের কোষকে পরিণত করেছেন আইপিএসসিতে। তার পরে বিশেষ দ্রবণে আইপিএসসিগুলিকে পরিণত করা হয়েছে মস্তিষ্কের কোষে। তরলে ভাসমান কোষগুলিকে একটি নির্দিষ্ট গতিতে ঘোরালেই কিছু দিন পরে তৈরি হয় বলের মতো অর্গ্যানয়েড। আসলে সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষ যেমন জীবন ও জীবিকার স্বার্থে একজোট হয়ে বাস করতে চায়, তেমনই ভাসমান কোষগুলি নিজেদের মধ্যে তথ্য ও পুষ্টি আদানপ্রদানের জন্য গড়ে তোলে কলোনি। ভাসমান এই কলোনিগুলি ধীরে ধীরে কয়েক মাসের মধ্যেই ছোট পরিসরে তৈরি করে মস্তিষ্কের ছোট সংস্করণ।
মিনি ব্রেন তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল এক দশকেরও আগে। ২০০৮ সালে ‘সেল স্টেম সেল’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে ইয়োশিকি সাসাই প্রথম দেখান যে, ইয়ামানাকার পদ্ধতি ব্যবহার করে মস্তিষ্ক গঠনের প্রয়োজনীয় আইপিএসসি তৈরি করা যায় এবং ত্রিমাত্রিক কালচার পদ্ধতি ব্যবহার করে এই কোষগুলির কলোনি গঠন করা যায়। যদিও সাসাই মিনি ব্রেন কথাটি ব্যবহার করেননি।
২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত একের পর এক যুগান্তকারী গবেষণায় মিনি ব্রেন তৈরির পদ্ধতিকে স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণার নির্ভরযোগ্য মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন সাসিকি। দুঃখের বিষয়, ২০১৪ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন।
সাসাইয়ের কাজ থেকে মুয়োত্রি ও তাঁর দলের কাজ কোথায় আলাদা? এই প্রথম মিনি ব্রেন এমন জটিল বৈদ্যুতিন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যা মানব মস্তিষ্কের জটিল বৈদ্যুতিন প্রতিক্রিয়ার কাছাকাছি। দীর্ঘ ১০ মাস ধরে ভাসমান মস্তিষ্কের কোষগুলির কলোনি তৈরি ও তাঁর বিবর্তন নিরীক্ষণ করে বোঝা গিয়েছে কী ভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের কোষের সংখ্যা বাড়ে কমে। তবে সব কিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছে ১০ মাস বয়সের মিনি ব্রেনগুলির নিজেদের ভাষায় কথা বলে ওঠা। যে ভাষা হল জটিল বৈদ্যুতিন প্রতিক্রিয়া।
ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ এথিক্স কমিটির প্রধান মাইকেল কালিচম্যান অবশ্য এই গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, এই ধরনের গবেষণা ভবিষ্যতে নীতির প্রশ্নে বিদ্ধ হতে পারে। কালিচম্যান জানিয়েছেন, তিনি অত্যন্ত আশাবাদী এই গবেষণা মস্তিষ্কের গঠন বুঝতে, বিশেষ করে বিভিন্ন স্নায়ুজনিত রোগ নিরাময়ে সাহায্য করবে। কিন্তু যে হেতু মিনি ব্রেনগুলি মানব মস্তিষ্কের কাছাকাছি জটিল বৈদ্যুতিন সঙ্কেত দেখাতে শুরু করেছে, হয়তো ভবিষ্যতে গবেষণাগারেই এমন মস্তিষ্ক তৈরি হবে, যা মানব মস্তিষ্কের সমতুল্য। অর্থাৎ, মিনি ব্রেনগুলি ভাবতে শুরু করবে। তখন বাইরে মস্তিষ্কগুলির সঙ্কেত বা ভাবনাও বিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন। তখনই উঠবে নীতির প্রশ্ন।
কালিচম্যানের কল্পনায় রোয়াল্ড ডালের চেয়ে হয়তো এক ধাপ এগিয়ে যাবে বিজ্ঞান। টেবিলে রাখা পাত্রে বিশেষ দ্রবণে চোবানো মস্তিষ্ক কথা বলে উঠবে। তবে সেই মস্তিষ্ক উইলিয়ামের মতো কোনও মৃত ব্যক্তির নয়, হবে একেবারেই কৃত্রিম ভাবে তৈরি মিনি ব্রেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy