Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Buddhism

স্টেম সেল-এ যযাতির শাপমুক্তি

পুরাণের যযাতি আর আর পুরুর গল্পের কথাই ধরা যাক। রাজা যযাতি শুক্রাচার্যের অভিশাপে আজীবন জরা-প্রাপ্ত হন।

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২১ ০৫:২৩
Share: Save:

বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী, ব্যাধি এবং মৃত্যুকে বাদ দিলে জরাকেই মানুষের যাবতীয় কষ্টের উৎস বলা যেতে পারে। জরা বা বার্ধক্য যেন মানবজীবনে এক অভিশাপের মতো, নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ লাভের পথে অন্যতম অন্তরায়।

পুরাণের যযাতি আর আর পুরুর গল্পের কথাই ধরা যাক। রাজা যযাতি শুক্রাচার্যের অভিশাপে আজীবন জরা-প্রাপ্ত হন। শর্ত, কেউ যদি স্বেচ্ছায় যযাতির জরা গ্রহণ করতে সম্মত হয়, তবেই একমাত্র যযাতির শাপমুক্তি সম্ভব। কনিষ্ঠ-পুত্র পুরু পিতার সেই জরা গ্রহণ করে যযাতিকে শাপমুক্ত করেন। জরা মানবজীবনে এমন এক অভিশাপ, যা থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছে সকলেরই রয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্যাধি এবং মৃত্যুর মতো জরাও এক অনিবার্য সত্য রূপে নেমে আসে মানবজীবনে।

কিন্তু, মানুষ তো বরাবরই যা অনিবার্য, তার উপরে কেরামতি দেখিয়ে এসেছে। তাই তো সে কী ভাবে এই বয়সের গতিকে রোধ করা যায়, বা মন্থর করা যায়, তার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে বিজ্ঞানকে দোসর করে। সম্প্রতি এই কাজেই এক নতুন পথের দিশা পেয়েছেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের এক দল বিজ্ঞানী, যাঁদের পুরোভাগে রয়েছেন সেখানকার বিজ্ঞানী ওয়ান জু লি। গত বছর নভেম্বরে তাঁদের গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে স্টেম সেল পত্রিকায়।

মেসেনকাইম হল ভ্রূণের মেসোডার্ম-এর যে অংশ থেকে যোগকলা তৈরি হয়, সেই অংশটি। অস্থি, তরুণাস্থি থেকে শুরু করে রক্ত এবং লসিকা সংবহনতন্ত্র গঠনে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই মেসেনকাইমাল স্টেম সেল হল অস্থিমজ্জা থেকে উৎপন্ন এমন এক প্রকার মাল্টিপোটেন্ট বা বহু সম্ভাবনাময় কোষ, যা থেকে মানবদেহে একাধিক প্রকারের নির্ধারিত কোষের উৎপত্তি হতে পারে। এই পদ্ধতিটি বৈজ্ঞানিক মহলে ‘ডিফারেনসিয়েশন’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে মেসেনকাইমাল স্টেম সেল-এর সংখ্যাবৃদ্ধি বা প্রলিফারেশন-এর পরিবর্তে এক প্রকার কোষীয় রূপান্তর ঘটে, যার ফলেই মেসেনকাইমাল স্টেম সেল থেকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ইত্যাদি স্থানের বিভিন্ন প্রকারের নির্ধারিত কোষগুলি তৈরি হয়।

আমাদের বয়সের ভারে ক্রমশ ন্যুব্জ হয়ে পড়ার মূলে রয়েছে এই মেসেনকাইমাল স্টেম সেল-এরই বার্ধক্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু রাত-বিরেতের কাশিই বাড়ে না, পাল্লা দিয়ে শুরু হয়ে যায় মেসেনকাইমাল স্টেম সেল-এর বার্ধক্যের প্রক্রিয়াও। ক্রমশ মেসেনকাইমাল স্টেম সেলগুলি এমন এক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছোয়, যখন তার বৃদ্ধি বা রূপান্তর কোনওটাই আর হয় না, যাকে বলা হয় ‘রেপ্লিকেটিভ সেনেসেন্স’। সুতরাং, এই বার্ধক্যে পৌঁছোনো মেসেনকাইমাল স্টেম সেলগুলিকে কোনও ভাবে যদি পুনরুজ্জীবিত করা যায়, তা হলেই কেল্লা ফতে! আর সেই চেষ্টাতেই সফল হয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের বিজ্ঞানীদের দলটি। তাঁরা দেখিয়েছেন, কোষীয় পদ্ধতির সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে কী ভাবে কোষের বার্ধক্যের প্রক্রিয়ার গতি রুদ্ধ করা, এমনকি তাকে বিপরীতমুখী করে তোলাও সম্ভব।

মূল গবেষণায় তাঁরা মানুষের হাঁটু এবং কনুই অংশ থেকে সাইনোভিয়াল তরল আহরণ করে সেখানকার মেসেনকাইমাল স্টেম সেলগুলিকে ছ’টি পরিবর্তনকারী বা রিপ্রোগ্রামিং ফ্যাক্টর দ্বারা ‘ইনডিউসড প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল’ বা আইপিএসসি-তে পরিবর্তিত করেন, এবং তার পর সেই আইপিএসসিগুলোকে আবার মেসেনকাইমাল স্টেম সেল-এ রপান্তরিত করেন। এই পদ্ধতি কার্যত মেসেনকাইমাল স্টেম সেলগুলির পুনরুজ্জীবন ঘটায়, এবং দেখা যায় যে, বার্ধক্য সম্পর্কিত কোষীয় এবং আণবিক ক্রিয়াগুলো পরিবর্তিত বা রূপান্তরিত মেসেনকাইমাল স্টেম সেলগুলিতে অনেক কমে গিয়েছে। গবেষণা চালিয়ে তাঁরা দেখলেন, এর নেপথ্যে রয়েছে গাটা৬ প্রোটিনের সিগন্যালিং। গাটা৬ হল এমন একটি প্রোটিন, যা আমাদের পৌষ্টিকনালী, ফুসফুস এবং হৃৎপিণ্ডের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং একই সঙ্গে এর অধিক উৎপাদন মেসেনকাইমাল স্টেম সেলগুলির বার্ধক্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। পরীক্ষানিরীক্ষা করার সময় তাঁরা দেখলেন, পুনরুজ্জীবিত মেসেনকাইমাল স্টেম সেলগুলিতে গাটা৬ প্রোটিনের উৎপাদন বিস্ময়কর ভাবে কমে গিয়েছে, এবং একই সঙ্গে, সনিক হেডগেহগ (এসএইচএইচ) এবং ফক্সপি১ নামের আরও দুই প্রোটিনের উৎপাদন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এসএইচএইচ এবং ফক্সপি১ এই দু’টি প্রোটিনই মস্তিষ্ক, ফুসফুস এবং হৃৎপিণ্ড গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং সনিক হেডগেহগ জিন আবিষ্কারের জন্যই ১৯৯৫ সালে ক্রিশ্চিয়ান নিউশলেন ভোলহার্ড এবং এরিক উইশাস মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পান।

সুতরাং, এই গবেষণার মাধ্যমে প্রফেসর ওয়ান জু লি এবং তাঁর সহযোগীরা দেখিয়েছেন, কী ভাবে মেসেনকাইমাল স্টেম সেল-এর বার্ধক্য আমাদের জরা বা বার্ধক্যের প্রক্রিয়াকেও ত্বরান্বিত করে। এবং কী ভাবে রিপ্রোগ্রামিং-এর মাধ্যমে বয়সের গতিকে রোধ করে তাকে বিপরীতমুখী করে তোলা সম্ভব।

রাহুল দত্ত, গবেষক, বসু বিজ্ঞান মন্দির

অন্য বিষয়গুলি:

Buddhism Anti-aging
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy