জন্মের সময় সে আর ৮টার মতোই ছিল একেবারে সাদামাটা! অতি সাধারণ। তার 'রূপ' খুলেছিল প্রায় মাঝ বয়সে পৌঁছে! যে গ্ল্যামারে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সকলেরই।
কিন্তু পোড়া কপাল! সেই 'রূপ' আর তার কপালে সইবে না বেশি দিন। দ্রুত গ্ল্যামার হারাচ্ছে আমাদের সৌরমণ্ডলের ৬ষ্ঠ গ্রহ- শনি। তাকে ঘিরে থাকা অবাক করা একের পর এক বলয় (রিং) খুব দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। বলয়ে জমে থাকা বরফ অত্যন্ত দ্রুত হারে ঝরে পড়ছে শনির গায়ে। পিঠে। বলয় আর শনির মধ্যে থাকা মহাকাশে। হ্যাঁ, আমাদের সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে 'হ্যান্ডসাম' গ্রহ শনি এই ভাবেই তার যাবতীয় সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে।
'ক্যাসিনি' মহাকাশযানের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে এ কথা জানতে পেরেছে মেরিল্যান্ডে নাসার গর্ডার্ড স্পেস সেন্টারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস ও'দোনাঘুর নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল। যে গবেষকদলে রয়েছেন দুই অনাবাসী ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী এস আর রামানুজন ও অশ্বিন মলহোত্রও। তাঁদের গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল 'আইকারাস'-এ প্রকাশিত হয়েছে সোমবার (১৭ ডিসেম্বর)।
শনিতে বড়, চোখে পড়ার মতো বলয়ের সংখ্যা ৭ থেকে ৮টি। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে, ‘এ-রিং’, ‘বি-রিং’, সি-রিং’, ডি-রিং’, ‘ই-রিং’, ‘এফ-রিং’, ‘জি-রিং’, ‘এইচ-রিং’। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওই বড় বলয়গুলি ছাড়াও আরও ছোট ছোট কয়েকটি বলয় রয়েছে শনির।
১০ কোটি বছর পর শনি একেবারেই গ্ল্যামারহীন!
গবেষকরা ক্যাসিনি মহাকাশযানের পাঠানো তথ্য খতিয়ে দেখে জানতে পেরেছেন, আর বড়জোর ১০ কোটি বছর। তার পর আর একটিও বলয় থাকবে না শনির। তা হয়ে পড়বে একেবারেই গ্ল্যামারহীন!
কেন ও কী ভাবে রূপ হারাচ্ছে শনি? দেখুন নাসার ভিডিয়ো
গবেষকদলের অন্যতম সদস্য প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস আর রামানুজন ই-মেলে 'আনন্দবাজার ডিজিটাল'কে জানিয়েছেন, আমাদের সৌরমণ্ডল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথে এক দশক আগেই শনির 'পাড়া'র গা ঘেঁষে দৌড়নোর সময় নাসার দু'-দু'টি মহাকাশযান 'ভয়েজার-১' ও 'ভয়েজার-২'-এর 'নাকে'ও লেগেছিল শনির গ্ল্যামার হারানোর 'গন্ধ'। কিন্তু তারা ভাবতেও পারেনি শনির কপাল পুড়বে এত তাড়াতাড়ি! ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২ জানিয়েছিল, শনির বলয় ক্ষয়ে যাচ্ছে। তবে ৩০ কোটি বছর আগে তা উদ্বেগজনক ভাবে ক্ষয়ে যাবে না। তত দিন অটুট থাকবে শনির গর্বের গ্ল্যামার।
ঝমঝমিয়ে 'রিং রেন' হচ্ছে শনিতে!
রামানুজন বলেছেন, "ক্যাসিনি মহাকাশযান শনির বিষূব রেখার উপরে যে ভাবে তার একের পর এক বলয় থেকে জমা বরফ হু হু করে ছিটকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে, তাকে এক রকম বরফের বৃষ্টিই ('রিং রেন') বলা যায়। আর সেই বৃষ্টি এতটাই 'ঝমঝমিয়ে' পড়ে চলেছে, যে দু'টি 'ভয়েজার' মহাকাশযানের পাঠানো তথ্য থেকে যে হিসেব কষা হয়েছিল, তা ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, আর বড়জোর ১০ কোটি বছর। তার পর আর কোনও বলয়ই থাকবে না শনির। তার আগেও পুরোপুরি গ্ল্যামারহীন হয়ে পড়তে পারে শনি।"
সেই বৃষ্টি আধ ঘণ্টায় ভরিয়ে দেবে অলিম্পিকের সুইমিং পুল!
মূল গবেষক, নাসার গর্ডার্ড স্পেস সেন্টারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস ও'দোনাঘুর গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘শনির বলয়গুলি থেকে ঝমঝমিয়ে পড়া সেই বরফের বৃষ্টি আধ ঘণ্টায় ভরিয়ে দিতে পারে অলিম্পিকের আস্ত একটা সুইমিং পুল। এই ভাবে বরফের বৃষ্টি হয়ে চললে শনি তার সবক’টি বলয়ই হারিয়ে ফেলবে এক দিন।’’
শনির গ্ল্যামার এসেছিল মাঝ বয়সে!
শনির বয়স আমাদের গ্রহের ধারেকাছেই। ৪০০ কোটি বছরের বেশি। তার বলয় যে ভাবে দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে, তাতে বলা যায়, অল্প বয়সেই গ্ল্যামার হারিয়ে কিছুটা বুড়িয়ে যেতে পারে হ্যান্ডসাম শনি।
গবেষকদলের আর এক সদস্য কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অশ্বিন মলহোত্র বলছেন, "এমনও নয়, জন্মের পর অত সুন্দর বলয়গুলি ছিল শনির। তার শৈশবে কোনও বলয়ই ছিল না। বলা যায়, এক রকম মাঝ বয়সে পৌঁছনোর পর শনির বলয়গুলির জন্ম হতে শুরু করে। দেখা দেয় তার রূপের ঝিলিক! বলয়। আমরা দেখেছি, শনির বলয়গুলির বয়স খুব বেশি হলে ১০ কোটি বছর। তার মানে, একেবারে গোড়ার দিকের ডাইনোসররা তা দেখে থাকতে পারে। কিন্তু বলয় ছাড়া শনিকে দেখা এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি মানবসভ্যতার।"
শনির বিভিন্ন বলয়
আরও পড়ুূন- মিথেনেরই সমুদ্রে ভাসছে শনির চাঁদ টাইটান! মিলল প্রমাণ
আরও পড়ুূন- শনি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণাই বদলে দিল ক্যাসিনি, দেখুন কী ভাবে?
শনির সবক'টা বলয় কি হারিয়ে যাবে একই সঙ্গে?
অশ্বিন জানাচ্ছেন, না, তা হবে না। বৃষ্টির মতো বরফ ঝরে পড়তে পড়তে এখন যে দশা হয়েছে শনির 'সি-রিং' বা 'সি-বলয়'-এর, ১০ কোটি বছর তার সবচেয়ে পুরু 'বি-রিং' বা 'বি-বলয়'-এর সেই দশাই হবে। ফলে, ওই সময় তার গ্ল্যামার হারানোর প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে শনি।
কেন বরফের বৃষ্টি হচ্ছে শনির বলয়গুলি থেকে?
মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অধ্যাপক দেবেন্দ্র ওঝা বলছেন, ''ওই গ্রহের জোরালো অভিকর্ষ বল ও চৌম্বক ক্ষেত্রের টানেই বলয় থেকে বরফের বৃষ্টি হচ্ছে শনির বুকে। তবে সব সময় তা সমান হারে হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর যেমন এক বছর লাগে, তেমনই শনির লাগে প্রায় সাড়ে ২৯ বছর (২৯ বছর ৪ মাস)। ওই প্রদক্ষিণের সময় সূর্যের সঙ্গে তার কৌণিক অবস্থানে শনি কখন এই সৌরমণ্ডলের নক্ষত্রের কতটা কাছাকাছি আসছে বা থাকছে বা কত ক্ষণ থাকছে, তার উপরে ওই বরফ বৃষ্টির পরিমাণে বাড়া-কমা হওয়াটই স্বাভাবিক।"
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy