রজারের থিয়োরির এক অসাধারণ সৌন্দর্য এবং ছন্দ রয়েছে।
রজার পেনরোজকে অন্তরঙ্গ ভাবেই চিনি গত পঁচিশ বছরেরও ওপরে। কলকাতায় অনেক বার এসেছেন। কলকাতার মানুষেরা ওঁকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং একটা প্রাণের টান আছে। যখনই আমাদের দু’জনের কথা হয়েছে, তখনই অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জেনারেল থিয়োরি অব রেলিটিভিটির অলিগলিতে কত কী বিচিত্র বিশ্বজাগতিক তথ্য লুকিয়ে আছে সেটা নিয়ে আলোচনা হত। আইনস্টাইনের এই থিয়োরি রজার একেবারে গুলে খেয়েছেন এবং ভাল ভাবে হজমও করেছেন।
এই থিয়োরি থেকেই ব্ল্যাক হোলের উৎপত্তি। কিন্তু আইনস্টাইন এতে খুব একটা বিশ্বাস করতেন না। ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণ এতটাই বেশি যে কোনও কিছুই, এমনকি আলোর কণাও, এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। সেই জন্যই সে ব্ল্যাক বা কৃষ্ণ।
স্টিফেন হকিং, সবাই একবাক্যে তাঁকে চেনেন, রজার পেনরোজের থেকে বেশ ছোট বয়সে, আমার থেকে দু’তিন বছরের বড়। স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তখন ছাত্র সেখানে। পেনরোজ-হকিং সিঙ্গুলারিটি-ই বিশ্বজগতের আদি মুহূর্ত। সৃষ্টির প্রথম দামামা, বিগ ব্যাং। এ তত্ত্ব নেহাতই অঙ্কের, কতগুলি সমীকরণের সমাধানসূত্র। রজার পেনরোজ এই সিঙ্গুলারিটি-র বিশ্বজাগতিক বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন, স্থান ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে। সেই জন্যই বহু যুগ পরে এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে পেলেন নোবেল পুরস্কার, এই ক’দিন আগে। স্টিফেন হকিং বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো একই সঙ্গে নোবেল পেতেন। এখন তিনি একা ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেতে চিরনিদ্রায় তাঁর সমীকরণ নিয়ে।
স্টিফেন হকিং এবং রজার পেনরোজ। পেনরোজ-হকিং সিঙ্গুলারিটি-ই বিশ্বজগতের আদি মুহূর্ত। ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: আইনস্টাইনের সংশয় দূর করেই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল রজার পেনরোজের, সঙ্গে আরও দুই
অনেক বছর আগে রজার পেনরোজ এবং তাঁর স্ত্রী ভেনেসাকে ক্রিসমাসের সময় আমি দার্জিলিং নিয়ে গিয়েছিলাম ম্যাডাম তেন্ডুফলার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে, বিখ্যাত উইন্ডেমেয়ার হোটেলে। ভুটানের রাজকন্যা ম্যাডাম ওই হোটেলের মালিক এবং বেশ সাহেব ঘেঁষা। বেচারা ভেনেসা অসুস্থ হলেন পাহাড়ের উচ্চতার জন্য। হোটেল ছেড়ে দূরে যাওয়ার উপায় নেই। গপ্পে রজার এক দিন এক ঝরঝরে, মাতাল সমীরণে মত্ত দার্জিলিঙের সকালে শান্ত স্বরে তাঁর অত্যাধুনিক বিস্ময়কর চিন্তাধারা আমাকে বোঝাবার চেষ্টা শুরু করলেন, বিশ্বজগতের সৃষ্টির কি বিচিত্র রূপ। খটমট ভাষায় এই থিয়োরিটার নাম হল ‘কনফর্মাল সাইক্লিক কসমোলজি’ (সিসিজি)। বিগ ব্যাং-কে ডিঙিয়ে সময়ের অতীত এই থিয়োরি মানুষের দৃষ্টিকে টেনে নিয়ে যায়। মুহূর্তেই বোঝা গেল যে, এই থিয়োরির এক অসাধারণ সৌন্দর্য এবং ছন্দ রয়েছে। বলে রাখা প্রয়োজন, বৈজ্ঞানিকদের মাথায় যখন কোনও নতুন ভাবনা আসে, সেটা সফল হলে তাঁরা বা আমরাও গবেষণা প্রবন্ধ লিখি এবং ভাল কোনও পত্রিকায় সেটা ছাপাই। কিন্তু রজার পেনরোজ তো সাদামাটা বৈজ্ঞানিক নন। উনি এই অভাবনীয় ভাবনাকে রূপ দিলেন একটি বইয়ে। ‘সাইকেল্স অব টাইম— অ্যান এক্সট্রাঅর্ডিনারি নিউ ভিউ অব দি ইউনিভার্স’। ২০১০ সালে ‘বোডলে হেড’ থেকে এটি প্রকাশিত হয়।
ব্যাপারটা হল এই।
আমাদের এই বিশ্বজগতের বয়স ১,৪০০ কোটি বছর। এর সৃষ্টি হয়েছিল বিগ ব্যাং, এক অকল্পনীয় শক্তি ফেটে গিয়ে। কিন্তু এই শক্তি এল কোথা থেকে?
রজার পেনরোজ বোঝাচ্ছেন যে, বিগ ব্যাংয়েরও আগে আর একটি বিশ্বজগৎ ছিল, আর একটি বিশ্বজাগতিক যুগে। সেই বিশ্বজগৎ সময় ও কালের সঙ্গে, আমাদের এই বিশ্বজগতের মতনই ফুলছে, যেমন হাওয়া দিলে বেলুন ফোলে। বিশ্বজগৎ ‘এক্সপ্যান্ড’ করছে ওই আদি শক্তির চাপে। এই পদ্ধতি চলতে চলতে এমন একটা সময় আসবে যখন বিশ্বজগতের সব শক্তি বিলুপ্ত হয়ে অসম্ভব ঠান্ডা হয়ে কবরজগৎ হবে। এতই ঠান্ডা হবে যে ব্ল্যাক হোলগুলি, কোটি কোটি বিশ্বজগতের তাপমান থেকেও কিঞ্চিৎ গরম থাকবে— তখন এই কোটি কোটি ব্ল্যাক হোল থার্মোডায়নামিক্সের দ্বিতীয় আইন অনুসারে একসঙ্গে ফাটবে। সেই হল দ্বিতীয় বিশ্বজগতের সৃষ্টির বিগ ব্যাংয়ের শক্তির উৎস। আর এক বিশ্বজাগতিক যুগের শুরু। এক যুগ থেকে আর এক যুগ। এই ধ্বংস আর সৃষ্টির তাণ্ডব নৃত্য। আমার শুনে মনে হল, ভাগবৎ গীতার কথা, যুদ্ধের আগে। রজার পেনরোজ মনে হল সেটা জানেন।
রজার পেনরোজ বোঝাচ্ছেন যে, বিগ ব্যাংয়েরও আগে আর একটি বিশ্বজগৎ ছিল, আর একটি বিশ্বজাগতিক যুগে। ছবি: শাটারস্টক।
আরও পড়ুন: সূর্যের থেকেও দূরের গ্রহাণুকে ছোঁবে সভ্যতা, তুলে আনবে তার ‘মাংস’
ঠিক আছে রজার, কিন্তু প্রমাণ কী, এই সব উদ্ভট ভাবনার? মার্চ ২০২১, আমি রজার পেনরোজকে নেমন্তন্ন করেছি একটি আন্ত্রজাতিক সম্মেলনে। এটা আগে জুন মাসে হওয়ার কথা ছিল। সেটা হয়নি। উনি এক কথায় রাজি হয়েছেন। এবং নিশ্চয়ই আসছেন বলে ক’দিন আগেও আমাকে টেলিফোনে আশ্বাস দিলেন। আমার যথেষ্ট সম্মানের ব্যাপার।
‘‘আর উই সিইং হকিং পয়েন্টস ইন দ্য মাইক্রোওয়েব স্কাই?’’ যাঁরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁরা কি কিছু দেখেছেন যে এই বিশ্বজগতের আগে বিগ ব্যাংয়ের অতীতে আর একটি বিশ্বজগৎ ছিল? ‘হকিং পয়েন্টস’, অত্যন্ত বড় ব্ল্যাক হোল, ১০০ কোটি সূর্যের সমান, গত অতীতের বিশ্বজাগতিক যুগে গোটা গ্যালাক্সিটিকে গিলে খেয়ে নিয়েছে তার খিদে মেটানোর জন্য। তার পরেই হকিং বিকিরণে সব শক্তির বিলোপ হয়ে যায়। আর ছোট্ট হকিং পয়েন্টে পরিণত হয়। আমাদের চাঁদের ৮ গুণ বড় এই পয়েন্ট। অত্যাশ্চর্য ব্যাপার— এই হকিং পয়েন্টগুলির অস্তিত্ব আমরা দেখেছি, এই হল চরম প্রমাণ।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বজগতে আদি বা অন্ত বলে কিছু নেই। সময়ের না আছে শুরু, না আছে শেষ। স্থানের নেই শুরু, নেই শেষ। নিরন্তর তারা অতিবাহিত হচ্ছে ধ্বংস আর সৃষ্টির মাধ্যমে।
শেষে বলি, বিগ ব্যাং রইল। কিন্তু সেটা শেষ কথা নয়। অনন্ত কালে অনন্ত বিগ ব্যাং হয়েছে, হবে।
রজার পেনরোজ এক জন অসাধারণ বৈজ্ঞানিক। তাঁর কল্পনার জগৎ বিস্তৃত বিশ্বজগতে। কিন্তু মানুষটি ভদ্র, নম্র, গপ্পে, অহঙ্কারের লেশ মাত্র নেই তাঁর ব্যক্তিত্বে।
(লেখক প্রবীণ পরমাণু বিজ্ঞানী, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রাক্তন অধিকর্তা)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy