গত শতকের সত্তরের দশকে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে আলোড়ন তুলেছিল এরিক ফন দানিকেন-এর কিছু কল্পবিজ্ঞানের বই। সারা পৃথিবীতে বইগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বত্রিশটা ভাষায় অনূদিত হয়। জার্মান ভাষা থেকে অজিত দত্তের বাংলায় অনূদিত এই লেখকের একের পর এক বই বাংলার আপামর জনগণ গোগ্রাসে গিলেছিল। এর মধ্যে ‘দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ’ বইটি ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাঁর মতে, দেবতা আসলে ভিনগ্রহবাসী এক সুসভ্য প্রাণী, যারা পৃথিবীতে এসে এখানকার মানুষকে সভ্যতার আলো দেখিয়েছে। বিজ্ঞানী মহলে দানিকেনের যুক্তি অগ্রাহ্য হয়েছে ‘নকল বিজ্ঞান’ হিসেবে। সম্প্রতি ভারতেও নকল বিজ্ঞানের বাড়বাড়ন্ত। এক জন তো বলেই দিলেন, বাঁদর থেকে কেউ কখনও মানুষ জন্মাতে দেখেনি, তাই ডারউইনের বাঁদর থেকে মানুষের বিবর্তন সত্যি নয়।
বিভিন্ন ধর্মে প্রাণী ও মানুষের আবির্ভাব নিয়ে নানা রকম মন্তব্য আছে, যার মধ্যে কোনও রকম বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। দুঃখের বিষয়, চার্লস ডারউইনের প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তনবাদ তথ্য প্রকাশের ১৬০ বছর পরেও এই সংশয়। এই সংশয়ের মূল প্রতিপাদ্য দু’টি, প্রাণের উদ্ভব কি কোনও অলৌকিক ঘটনা? তা ছাড়া, বিবর্তনের মাধ্যমে উন্নততর প্রজাতির উদ্ভবে ঈশ্বরের, নিদেনপক্ষে ভিনগ্রহের কোনও উন্নততর প্রাণীর কি ভূমিকা আছে? এ সব প্রশ্ন নিয়ে জোর বিতর্ক।
১৮৪৪ সালে বিজ্ঞানী জোসেফ ডালটন হুকারকে এক চিঠিতে ডারউইন জানান, সম্ভবত প্রাণের উদ্ভব অ্যামোনিয়া ও ফসফেট লবণ মিশ্রিত উষ্ণ এক জলাশয়ে, এবং আলো, তাপ ও বিদ্যুতের সহায়তায় রাসায়নিক যৌগ প্রোটিন পদার্থ তৈরি হয়ে। এর আগে সে রকম পরিবেশ ছিল না এবং পরবর্তী কালেও আর হবে না। তার মানে আর নতুন করে প্রাণের সৃষ্টি হবে না এই পৃথিবীতে। প্রায় চারশো কোটি বছর আগে যা সৃষ্টি হয়েছে এবং তা থেকে বিবর্তনের ফলে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তা নিয়েই খুশি থাকতে হবে। অবশ্য বিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে চলতে থাকবে।
প্রাণ রহস্য ব্যাখ্যার এখনও পর্যন্ত কোনও সুনির্দিষ্ট মডেল নেই। প্রাণের প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদান হল, অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন এবং নাইট্রোজেন। এর সঙ্গে আরও কিছু মৌলিক উপাদান মিশে প্রোটিন ও নিউক্লিক অ্যাসিড তৈরি করে, যা যে কোনও জীবের মূল উপাদান। বিভিন্ন প্রোটিনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য (গঠনগত বা কার্যগত) জীবের গঠন ও কাজকে নির্দেশ করে। প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে নিউক্লিক অ্যাসিড।
যে কোনও ধরনের কোষে মূলত দু’ধরনের নিউক্লিক অ্যাসিড থাকে— ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ এবং রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ। ডিএনএ চার রকমের নিউক্লিয়োটাইড বেস জুড়ে তৈরি হয়— অ্যাডেনিন, থাইমিন, গুয়ানোসিন এবং সাইটোসিন। আরএনএ-র ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র থাইমিনের বদলে থাকে ইউরাসিল। এই নিউক্লিয়োটাইড বেসগুলোকে জুড়ে রাখে শর্করা ও ফসফরিক অ্যাসিডের তৈরি একটি শৃঙ্খল।
কোষের মধ্যে প্রোটিন তৈরির দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে, ট্রান্সক্রিপশন ও ট্রান্সলেশন। ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতিতে ডিএনএ থেকে তৈরি হয় এম-আরএনএ। সুতোর মতো এম-আরএনএ লবঙ্গ পাতার মতো টি-আরএনএ-র সঙ্গে জুড়ে এক-একটি অ্যামাইনো অ্যাসিডকে নিমন্ত্রণ করে আনে জুড়ে যাওয়ার জন্য। তৈরি হয় পলিপেপটাইড। এই পলিপেপটাইডগুলি বিশেষ পদ্ধতিতে ভাঁজ হয়ে তৈরি হয় প্রোটিন।
সৃষ্টির শুরুতে এককোষী জীব সৃষ্টির সময় এই সব ক’টি পদ্ধতিই সমান দায়িত্ব পালন করেছে। তবে ডিএনএ-র আরও একটি ধর্ম প্রাণ সৃষ্টিতে ও প্রাণের বিস্তারে কাজে এসেছে— রেপ্লিকেশন। রেপ্লিকেশন পদ্ধতিতে ডিএনএ সংখ্যায় দ্বিগুণ হতে পারে। এককোষী প্রাণী রেপ্লিকেশন পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ডিএনএ বা জেনেটিক পদার্থের পরিমাণ দ্বিগুণ করে নেয় এবং কোষ বিভাজনের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। বহুকোষী প্রাণী রেপ্লিকেশন পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দেহে নতুন কোষ তৈরি করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ডিএনএ ও আরএনএ অণুর গঠনের আবিষ্কার, রেপ্লিকেশন, ট্রান্সক্রিপশন, ট্রান্সলেশন পদ্ধতির আবিষ্কার জন্ম দেয় মলিকিউলার বায়োলজির মতো বিষয়। সত্তরের দশকের পর থেকে শুরু হয় মলিকিউলার ইভল্যুশন নিয়ে গবেষণা। জুড়ে যায় বিবর্তনের তত্ত্ব ও মলিকিউলার বায়োলজি। ‘দ্য সেলফিশ জিন’-খ্যাত রিচার্ড ডকিন্স একের পর এক প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বই প্রকাশের মাধ্যমে প্রাণ সৃষ্টি বা বিবর্তনে অলৌকিক ঘটনার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করেন। প্রশ্ন ওঠে, এর পরেও প্রাণের সৃষ্টিতে ঈশ্বর বা ভিনগ্রহের প্রাণীর ভূমিকা জাতীয় ধ্যানধারণা কী ভাবে টিকে রয়েছে?
দু’টি বিষয় নিয়ে এখনও রয়ে গিয়েছে ধোঁয়াশা। প্রথমত, কোনও প্রজাতির জীব থেকে অন্য প্রজাতি সৃষ্টির বিষয়টিকে মলিকিউলার বায়োলজি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারেনি। ডিএনএ-র যে কোনও রকম গঠনগত পরিবর্তন (মিউটেশন) বদলে দিতে পারে প্রোটিন তৈরির গোটা প্রক্রিয়া, জন্ম দিতে পারে সম্পূ্র্ণ নতুন ধরনের প্রোটিনের। কোটি কোটি বছর ধরে ঘটা একাধিক মিউটেশনই একটি প্রজাতি থেকে আর একটি প্রজাতির জন্ম দিয়েছে। যেমন, কোনও একটি বিশেষ মিউটেশনই ডাইনোসর থেকে পাখি সৃষ্টির পথ ঠিক করে দিয়েছিল। মানুষের ক্ষেত্রে ঠিক কোন মিউটেশন বিবর্তনের জন্য দায়ী, তা নিয়ে গবেষণা এখনও জারি।
দ্বিতীয়ত, ঠিক কী ভাবে পৃথিবীতে প্রাণ সঞ্চার হয়েছিল, তা নিয়ে রয়েছে একাধিক তত্ত্ব। রসায়নবিদদের মতে, ডিএনএ ও প্রোটিন তৈরি হওয়ার অনেক আগেই আদিম পৃথিবীর সমুদ্রে আরএনএ ভেসে বেড়াত। এর পর ডিএনএ ও প্রোটিন তৈরি হয়ে প্রাথমিক কোষের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ডিএনএ এবং প্রোটিন কী ভাবে তৈরি হল, সে বিষয়ে গবেষণা এগোলেও ঠিক কারণ জানা নেই। কারণ, ডিএনএ থেকে প্রোটিন তৈরিতেও প্রয়োজন প্রোটিনের, যাদের বলা হয় ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর। তা এল কোথা থেকে? অন্য এক তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রাণ বহন করে নিয়ে এসেছিল কোনও উল্কাপিণ্ড বা ধূমকেতু। এ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।
আধুনিক বিজ্ঞানের প্রাণসৃষ্টি ও বিবর্তন ব্যাখ্যায় কোনও একটি তত্ত্ব বা ইউনিফায়েড থিয়োরি তৈরিতে ব্যর্থতা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি ও ধর্মীয় বিশ্বাস বাঁচিয়ে রেখেছে প্রাণ সৃষ্টিতে ঈশ্বর বা ভিনগ্রহের প্রাণীর ভূমিকার মতো মিথ। যেমন, ভারতের ধর্মীয় পণ্ডিতেরা মনে করে এসেছেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অবতারেরা নিম্নশ্রেণির প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়ে উচ্চশ্রেণির প্রাণী ছাড়া আর কেউই নয়। যদিও ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলিতে কোথাও পাওয়া যায় না যে বাঁদরের গর্ভে মানুষ জন্মাতে দেখা যায় না বলে ডারউইনের বিবর্তনের তথ্য ভুল। অন্য সভ্যতা এবং সংস্কৃতিতেও এই ধরনের মিথেরা এখনও বেঁচে রয়েছে। সেটাই দুর্ভাগ্য ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy