এই ভাবে সূর্যকে দিয়ে ভিনগ্রহ খোঁজাবে নাসা।
সূর্য আর আইনস্টাইন।
ভিনগ্রহে প্রাণ খুঁজতে এ বার কাজে লাগানো হবে দু’জনকেই। একই সঙ্গে।
নতুন টেলিস্কোপ বানাতে এ বার একই সঙ্গে দু’জনকে কাজে লাগাতে চায় নাসা। যাতে তড়িঘড়ি প্রাণ খুঁজে পাওয়া যায় এই সৌরমণ্ডলের বাইরে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে থাকা ভিনগ্রহে (এক্সট্রা-সোলার প্ল্যানেটস বা এক্সোপ্ল্যানেটস)।
গত সপ্তাহে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির বৈঠকে নাসার তরফে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ‘প্ল্যানেটারি সায়েন্স ভিশন ২০৫০’ শীর্ষক রিপোর্টে। যা তৈরি করেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানী লিওন অ্যালকালাইয়ের নেতৃত্বে নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) একটি গবেষকদল। যার অন্যতম দুই ভারতীয় নিতিন অরোরা ও এম দেশাই।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লদিয়ো ম্যাকোনের বইয়ে যে ছবি আঁকা হয়েছিল ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্স টেলিস্কোপ’-এর
কী বলা হয়েছে নাসার সেই রিপোর্টে?
নতুন টেলিস্কোপের লেন্স হবে সূর্য (ওপরে), গত সপ্তাহে দেওয়া নাসার সেই রিপোর্ট (নীচে)
আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির অন্যতম সদস্য আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যানেটারি সায়েন্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বিষ্ণু রেড্ডি আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, ‘‘নাসার ওই রিপোর্টে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, পৃথিবী থেকে প্লুটো যতটা দূরে রয়েছে, তার ১৪ গুণেরও বেশি দূরত্বে বসানো হোক ওই টেলিস্কোপ। তার মানে, আমাদের সৌরমণ্ডলের পাঁচিল টপকে সেই টেলিস্কোপটা বসানো হবে আন্তর্নক্ষত্রমণ্ডল বা ইন্টারস্টেলার ক্লাউডে। ৫০ বছর আগে মহাকাশে পাঠানো নাসার মহাকাশযান ‘ভয়েজার-১’ আজ থেকে ৪০ বছর পর গিয়ে পৌঁছবে যে-দূরত্বে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের স্কেলে ৫৫০ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট বা, এইউ (পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বকে ধরা হয় এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট)। আর সেই অসম্ভব রকমের শক্তিশালী টেলিস্কোপের ম্যাগনিফাইং লেন্সটা হবে সূর্য। ওই সূর্যের ‘চোখ’ দিয়েই ব্রহ্মাণ্ডের একটা অংশে খোঁজা হবে ভিনগ্রহ। জানার চেষ্টা হবে কতটা তেতে রয়েছে সেই ভিনগ্রহগুলির ভূপৃষ্ঠ (সারফেস টেম্পারেচার)। কতটা বাসযোগ্য সেই ভিনগ্রহগুলির বায়ুমণ্ডল (হ্যাবিটেব্ল অ্যাটমস্ফিয়ার)। বহু দিন আগে সূর্যকে দিয়ে ভিনগ্রহ খোঁজার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইতালিয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লদিয়ো ম্যাকোনে।’’
ঘটনা হল, এই অভিনব টেলিস্কোপ বানাতে আবার আইনস্টাইনের কাছেই ফিরে যেত হচ্ছে নাসাকে! আজ থেকে ১০০ বছর আগে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ডের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়ানো আলোর ‘রুট’টাকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দিতে পারে যে কোনও মহাজাগতিক বস্তুর অভিকর্ষ ক্ষেত্র। যত ভারী হবে সেই মহাজাগতিক বস্তু, তত বেশি করে তা বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দেবে ব্রহ্মাণ্ডে ছুটে বেড়ানো আলোকে। আর সেই কাজটা করার জন্য সূর্যের চেয়ে বড় ‘প্লেয়ার’ আর কেই-বা আছে আমাদের হাতের কাছে!
সূর্য আর আইনস্টাইনকে একই সঙ্গে কাজে লাগিয়ে ওই অভিনব টেলিস্কোপ দিয়ে নতুন নতুন ভিনগ্রহের জন্য জোর তল্লাশি চালানো হবে যে-পদ্ধতিতে, তার নাম- ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’।
গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং টেলিস্কোপ কাজ করে যে ভাবে
‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’ কী জিনিস?
মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের (টিআইএফআর) জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দেবেন্দ্র ওঝার ব্যাখ্যা, ‘‘ধরুন, টানটান করে চাদর পাতা রয়েছে বিছানায়। আর তার ওপর একটা বল গড়াচ্ছে। এ দিক থেকে ও দিকে। এ বার বিছানার মাঝখানে একটা গর্ত বানানো হল। আর তার ফলে বিছানায় টানটান করে পাতা চাদরটা বেশ কিছুটা কুঁচকে গেল। গর্তটা যত বড় আর গভীর হবে, চাদরটা তত বেশি করে কুঁচকে যাবে। এই যে গর্তটা তৈরি হল আর তার জন্য বিছানায় টানটান করে পাতা চাদরটা কুঁচকে গেল, তার ফলে বিছানায় গড়ানো বলটা ওই গর্তটার দিকে সরে আসতে থাকল। গর্তটা যত বড় হবে আর তার জন্য বিছানার চাদরটা যত বেশি কুঁচকে যাবে, বলটা তত বেশি করে ওই গর্তটার দিকে সরে আসতে থাকবে। বলটা হালকা হলে সেটা আরও আরও বেশি করে সরে আসতে থাকবে সেই গর্তটার দিকে। এমনকী, তা এক সময় গর্তে পড়েও যেতে পারে। এ বার ওই গর্তটাকে সূর্য বলে ধরে নেওয়া যাক। যে টানে সূর্য তার গ্রহগুলিকে ধরে রাখে, তার চার পাশে ঘোরায় নিয়মিত, সেটাই তার অভিকর্ষ ক্ষেত্র। মাঝখানে গর্তের জন্য বিছানায় টানটান করে পাতা চাদরটা যে ভাবে কুঁচকে যায়, সূর্যের অভিকর্ষ ক্ষেত্রও ঠিক সেই ভাবেই বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দেয় তার আশপাশে থাকা ব্রহ্মাণ্ডের স্পেস-টাইম বা স্থান-কালকে। এ বার বিছানায় গড়ানো বলটাকে আলো বলে ধরে নেওয়া যাক। বিছানার মধ্যিখানে গর্তটা যত বড় আর গভীর হবে, ততই বেশি করে কুঁচকে যাবে টানটান করে পাতা চাদরটা। আর বলটা তত বেশি করে এগিয়ে আসবে গর্তটার দিকে। সূর্যের ভর বেশি বলে তার অভিকর্ষ ক্ষেত্রও খুব জোরালো। সেই জোরালো অভিকর্ষ বল তার আশপাশের স্পেস-টাইমকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দেয় অনেকটাই। তার ফলে, ব্রহ্মাণ্ডের সুদূরতম প্রান্ত থেকে ছুটে আসা আলো সেই বাঁকানো-চোরানো স্পেস-টাইমের কাছে এসে প্রতিসৃত হয়ে আরও বেশি করে সরে আসবে সূর্যের কাছে। ফলে, যে উৎস থেকে বেরিয়ে বা যে মহাজাগতিক বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়ে সেই আলোটা আসছে, তাকে দেখাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। অনেক স্পষ্টতর হবে। খুব টিমটিমে আলো বলে যে মহাজাগতিক বস্তুর হদিশ মিলছিল না ঠিকঠাক ভাবে, তা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। ফলে, মহাজাগতিক বস্তুটিকে দেখতে, চিনতে, বুঝতে অনেক বেশি সুবিধা হবে। এটাকে বলে ‘সোলার গ্র্যাভিটেশনাল লেন্স’ (এসজিএল)। এই ভাবেই ‘কেপলার-৪৫২-বি’ ভিনগ্রহটির হদিশ মিলেছিল।’’
(বাঁ দিক থেকে) ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লদিও ম্যাকোনে, নাসার ভারতীয় গবেষক নিতিন অরোরা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী লিওন অ্যালকালাই
বিগ ব্যাং-এর (সাদা আলো) পর যে ভাবে পর্যায়ে পর্যায়ে গড়ে উঠেছে ব্রহ্মাণ্ড
এর ফলে ভিনগ্রহ খোঁজার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাটা কী?
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমরা এখন যে সব টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশে পর্যবেক্ষণ চালাই, তার লেন্সের যা ক্ষমতা (যার একক- পিক্সেল), ‘সোলার গ্র্যাভিটেশনাল লেন্স’-এর ক্ষেত্রে তা বেড়ে যাবে অন্তত ১০ লক্ষ গুণ! এর ফলে, ১০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা ভিনগ্রহগুলিরও ১০ কিলোমিটার বর্গ এলাকা খুব স্পষ্ট ভাবেই দেখা যাবে। ফলে, তাদের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাপতে বা তাদের বায়ুমণ্ডলকে ঠিকঠাক ভাবে বোঝার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।’’
আরও পড়ুন- ইনসুলিন-ছুঁচ থেকে মুক্তির দিশা দেখাল বিজ্ঞান
ছুঁচ না ফুটিয়েই শিশুদের দেওয়া যাবে যে কোনও ধরনের টিকা?
এই পদ্ধতির অসুবিধাগুলি কী কী?
আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যানেটারি সায়েন্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বিষ্ণু রেড্ডি বলছেন, ‘‘অসুবিধা মূলত, রয়েছে দু’টি। এক, দূরত্ব। যে-দূরত্বে টেলিস্কোপটি বসানোর প্রস্তাব দিয়েছে নাসা (৫৫০ এইউ), গত ৫০ বছর ধরে মহাকাশে ছুটে বেড়ানোর পরেও মহাকাশযান ‘ভয়েজার-১’ তার মাত্র ৩.৩ ভাগ দূরত্ব (১৩৭ এইউ) পেরোতে পেরেছে এখনও পর্যন্ত। দুই, এই পদ্ধতিতে মহাকাশের খুব সামান্য একটা অংশের বেশি পর্যবেক্ষণ চালানো যাবে না।’’
ছবি সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy