প্রতীকী ছবি।
টিকা দিয়েই এ বার সারানো যাবে ক্যানসার? কম খরচেই ক্যানসারের চিকিৎসা সম্ভব হবে?
প্রয়োজন হবে না আর অস্ত্রোপচার বা টার্গেটেড কেমোথেরাপির?
ইঁদুরের উপর টিকা দিয়ে ক্যানসার ‘সারানো’র পরীক্ষা সফল হওয়ার পর মানুষের একটি বিশেষ ধরনের ক্যানসার (লিম্ফোমা)-ও তাতে সারানো যায় কি না, এই জানুয়ারিতে তার পরীক্ষানিরীক্ষা (হিউম্যান ট্রায়াল) শুরু হয়েছে।
গবেষণাটি হয়েছে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক রোনাল্ড লেভির নেতৃত্বে। গবেষণাপত্রটি ছাপা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন’-এ। ৩১ জানুয়ারি সংখ্যায়।
গবেষকরা দেখেছেন, ইঁদুরের শরীরে গজিয়ে ওঠা টিউমারের আশপাশে থাকা বিশেষ ধরনের একটি রোগ প্রতিরোধী কোষ (টি-সেল)-কে আরও সক্রিয় করে তোলা সম্ভব হচ্ছে ওই টিকা দিয়ে।
সেই টিকা বানানো হয়েছে খুব সামান্য পরিমাণে নেওয়া দু’টি রাসায়নিক যৌগ (ইমিউন স্টিম্যুলেটিং এজেন্ট) দিয়ে।
ক্যানসার টিকা: কী বলছেন কলকাতার বিশেষজ্ঞরা?
টিকা দিয়ে ক্যানসার সারানোর গবেষণা খুব নতুন কিছু নয়। ৭/৮-এর দশক থেকেই সেই গবেষণা চলছে। বহু ক্ষেত্রে অনেক দিন পর সেই ক্যানসার আবার হতে দেখা গিয়েছে। দেখা গিয়েছে অন্য ধরনের ক্যানসার হতেও।
কলকাতার বিশিষ্ট অঙ্কোলজিস্ট সোমনাথ সরকার বলছেন, ‘‘দেখা গিয়েছে, টিকা দিয়ে কোনও ক্যানসার হয়তো কিছু দিনের জন্য সারল। পরে সেই ক্যানসার বা অন্য ধরনের ক্যানসার হয়েছে। টিকা দেওয়ায় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ারও জোরালো সম্ভাবনা থাকে।’’
এখনও পর্যন্ত ৪০০ রকমের ক্যানসারের হদিশ মিলেছে। টিকায় সব ধরনের ক্যানসারই সারবে, সেই নিশ্চয়তা এখনও পাওয়া যায়নি, এমনটাই দাবি কলকাতার ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
শোনা যাচ্ছে ভিন্ন সুরও...
সোমনাথ অবশ্য এও বলছেন, ‘‘ইঙ্গিত মিলল, এই পদ্ধতিতে গোটা শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা (বডি ইমিউনিটি)-টাকে আরও জোরালো, জোরদার করে তোলা যায়। আর সেই ভাবে টিউমার কোষগুলিকে ধ্বংসও করা যায়। আমার কিন্তু এই গবেষণাটিকে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক বলেই মনে হয়েছে। আগামী দিনে ক্যানসার চিকিৎসায় এই পদ্ধতি মিরাকল ঘটিয়ে দিতে পারে।’’
গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?
মূল গবেষক স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেভি অবশ্য বলেছেন, ‘‘এর আগে যে সব টিকা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে, সেগুলি গোটা শরীরে কার্যকর করার চেষ্টা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা টিকা দিয়েছি শুধুই টিউমারের আশপাশের এলাকার বিশেষ ধরনের কোষ টি-সেলে। দেখেছি, অনেক ধরনের ক্যানসারই তাতে সেরে যাচ্ছে।’’
আরও পড়ুন- বৃহস্পতির চাঁদে প্রাণ আছে? বাঙালির চোখে খুঁজে দেখবে নাসা
এই পদ্ধতিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘লোকালাইজড অ্যাপ্রোচ অফ ভ্যাকসিনেশন’।
গবেষকদের দাবি, এই পদ্ধতিতে ক্যানসার অনেক দ্রুত সারে। টিকা বানানোর জন্য দু’টি রাসায়নিক যৌগ (স্টিম্যুলেটিং এজেন্ট)-এরও প্রয়োজন হয় খুব অল্প পরিমাণে। এজেন্টগুলি এক বার প্রয়োগ করলেই কাজ হয়। তাই ওই স্টিম্যুলেটিং এজেন্টগুলি থেকে পরে শরীরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। অস্ত্রোপচার বা টার্গেটেড কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয় না।
টিকা তো আমরা রোগের আগে দিই, তা হলে এটা কেন টিকা?
সোমনাথের কথায়, ‘‘ছোট একটা জায়গায় এই টিকা দেওয়ার ফলে তা গোটা শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাটাকেই ফুল-প্রুফ করে তুলছে। আর এটাই এই পদ্ধতিটাকে মিরাকল করে তুলল বলে আমার মনে হচ্ছে।’’
ক্যানসার: এখন কেন গুরুত্ব পাচ্ছে জিন?
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ স্থবির দাশগুপ্ত, গৌতম মুখোপাধ্যায় সহ কলকাতার বিশিষ্ট অঙ্কোলজিস্টদের একটি অংশ অবশ্য বলছেন, ক্যানসারে আমরা কেউই আক্রান্ত হই না। তার কারণ নিহিত থাকে আমাদের শরীরেই। জিনের মধ্যে। আমাদের শরীরে যে ২০ হাজারেরও বেশি প্রোটিন রয়েছে, তাদের ক্ষরণের বাড়া-কমার উপরেই নির্ভর করে শরীরের কোথায় কোন ক্যানসার হবে। এখনও পর্যন্ত যে ৪০০ রকমের ক্যানসারের হদিশ মিলেছে, দেখা গিয়েছে, কম-বেশি ৭৩টি প্রোটিনের ক্ষরণের বাড়া-কমার জন্যই সেগুলি হয়। আর বিভিন্ন জিনই সেই প্রোটিনগুলির গঠন, আচার-আচরণ, মতিগতি, ক্ষরণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।
স্থবির বলছেন, ‘‘সেই জিনগুলি নিয়েই আমরা জন্মাই। বহু বহু যুগ ধরে সেই জিনগুলি শরীরে নিয়েই এগিয়ে চলেছে মানবসভ্যতা, বিবর্তনের পথ ধরে। কারও ক্ষেত্রে জীবনের কোনও সময় সেই জিনগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। কারও ক্ষেত্রে তা হয় না। তাই টিকা দিয়ে টিউমারের আশপাশের এলাকায় থাকা টি-সেলকে সক্রিয়তর করে তুলে সব ধরনের ক্যানসার পুরোপুরি ভাবে সারানো যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্টই সংশয় থেকে যাচ্ছে।’’ তাঁর বক্তব্য, ইমিউনোলজি (টিকা) দিয়ে ক্যানসার চিকিৎসা হয় না। হতে পারে না। তা হলে অ্যাথলিটদের, যুবরাজ সিংহের মতো ক্রিকেটারদের, রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা যাঁদের আমার, আপনার চেয়ে বেশি, তাঁদের ক্যানসার হত না।
আরও পড়ুন- গ্রহণের চাঁদে গহ্বর খুঁজবে বাংলার চোখ
কী ভাবে কাজ করে ক্যানসার প্রতিরোধী শরীরের টি-সেলগুলি?
কলকাতার বিশিষ্ট ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ স্থবির দাশগুপ্তের বক্তব্য, টিউমার কোষ (ক্যানসার কোষ) গুলির মধ্যেই থাকে সেই ‘দুষ্ট’ প্রোটিনগুলি। টি-সেল বুঝতে পারে, কোন প্রেটিনের ক্ষরণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হচ্ছে বা কম। তখনই সেই প্রোটিনকে বেঁধে ফেলতে (ডকিং) ক্যানসার কোষগুলিতে ঢুকে পড়ে টি-সেল। কিন্তু টি-সেলকে পরোয়া না করার উপায় জানা আছে টিউমার কোষগুলিরও। তাই টি-সেলের নজরদারি, সক্রিয়তা সত্ত্বেও টিউমারের বাড়-বাড়ন্ত ঠেকিয়ে রাখা যায় না। রক্তের মাধ্যমে ক্যানসার কোষগুলির গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়াও রোখা সম্ভব হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই।
তবু আশার আলো...
বিতর্ক থাকলেও, এই গবেষণা নিঃসন্দেহেই নতুন পথ দেখিয়েছে।
মানুষের উপরেও পরীক্ষা সফল হলে হয়তো আগামী এক দশকেই বাজারে আসতে পারে এই টিকা, বলছেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy