Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

মঙ্গলে কোনও কালেই প্রাণ ছিল কি?

লাল গ্রহে সত্যি-সত্যিই কি প্রাণ ছিল কখনও? প্রাণের অঙ্কুর যদি কোনও কালে দেখা দিয়েও থাকে, আদৌ তার কোনও বিকাশ হয়েছিল কি? উত্তরটা সম্ভবত, ‘না’!

মঙ্গলের পাথুরে পিঠ। ছবি-নাসা।

মঙ্গলের পাথুরে পিঠ। ছবি-নাসা।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ১২:১৯
Share: Save:

লাল গ্রহে সত্যি-সত্যিই কি প্রাণ ছিল কখনও? প্রাণের অঙ্কুর যদি কোনও কালে দেখা দিয়েও থাকে, আদৌ তার কোনও বিকাশ হয়েছিল কি?

উত্তরটা সম্ভবত, ‘না’!

অন্তত তেমন ‘সুখবর’ আপাতত দিতে পারছেন না জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। কারণ, লাল গ্রহের আবহাওয়া, তার গঠন কাঠামো বলা ভাল, কিছুটা হতাশই করেছে নাসা, ইসরো, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ) মতো মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলিকে। তাঁদের ধারণা, কোনও কালেই ‘প্রাণ’-এর তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল না লাল গ্রহে। অণুজীব যদি থেকেও থাকে কোনও কালে, তার বিবর্তন হয়নি মঙ্গলে। ফলে সুদূর অতীতেও, যাকে বলে সভ্যতা, তা ছিল না মঙ্গলে।

মঙ্গল কেন হতাশ করেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের?

এক সময় নাসায় গবেষণা করেছেন, অধুনা কেন্দ্রীয় জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুজন সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, ‘‘মঙ্গলে প্রাণের হদিশ মেলা কার্যত অসম্ভবই। মঙ্গলের পরিবেশ, প্রকৃতি এমনই যে, লাল গ্রহে প্রাণের বিবর্তন হয়নি কোনও কালে।’’


লাল গ্রহের পাথুরে ক্ষতবিক্ষত পৃষ্ঠদেশ। ছবি-নাসা।

একই সুর নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিল্লোল গুপ্তেরও। লরেল থেকে পাঠানো ই মেলে হিল্লোলবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘প্রায় তিন বছর ধরে দু’টি মার্কিন রোভার- ‘মিস কিউরিওসিটি’ ও ‘অপারচুনিটি’ মঙ্গলের পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে যে সব ছবি ও তথ্য পাঠিয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে আপাতত আমাদের ধারণা হয়েছে, লাল গ্রহে প্রাণের তেমন উল্লেখজনক অস্তিত্ব কোনও কালেই ছিল না।’’

মঙ্গল কেন হতাশ করেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের, তার কয়েকটি কারণও জানিয়েছেন সুজনবাবু ও হিল্লোলবাবু।

কী কী কারণে মনে করা হচ্ছে, মঙ্গলে ‘প্রাণ’ আদতে ‘সোনার হরিণ’?

সুজনবাবুর কথায়, ‘‘এটা ঠিকই, পৃথিবীর মতো একটি বাসযোগ্য গ্রহের সঙ্গে বেশ কিছু মিল রয়েছে মঙ্গলের। গ্রীষ্ম, শীত, শরতের মতো ঋতুগুলি মঙ্গলেও রয়েছে। যদিও মঙ্গলের একটা বছর পৃথিবীর দু’টো বছরের সমান। কিন্তু, সবচেয়ে বড় অমিলটা হল তাপমাত্রায়। মঙ্গলের পিঠের তাপমাত্রা সব সময়েই থাকে শূন্যের ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও নীচে। লাল গ্রহের উত্তর গোলার্ধে আরও কনকনে ঠাণ্ডা। স্বাভাবিক অবস্থায় এত ঠাণ্ডায় প্রাণের অস্তিত্ব কার্যত অসম্ভবই। প্রাণের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন জলের। জল যদি তরল অবস্থায় এখনও থেকে থাকে মঙ্গলে, তবে তা থাকবে তার অন্তরে-অন্দরে। লাল গ্রহের পৃষ্ঠদেশ এতটাই ঠাণ্ডা যে, সেই জল যদি ওপরে উঠেও আসে কোনও ভাবে, তা ওই কনকনে ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে শক্ত বরফ হয়ে যাবে। যাতে প্রাণের টিঁকে থাকা মুশকিল।’’

আরও কিছু ঘাটতি রয়েছে মঙ্গলের। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিল্লোলবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘প্রাণের অস্তিত্ব ও তার টিঁকে থাকার জন্য পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন পরমাণু থাকা দরকার। মঙ্গলে তা প্রায় নেই বললেই চলে। লাল গ্রহে রয়েছে সুপ্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু। কম করে ৯০ শতাংশ। অক্সিজেন না থাকলে প্রাণী শ্বাস-প্রশ্বাস নেবে কী ভাবে?’’

লাল গ্রহের সবচেয়ে বড় মাইনাস পয়েন্ট হল তার খুব পাতলা বায়ুমণ্ডল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যেখানে ভূপৃষ্ঠের ওপরে আড়াইশো/পৌনে তিনশো কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে, সেখানে মঙ্গলের ‘বায়ুস্তর’ ৫০ কিলোমিটারের বেশি পুরু নয়।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুজন সেনগুপ্ত।

কেন এত পাতলা মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল? কেন তা প্রাণের অস্তিত্বের পক্ষে অন্যতম প্রধান অন্তরায়?

জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুজন সেনগুপ্তের ব্যাখ্যা, ‘‘মঙ্গলের সারফেস গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ বল এতটাই কম যে, তা বেশি দূর পর্যন্ত বায়ুস্তরকে টেনে রাখতে পারে না। লাল গ্রহের বায়ুস্তরের ওপরে নেই ওজোন গ্যাসের স্তরও। ফলে মঙ্গলের পিঠে হু হু করে আছড়ে পড়ছে মহাজাগতিক বা অতিবেগুনি রশ্মি। সেই রশ্মি ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডল ভরিয়ে রাখা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের অণুগুলিকে ভেঙে দিয়ে আরও বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড অণুর জন্ম দিচ্ছে। যে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস প্রচুর পরিমাণে রয়েছে লাল গ্রহের পিঠের ওপরে দশ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়ানো বায়ুস্তরে। ওই পরিবেশে কোনও প্রাণীর বেঁচে থাকা অসম্ভব। এখানেই শেষ নয়। সৌরমণ্ডলের সবক’টি গ্রহের ওপরে প্রতি মুহূর্তে আছড়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর সৌরঝড়। ওই বিষাক্ত বিদ্যুৎ-কণার ছোবলে প্রাণের টিঁকে থাকা মুশকিল। পৃথিবীর দুই মেরুর প্রচণ্ড শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র ওই সৌরঝড়কে কার্যত, ‘শুষে নিচ্ছে’ বলে আমরা তার ভয়াবহতা বুঝতে পারি না। তার জন্য যে ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ হয় উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে, আমরা সেই দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে পারছি। টিঁকে থাকতে পারছি। কিন্তু মঙ্গলের দুই মেরুতে কোনও চৌম্বক ক্ষেত্র নেই। ফলে সৌরঝড়েই নিকেশ হয়ে গিয়েছে প্রাণের যাবতীয় সম্ভাবনা। কক্ষপথে অনেক অনেক বেশি কাৎ হয়ে ঘোরে বলে সেকেন্ডে সেকেন্ডে লাল গ্রহের আবহাওয়া বদলে যায়। তার ফলে, কোনও কালে প্রাণের অস্তিত্ব যদি থেকেও থাকে, তার কোনও বিবর্তন হয়নি লাল গ্রহে। সেই ‘প্রাণ’ বিবর্তনের সুযোগই পায়নি।’’

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ভূমিকম্প হয় না, আগ্নেয়গিরি নেই বলে কয়েকশো কোটি বছর ধরে মঙ্গলের পিঠে ও তার নীচের শিলাস্তরে রদবদল হয়নি। এটাও ‘প্রাণ’কে বিবর্তিত হতে দেয়নি লাল গ্রহে।

অন্য বিষয়গুলি:

life mars earth water ice
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy