Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Body Temperatures

দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা আর ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট নয়

জ্বর মাপার সময় থার্মোমিটারে যে তাপমাত্রাকে (৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিই, তা-ও এখন অ-স্বাভাবিকই! গত ২০০ বছরে সেই স্বাভাবিকতা নেমে পৌঁছেছে ৯৭.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে। কমেছে মহিলাদের দেহের তাপমাত্রাও। তবে সেই হার পুরুষের তুলনায় সামান্য কম। মহিলাদের শরীরের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা এখন ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।

ছবি- শাটারস্টক।

ছবি- শাটারস্টক।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২০ ১১:৪৩
Share: Save:

উত্তেজনায় একটু কি গরম হয়ে গেলেন? আমরা কিন্তু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে।

আমাদের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রার পারদ উত্তরোত্তর নামতে শুরু করেছে। কিছুটা উদ্বেগজনক ভাবেই। উষ্ণতাই যে জীবনের মানদণ্ড। শীতলতা মৃত্যুর পরিচায়ক।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ মেডিসিন’-এর সাম্প্রতিক গবেষণা জানিয়েছে, ১৬০ বছর বা তার কিছুটা বেশি সময় আগে আমাদের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা যা ছিল, সেই উনিশ শতকের উষ্ণতা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে গিয়েছে ১ ডিগ্রি ফারেনহাইটেরও বেশি। উন্নততর একুশ শতকে পৌঁছে।

ফলে, জ্বর মাপার সময় থার্মোমিটারে যে তাপমাত্রাকে (৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) আমরা স্বাভাবিক বলে ধরে নিই, তা-ও এখন অ-স্বাভাবিকই! গত ২০০ বছরে সেই স্বাভাবিকতা নেমে পৌঁছেছে ৯৭.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে। কমেছে মহিলাদের দেহের তাপমাত্রাও। তবে সেই হার পুরুষের তুলনায় সামান্য কম। মহিলাদের শরীরের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা এখন ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ইলাইফ’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায়। যা আমাদের ছোটবেলায় শেখা ‘ম্যাজিক নম্বর’গুলির মধ্যে একটিকে বদলে দিল।

দু’টি শতাব্দীতে নেমেছে ধাপে ধাপে, ধারাবাহিক ভাবে 

আন্তর্জাতিক গবেষকদলের অন্যতম সদস্য স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ মেডিসিন’-এর অধ্যাপক অনুপম মাজি ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘আমাদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রার এই অবনমন হঠাৎই হয়নি। তা ধাপে ধাপে নেমেছে। মানুষের জন্ম-সময়ের নিরিখে একটি দশক (‘ডিকেড অফ বার্থ’) থেকে পরবর্তী দশকে। ধারাবাহিক ভাবে। সেই ধারাবাহিকতায় কোনও ব্যাতিক্রম ঘটতে দেখিনি আমরা। এটা একটি অভূতপূর্ব পর্যবেক্ষণ।’’

ওরাল টেম্পারেচার। তাপমাত্রা পরিমাপের আধুনিক পদ্ধতি।

ওরাল টেম্পারেচার। তাপমাত্রা পরিমাপের আধুনিক পদ্ধতি।

এর পরেই অনুপমের রসিকতা, ‘‘ফলে, দেহের তাপমাত্রার পারদ এখন ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছুঁলেই আমি, আপনি অফিস থেকে একটা ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে নিতে পারি!’’

কেন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি?

গবেষণার বিষয়বস্তু সেটা ছিল না। তবু অনুপম জানাচ্ছেন, কয়েকটি কারণ অনুমান করা হয়েছে।

তাঁর বক্তব্য, ১৬০ বছর আগে জার্মান চিকিৎসক ভান্ডারলিচ যখন হিসাবটা কষেছিলেন, তখন আমাদের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩৮ বছর। যক্ষা থেকে সিফিলিস এবং নানা রকমের প্রদাহে তখন আকছার মৃত্যু হত আমাদের। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে যাওয়া আর প্রদাহে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সেই তাপমাত্রা বাড়ার ঘটনার রেকর্ড থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কেন তরুণ প্রজন্মের গা প্রবীণদের চেয়ে তুলনায় বেশি গরম। বিভিন্ন রকমের প্রদাহে বেশি আক্রান্ত হয় তরুণ প্রজন্মই। তার ফলে তাঁদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা বাড়ে।

আরও পড়ুন- ছত্রাক দিয়ে বাড়ি বানানো হবে চাঁদ-মঙ্গলে, কাজ জোরকদমে, জানাল নাসা​

আর সেই তাপমাত্রা কমে যায় প্রদাহ কমানোর ওষুধ (‘অ্যাসপিরিনে’র মতো ‘অ্যান্টি-পাইরেটিক ড্রাগ’) খাওয়ায়। আর সেটা তরুণদের ক্ষেত্রেই ঘনঘন হয়। দু’শো বছর আগে এই সব ওষুধ ছিল না। তাই তার যথেচ্ছ ব্যবহারও ছিল অসম্ভব। ফলে, সেই সময় কোনও তরুণের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা এখনকার চেয়ে বেশি ছিল।

অ্যাক্সিলারি টেম্পারেচার। তাপমাত্রা পরিমাপের পুরনো পদ্ধতি।

অ্যাক্সিলারি টেম্পারেচার। তাপমাত্রা পরিমাপের পুরনো পদ্ধতি।

আর একটি কারণ, আমাদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ও বিপাক প্রক্রিয়ার হারের বাড়া-কমা। ওই প্রক্রিয়াগুলি আমাদের দেহের তাপমাত্রা বাড়ায়। ছুটলে, ব্যায়াম করলে, পরিশ্রম করলে যেগুলির হার বাড়ে। আগেকার মানুষ অনেক বেশি পরিশ্রম করতেন। ফলে, তাঁদের বিপাক ও অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার হার ছিল অনেক বেশি। তাই তাঁদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রাও ছিল বেশি। কিন্তু আমাদের জীবন এখন উত্তরোত্তর হয়ে পড়ছে পরিশ্রমবিহীন। আয়েসি। যন্ত্রনির্ভর আধুনিকতার ফলে, আমরা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি।

৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ম্যাজিক নম্বরটির উৎপত্তি কী ভাবে? 

কলকাতার বিশিষ্ট হেমাটোলজিস্ট সুদীপ্তশেখর দাস জানাচ্ছেন, সেটা ১৮৫১ সালের কথা। আমাদের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কত জানতে ২৫ হাজার রোগীর তাপমাত্রা রেকর্ড করেছিলেন। তার পর তার গড় কষে পৌঁছেছিলেন ওই ম্যাজিক নম্বরে।

তখনই বলা হয়েছিল, এটা আমাদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা। যার অর্থ, তার সামান্য কিছু বেশি হতে পারে। আবার ততটাই সামান্য কমও হতে পারে। তবে দু’টিকে যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ করলে তার মান হবেই হবে ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ভুল কোথায়? কী ভাবে ভুল ভাঙল?

কলকাতার আর এক বিশিষ্ট হেমাটোলজিস্ট শুভাশিস চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘আমরা গড় শব্দটিকে বেমালুম ভুলে গেলাম। বিশ্বাস করতে শুরু করলাম ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটই দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা। এইখানেই ভুল হয়ে গিয়েছিল আমাদের। যদিও অনেক দিন ধরেই চিকিৎসকদের মধ্যে সংশয় দেখা গিয়েছিল, মানবদেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রাও কি সত্যি-সত্যি ওটাই? তার চেয়ে কম নয় তো?’’স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ মেডিসিন’-এর হালের গবেষণায় সেই সন্দেহ, সংশয়ের নিরসন হল, মনে করছেন অনেক চিকিৎসকই।

আরও পড়ুন- বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন তারা ‘বিট্‌লজিউস’ কি হবে আর একটি ‘পূর্ণিমার চাঁদ’?​

শুভাশিস জানাচ্ছেন, ১৬০ বছর জার্মান চিকিৎসক ২৫ হাজার রোগীর দেহের তাপমাত্রা মেপেছিলেন বগলের (আর্মপিট) তাপমাত্রা নিয়ে। যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘অ্যাক্সিলারি টেম্পারেচার’। কিন্তু এখন আর সেই ভাবে দেহের তাপমাত্রা মাপা হয় না। থার্মোমিটারকে জিভের তলায় ঢুকিয়ে মাপা হয় আমাদের দেহের তাপমাত্রা। একে বলা হয়, ‘ওরাল টেম্পারেচার’।

ওরাল টেম্পারেচার

ওরাল টেম্পারেচার

এ ছাড়াও গত দু’শো বছরে দেহের তাপমাত্রা মাপার থার্মোমিটারের অনেক পরিবর্তন, পরিমার্জন হয়েছে।

গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়? 

সুদীপ্ত ও শুভাশিস দু’জনেরই বক্তব্য, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণার অভিনবত্ব তাঁরা দেহের তাপমাত্রা মাপার সবক’টি পদ্ধতি ও গত দুই শতাব্দীতে তার যাবতীয় বিবর্তনের বিষয়কে মাথায় রেখেছে। গবেষকরা সেই তাপমাত্রা রেকর্ড করেছেন ১৮৬২ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত। নিয়েছেন ৬ লক্ষ ৭৭ হাজার মানুষের দেহের তাপমাত্রা। যা ১৬০ বছর আগে জার্মান চিকিৎসকের নেওয়া নমুনা-সংখ্যার (২৫ হাজার) প্রায় ২৭ গুণ। ফলে, এই গবেষণার ফলাফল অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।

অন্যতম গবেষক অনুপম এও জানিয়েছেন, আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে তাঁদের গবেষণায়।

প্রথমত, দেখা গিয়েছে, বিশ্রামরত অবস্থায় থাকা কোনও তরুণের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কোনও প্রবীণের (৫০-এর বেশি বয়স) চেয়ে বেশি।

দ্বিতীয়ত, মহিলাদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা পুরুষের তুলনায় সামান্য বেশি।

তৃতীয়ত, দুপুরের দিকে আমাদের দেহের গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে যায়। সেটা পুরুষ ও মহিলা, দু’জনের ক্ষেত্রেই সত্যি।এই হারে দেহের তাপমাত্রার পারদ নামতে থাকলে আর সাড়ে ১৪ হাজার বছর পর আমাদের দেহের তাপমাত্রা হতে পারে শূন্য! অন্তত অঙ্কের খাতিরে। আমাদের সভ্যতার আয়ুও কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার চেয়ে অনেকটাই কম!

গ্রাফিক: তিয়াসা দাসছবি- শাটারস্টক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy