Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
black hole

যুগান্তকারী ঘটনা! ব্ল্যাক হোলের চার পাশের চৌম্বক ক্ষেত্রের ছবি তোলা গেল এই প্রথম

জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এত দিনের গোপন দরজাটা এ বার খুলে ফেলা সম্ভব হল।

ছবিতে হলুদ রঙের ঘূর্ণিগুলিই এম-৮৭ সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের চৌম্বক ক্ষেত্র। ছবি সৌজন্যে- ইএইচটি।

ছবিতে হলুদ রঙের ঘূর্ণিগুলিই এম-৮৭ সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের চৌম্বক ক্ষেত্র। ছবি সৌজন্যে- ইএইচটি।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২১ ২৩:৫৮
Share: Save:

ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের অতলান্ত অন্ধকারের একেবারেই অজানা অচেনা জগতের এত দিনের গোপন দরজাটা এ বার খুলে ফেলা সম্ভব হল। ঠিক কী কী ঘটনা ঘটছে সেই সর্বগ্রাসী অন্ধকারের মুলুকে, কী ভাবে ঘটছে এই প্রথম সেই গোপন কথার কিছুটা জানা গেল।

ছবি তোলা গেল কোনও ব্ল্যাক হোলের চার পাশের চৌম্বক ক্ষেত্রের। সেই চৌম্বক ক্ষেত্র ঠিক কী ভাবে সাজানো থাকে, তার দিক-দিশাও জানা গেল। এই প্রথম।

দু’বছর আগে প্রথম কোনও ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলার পর তার চার পাশের চৌম্বক ক্ষেত্রের ছবি তোলাও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর আগে যা সম্ভব হয়নি কখনও। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ।

দু’বছরের ব্যবধানে দু’টি ইতিহাস

পৃথিবী থেকে সাড়ে ৫ কোটি আলোকবর্ষ দূরে থাকা একটি বিশাল নক্ষত্রপুঞ্জ ‘এম-৮৭’-এর অন্দরে রয়েছে যে দৈত্যাকার ‘সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল’ (নাম-এম-৮৭) তার ছবি তোলা হয়েছিল দু’বছর আগে। ২০১৯-এ। ইভেন্ট হরাইজ্‌ন টেলিস্কোপ (ইএইচটি)-এর মাধ্যমে।

তার আগে আর কোনও ব্ল্যাক হোলের ছবি তোলা যায়নি। তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা এড়িয়ে আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না বলে। আলোর চলার পথের সূত্র ধরেই তো আমরা তার উৎসে পৌঁছই, ছবি তুলি বা আঁকি।

ফলে দু’বছর আগে অসাধ্যসাধন করেছিল ইএইচটি। কোনও ‘মহারাক্ষস’-এর ছবি তুলে। এ বার আরও একটি অসাধ্যসাধন করল ইএইচটি এম-৮৭ সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের চার পাশের চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রায় পূর্ণাঙ্গ ছবি তুলে। যা থেকে প্রথম চাক্ষুষ করা গেল ব্ল্যাক হোলের চার পাশের চৌম্বক ক্ষেত্রটিকে। তার সজ্জাও। পাওয়া গেল সেই চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক-দিশাও।

দু’বছরের ব্যবধানে পর পর দু’টি অসাধ্যসাধন সম্ভব হয়েছে যার মাধ্যমে সেই ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপটি আদতে পৃথিবীর ৮টি জায়গায় বসানো ৮টি রেডিও টেলিস্কোপের সমষ্টি। সেগুলি এমন ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে, যাতে ৮টি টেলিস্কোপ লেন্সের ব্যাসগুলিকে যোগ করলে তা পৃথিবীর ব্যাসের সমান হয়। যার অর্থ, পৃথিবীর ব্যাসের সমান আকারের লেন্স দিয়েই প্রথম কোনও ব্ল্যাক হোল ও তার চার পাশের চৌম্বক ক্ষেত্রের ছবি তুলতে পেরেছে ইএইচটি।

ব্ল্যাক হোলের ব্যাসার্দ্ধের ৫-৬ গুণ দূরে চুম্বকের জাল!

যে ছবি পাওয়া গিয়েছে তার থেকে দেখা যাচ্ছে, কোনও সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের ব্যাসার্দ্ধ যতটা, তার ৫-৬ গুণ দূরত্বে থাকে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র। যার আড়াই-তিন গুণ কম দূরত্বে ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি থাকে সেই ভয়ঙ্কর এলাকা ‘ইভেন্ট হরাইজ্‌ন’। যে এলাকার সীমান্ত ছুঁলেই কোনও পদার্থ, এমনকি আলোর কণা ফোটনও আর ব্ল্যাক হোলের জোরালো অভিকর্ষ বলের টান এড়িয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে, ইভেন্ট হরাইজ্‌ন থেকেই শুরু হয়ে যায় ব্ল্যাক হোলের অতলান্ত অন্ধকারের সাম্রাজ্য। যে সাম্রাজ্যে অস্তিত্বই নেই আলোর।

কাউকে যেতে দেয়, কাউকে ছুড়ে দেয় বাইরে

এম-৮৭ সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের চার পাশের চৌম্বক ক্ষেত্রের যে ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে, তার থেকে বোঝা যাচ্ছে সেটা যেমন খুব শক্তিশালী নয়, তেমনই তা নয় খুব দুর্বলও। সেই চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি মাঝারি মানের।

এক সপ্তাহ ধরে এই ভাবে চেহারা বদলেছে এম-৮৭ সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের চৌম্বক ক্ষেত্র। ছবি সৌজন্যে- ইএইচটি।

এক সপ্তাহ ধরে এই ভাবে চেহারা বদলেছে এম-৮৭ সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের চৌম্বক ক্ষেত্র। ছবি সৌজন্যে- ইএইচটি।

বেঙ্গালুরুর ‘রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আরআরআই)’-এর অধ্যাপক বিমান নাথ জানাচ্ছেন, ওই চৌম্বক ক্ষেত্র খুব শক্তিশালী হলে ব্ল্যাক হোলের খুবই মুশকিল হত। খাবার পেত না একেবারেই। কারণ গ্যালাক্সির চার দিক থেকে গ্যাসের ঘন মেঘ, তারা, পদার্থ ব্ল্যাক হোলের জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে কাছাকাছি এসেও শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের জালে আটকে যেত। সেই জাল ফুঁড়ে তারা আর ইভেন্ট হরাইজ্‌নে গিয়ে পৌঁছত না। তাদের আর গোগ্রাসে খাওয়া সম্ভবও হত না ব্ল্যাক হোলের। সেই চৌম্বক ক্ষেত্র খুব দুর্বল হলে ব্ল্যাক হোলের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা থেকে কাছেপিঠে এসে পড়া তারা, গ্যাসের ঘন মেঘ, পদার্থের সামান্য রেহাই মেলারও অবকাশ থাকত না। কাছেপিঠে আসা সব কিছুই ব্ল্যাক হোলের পেটে চলে যেত।

বিমান বলছেন, ‘‘ছবি দেখে মনে হচ্ছে এই চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি মাঝারি মানের। তাই কাছেপিঠে আসা গ্যাসের ঘন মেঘ, তারা, পদার্থের গতিশক্তি বেশি হলে তা চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তিকে অগ্রাহ্য করে ব্ল্যাক হোলের জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে তার ইভেন্ট হরাইজ্‌নের দিকে এগিয়ে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় চৌম্বক ক্ষেত্রেরও কিছু অংশ। ব্ল্যাক হোলের খিদে মেটায়। আর কাছেপিঠে আসা গ্যাসের ঘন মেঘ, তারা, পদার্থের গতিশক্তি কম হলে, তা চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তিকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। চৌম্বক ক্ষেত্রের জালে জড়িয়ে যায়। পরে তাদের ছিটকে বার করে দেয় চৌম্বক ক্ষেত্র। তখনই আলোর রেডিও তরঙ্গ, অবলোহিত তরঙ্গ, দৃশ্যমান তরঙ্গ, অতিবেগুনি রশ্মি, এক্স-রে এবং গামা রে বেরিয়ে আসে। একটা ‘জেট’ তৈরি হয়।’’

ব্ল্যাক হোলকে জানার পথ খুলে গেল

নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর অবজারভেশনাল সায়েন্সেস (এরিস)’-এর অধ্যাপক ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘কেন ওই ‘জেট’গুলি বেরিয়ে আসে ব্ল্যাক হোলের আশপাশের এলাকা থেকে, কোথায় তাদের উৎপত্তি হয় ব্ল্যাক হোলের চার পাশের চৌম্বক ক্ষেত্রের ছবি এ বার তা বুঝতে সাহায্য করবে। সেই চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তিকে অগ্রাহ্য করে ন্যূনতম কোন গতিবেগে কাছেপিঠে আসা গ্যাসের ঘন মেঘ, তারা, পদার্থ ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজ্‌নের দিকে ছুটে যায় এ বার সেটা বোঝারও পথ খুলে যেতে পারে।’’

কী ভাবে তৈরি হয় এই চৌম্বক ক্ষেত্র?

ইন্দ্রনীল জানাচ্ছেন, ব্ল্যাক হোলের জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে গ্যাসের ঘন মেঘ, তারা, পদার্থ কাছেপিঠে এসে পড়লে তাদের তাপমাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে তারা আর অণু, পরমাণু হয়ে থাকতে পারে না। ইলেকট্রন খুইয়ে তারা আয়ন হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে রাশি রাশি ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণায়। তাদের গতিবেগ থাকে বলে তাদের চলার পথে তৈরি হয় বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র। যার পরিণতিতে তৈরি হয় চৌম্বক ক্ষেত্রও।

চৌম্বক ক্ষেত্রের সীমানার শেষটা কোথায়?

ইন্দ্রনীল জানাচ্ছেন, এই ছবি থেকে সেটা বোঝা সম্ভব হয়নি। এ বার হয়তো সেই গবেষণা শুরু হবে। চৌম্বক ক্ষেত্রের সীমানা ব্ল্যাক হোলের কতটা কাছাকাছি পৌঁছতে পারে, সেটা জানাও খুব জরুরি। কারণ, চৌম্বক ক্ষেত্র আবদ্ধ হয় বলে তা যদি ব্ল্যাক হোলে ঢুকে পড়ে তা হলে তাকে বেরিয়েও আসতে হবে। কিন্তু ব্ল্যাক হোল থেকে তো কোনও কিছুর বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। তার মানে, এই চৌম্বক ক্ষেত্রের সীমানা ইভেন্ট হরাইজ্‌নের আগেই শেষ হয়ে যেতে পারে।

এই যুগান্তকারী ঘটনা ব্ল্যাক হোলের অতলান্ত অন্ধকারের গোপন দরজাটা অনেকটাই খুলে দিল, বলছেন বিমান ও ইন্দ্রনীল।

ছবি সৌজন্যে- ইভেন্ট হরাইজ্ন টেলিস্কোপ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy