Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Electricity

দিনবদলের পরীক্ষার দুশো বছর

চুম্বককে প্রভাবিত করতে গেলে তো চুম্বকই লাগবে। অন্য কিছু দিয়ে তা হবে কী ভাবে?

আবিষ্কার: পরীক্ষা করে দেখাচ্ছেন হান্স ক্রিশ্চিয়ান ওরস্টেড

আবিষ্কার: পরীক্ষা করে দেখাচ্ছেন হান্স ক্রিশ্চিয়ান ওরস্টেড

ভূপতি চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২০ ০২:০৪
Share: Save:

ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহাগেন-এ ১৮২০ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হান্স ক্রিশ্চিয়ান ওরস্টেড ছাত্রদের ক্লাস নিচ্ছিলেন। সেখানে কিছু পরীক্ষা হাতে কলমে করে দেখানোর ব্যবস্থা ছিল। তিনি একটি তামার তারের মধ্যে দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের বিষয়টি ছাত্রদের দেখাচ্ছিলেন। মাত্র কুড়ি বছর আগে ইটালীয় পদার্থবিদ আলেসান্দ্রো ভোল্টা আবিষ্কার করেছেন তড়িৎ কোষ, যা দিয়েছে প্রবাহী তড়িতের সন্ধান। ওরস্টেডের সেই পরীক্ষা চলাকালীন ধরা পড়ল তারের কাছে থাকা একটা চুম্বক শলাকা বিক্ষেপ দেখাচ্ছে। অথচ, সেখানে অন্য কোনও চুম্বক নেই। তামার একটি তড়িৎবাহী তার ওই কম্পাসটির একটু উপরে রাখা আছে। চুম্বক শলাকা তখনই বিক্ষেপ দেখাচ্ছে, যখন ওই তারে তড়িৎ প্রবাহ চলছে।

চুম্বককে প্রভাবিত করতে গেলে তো চুম্বকই লাগবে। অন্য কিছু দিয়ে তা হবে কী ভাবে? কিন্তু ওরস্টেড বার বার পরীক্ষাটি করে দেখলেন, ওই এক রকম ঘটনাই ঘটছে। যখন অবশ্য তামার তারে বিদ্যুৎ প্রবাহ হচ্ছে না, তখন এমনটা ঘটছে না। তা হলে কি তামার তারে বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে এক চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে? আর যদি এমনটাই হবে, তা হলে তো ধরে নিতে হয় চুম্বকত্ব আর বিদ্যুতের কোথায় যেন একটা যোগসূত্র রয়েছে।

আমরা যদি ওরস্টেডের পরীক্ষাটি একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করি, তা হলে দেখব আজকের বিচারে তা খুবই সহজ। এটি এখন বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে করে দেখান বহু শিক্ষক, ছাত্ররাও এর মাধ্যমে অনুধাবন করে বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্বের সম্পর্ক; বুঝতে পারে যে দুটি একই সুতোয় বাঁধা। এই যে বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্বের হরিহর আত্মা রূপ, তা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হল ওরস্টেডের এই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে। ওরস্টেডের এই পরীক্ষাটি কোনও পরিকল্পনার অংশ ছিল না। প্রবাহী তড়িতের চুম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করার ক্ষমতা ধরা পড়েছিল কিছুটা আকস্মিক ভাবেই। এ রকম একটা পরীক্ষা কেবল আজকের বিচারে নয়, সম্ভবত সেই সময়কার বিচারেও খুব জটিল ছিল না। এই পরীক্ষার বিশেষ মাত্রা কোথায়, কেনই বা এটি ল্যান্ডমার্ক এক্সপেরিমেন্ট, তা বুঝতে আমাদের নজর দিতে হবে ১৮৩১ সালের আর একটা এক্সপেরিমেন্টের দিকে।

লন্ডনে মাইকেল ফ্যারাডে এই পরীক্ষাকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। ওরস্টেডের এই বিখ্যাত গবেষণার সময় ফ্যারাডের বয়স ছিল উনত্রিশ এবং তখনও পর্যন্ত তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল রসায়ন, পদার্থবিদ্যা নয়। কিন্তু চল তড়িতের আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যারাডে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তাঁর গবেষণার কাজে এই তড়িতের প্রয়োগ নিয়ে। কিছু তরল পদার্থের মধ্যে দিয়ে তড়িতের প্রবাহ পাঠিয়ে তিনি তড়িৎ রসায়ন নামে এক দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত তাঁর মধ্যে যে চিন্তাটি উঠে এসেছিল তা হচ্ছে, বিদ্যুৎ প্রবাহ যদি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, তা হলে কি চুম্বক ক্ষেত্রকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ প্রবাহ পাওয়া সম্ভব? এই ব্যবহার কী ভাবে হতে পারে? তার সন্ধান শেষে পেলেন ফ্যারাডে, ১৮৩১ সালে।

তিনি দেখলেন একটা বিদ্যুতের সুপরিবাহী তারের (যেমন তামার) কুণ্ডলীর খুব কাছেও যদি স্থির অবস্থায় একটি চুম্বক রাখা যায়, তা হলে কোনও ঘটনা নজরে আসে না। কিন্তু যখন সেই চুম্বককে তারের কুণ্ডলীর কাছে এমন ভাবে নাড়াচাড়া করা যায় যে, কুণ্ডলীর মধ্যে দিয়ে চুম্বক বলরেখার পরিবর্তন ঘটে যায়, তা হলে তারের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। ফ্যারাডে লক্ষ করলেন, তারের কুণ্ডলীতে উদ্ভূত তড়িৎ বিভব কুণ্ডলীর মধ্যে দিয়ে চুম্বক বলরেখার পরিবর্তনের হারের সমানুপাতিক। মোট বলরেখার সংখ্যা নয়, বলরেখা কী হারে পরিবর্তিত হচ্ছে, সেটিই এখানে বিবেচ্য। যত দ্রুত হারে চুম্বক বলরেখার পরিবর্তন ঘটবে, ততই বেশি হবে সৃষ্ট তড়িৎ বিভবের মান। ফ্যারাডে আরও বুঝতে পারলেন যে, এ ক্ষেত্রে কুণ্ডলীর মধ্যে দিয়ে বলরেখা কমছে কি বাড়ছে, সেটা বড় কথা নয়। হ্রাস বা বৃদ্ধির হারই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তিনি এটাও লক্ষ করলেন যে, বলরেখার হ্রাস বা বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয় বিভবের অভিমুখ। পদার্থবিদ্যার ভাষায় চুম্বক বলরেখার এই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তড়িৎ বিভব সৃষ্টির বিষয়টিই তড়িৎচুম্বকীয় আবেশ। ফ্যারাডের এই কাজের মধ্যে দিয়েই আজকের চল তড়িৎ উৎপাদন করা হয়।

শোনা যায়, তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ আবিষ্কৃত হওয়ার কিছু পরে ইংল্যান্ডের এক জন প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি পরবর্তী কালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, ফ্যারাডের গবেষণাগার পরিদর্শনে আসেন। তিনি তড়িৎচুম্বকীয় আবেশের বিষয়টি দেখে সম্ভবত খুব একটা উৎসাহিত হননি। প্রশ্ন করেছিলেন, “চুম্বক থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু এটা আসবে কোন কাজে?” শোনা যায় ফ্যারাডে নাকি উত্তর দিয়েছিলেন,“একটি সদ্যোজাত শিশু ভবিষ্যতে কী করবে, আমরা কেউই জানি না। তবে তার পরিচর্যা করা আমাদের কর্তব্য। তা ছাড়া, কে বলতে পারে ভবিষ্যতে হয়তো বা এই আবিষ্কারের মধ্যে থেকেই আপনারা অনেক কর সংগ্রহ করতে পারবেন।”

অন্য বিষয়গুলি:

electricity Warewolf
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy