মূলতঃ আকাশ থেকে যুদ্ধের কাজেই এই চালকবিহীন যন্ত্রের উদ্ভাবন।
আজ সারা দিন বৃষ্টি। বৌ লিস্ট করে দিয়েছে। খিচুড়ি আর ডিমভাজা। এক কেজি চাল, পাঁচশো ডাল, হাফ ডজন ভাল হাঁসের ডিম, দুটো পেঁয়াজ আড়াইশো গ্রামের তেলের প্যাকেট। অথচ আপনার বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। কিংবা, ধরুন মেয়ের জন্মদিন। একটা কেক, গোলাপ ফুল আর একটা নীল ডায়ালের চৌকো রিস্টওয়াচ চাই। মেয়েকে উপহার দেবেন। ফোনের বোতাম টিপে সব অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এ বার কল্পনা করুন, আপনার চারতলার ফ্ল্যাটের ঝুল বারান্দায় হঠাৎ একটা ছোট চারডানার কপ্টার নামল। বড় বাজপাখির মতো সাইজ়। পেটের কাছে একটা বাক্সে অর্ডার করা সব জিনিসপত্র বোঝাই। কিংবা কোথাও বন্যার জলে বাড়িঘর ভেসে যাচ্ছে বা ভূমিকম্পে চুরমার শহর। জানার দরকার কোথায় কী ভাবে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছতে হবে। অথবা যুদ্ধে শত্রুপক্ষের সামরিক গতিবিধি ও ক্ষয়ক্ষতির ঠিকঠাক খবর। এ সব আজকাল আর আইজ়াক আসিমভ-এর কল্পবিজ্ঞান নয়। বাস্তবের আকাশে প্রযুক্তির নতুন পাখি। ড্রোন।
মূলতঃ আকাশ থেকে যুদ্ধের কাজেই এই চালকবিহীন যন্ত্রের উদ্ভাবন। খ্রিষ্টজন্মের কয়েকশো বছর আগে চিনদেশে ঘুড়িতে চড়ে সৈনিকেরা আকাশ থেকে যুদ্ধ করত। কিংবা তৃতীয় শতাব্দীতে বেলুনের সাহায্যে যুদ্ধ। তারও আগে রামায়ণে বর্ণিত রাবণপুত্র ইন্দ্রজিতের মেঘের আড়াল থেকে লড়াই। বা হিন্দু ও বৌদ্ধপুরাণের বৃহদাকার পাখি সর্পশত্রু গরুড়। ঋষি কশ্যপ ও বিনতার পুত্র। বিষ্ণুবাহন। তাঁর সঙ্গে পবন দেবতার যুদ্ধ। এ ছাড়া আছে নানা রকম উড়ন্ত অস্ত্রশস্ত্রের বিবরণ। শিবের ত্রিশূল, ইন্দ্রের বজ্র। এ ছাড়া ব্রহ্মাস্ত্র, গরুড়াস্ত্র, কৌমদকী, নারায়ণাস্ত্র, পাশুপতাস্ত্র, শিবধনু, বিমান, সুদর্শন চক্র, বরুণাস্ত্র ও বায়বাস্ত্র ইত্যাদি। এর সঙ্গে যদি জোড়ে বায়ুরথ, তা হলে তো কথাই নেই। এখন তো ‘সব কিছু ব্যাদে আছে’-র যুগ। কোন দিন শুনব, ড্রোন তো এ দেশেও ছিল! ড্রোনে চড়েই তো রাবণ সীতাহরণ করেছিলেন!
১৯০৩ সালে উইলবার এবং ওরভিল রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রথম সফল রাইট ফ্লায়ার তৈরির পর থেকে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এরোপ্লেনের ব্যবহার হয়েছে প্রচুর। কখনও বোমারু বিমান হিসাবে। কখনও শত্রুপক্ষের উপর নজরদারিতে। কখনও আহতদের উদ্ধারকাজে। ১৯১৫ সালে নিকোলাস টেসলা একসঙ্গে অনেক বিমান দিয়ে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করার প্রস্তাব দেন। বিমানগুলি চালকবিহীন। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এরও ৬৬ বছর আগে অস্ট্রিয়ান নৌসেনারা ভালকান জাহাজ থেকে চালকবিহীন বেলুনের সাহায্যে ইটালির ভেনিসে বোমা ফেলে। ফলে টেসলার প্রস্তাব কারও অসম্ভব মনে হয় না। পরের বছর ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়র আর্চিবল্ড লো এই ধরনের বিমান তৈরির কাজ শুরু করেন। শুরু হয় চার্লস কেটারিং-এর ‘কেটারিং বাগ’ আর হিউইট-স্পেরির স্বনিয়ন্ত্রিত প্লেনের কাজও।
১৯৩১ সাল নাগাদ ব্রিটিশ রণপোতে বিমানধ্বংসী কামানের টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্য ফেয়ারি কুইন এবং পরে হেভিল্যান্ড কুইন বি নামে বেতার নিয়ন্ত্রিত ছোট ছোট বিমান ব্যবহার করা হত। সেনা নাবিকেরা রসিকতা করে এদের বলত ‘ড্রোন’। সেই থেকে নামটা চালু। এর মধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু এবং শেষ। ১৯৩৬ সালে নাৎসি জার্মানির ফ্রিৎজ গোসলু বানালেন এ এস ২৯২ নামে এক চালকহীন ড্রোন, যা রিমোট সারভাইলেন্স-এর এক অন্যতম নজির। ১৯৪০ সালে ‘পপুলার মেকানিক্স’ ম্যাগাজিনে বেতারযন্ত্রের পুরোধা লি ডে ফরেস্ট ও টিভি ইঞ্জিনিয়র ইউ সানাব্রিয়া সামরিক ড্রোনের বিশদ নকশা প্রকাশ করেন।
কিছু দিন পরে ১৯৫১ সালে আসে অস্ট্রেলিয়ার জিন্ডিভিক আর টেলেডাইন রায়ান ফায়ারবি। ভিয়েতনামের যুদ্ধে প্রথম ব্যাপক ভাবে ড্রোনের ব্যবহার হয়। ১৯৬০ সালে ইউ-টু স্পাই প্লেন হারানোর পর রেড ওয়াগন নামে এক অতি গোপনীয় প্রজেক্টে প্রথম সামরিক কাজে রায়ান-১৪৭বি সিরিজের বেশ কিছু ‘পাখি’ সি-১৩০ প্লেনের পিঠে চাপিয়ে ভিয়েতনামে পাঠানো হয়। তার পর আসে রায়ান ফায়ার বি সিরিজের ড্রোন। এদের ডি সি ১৩০ হারকিউলিস প্লেনের পিঠে চাপিয়ে আকাশ থেকে ছুড়ে দেওয়া হত। কাজ ছিল, আকাশে উড়তে উড়তে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট যোদ্ধাদের খবর সংগ্রহ।
দু’ধরনের ড্রোন আছে। আনম্যানড এয়ার ভেহিকল বা ইউ এ ভি। এরা আকারে বড়। আর মাইক্রো এয়ার ভেহিক্ল বা এম এ ভি। এরা আকারে ছোট। আধুনিক সামরিক ড্রোনের জনক হিসাবে অন্যতম উল্লেখ্য জন স্টুয়ার্ট ফস্টার। পেশায় তিনি ছিলেন পরমাণু বিজ্ঞানী। কিন্তু এরোপ্লেন ছিল তাঁর নেশা। এক সময় তিনি বিখ্যাত লরেন্স লিভারমোর ল্যাবরেটরির পুরোধা ছিলেন। ১৯৭৩ সালে আমেরিকার প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান ডারপা-র আর্থিক সাহায্যে তিনি প্রেইরি আর ক্যালেরি নামে দুটি সফল ড্রোনের প্রোটোটাইপ তৈরি করেন। লন মোয়ারের ইঞ্জিন ব্যবহার করে এই ড্রোন দুটি ১৩ কেজি ওজনের পে লোড নিয়ে দু’ঘণ্টা আকাশে উড়তে সক্ষম হয়। এর পর থেকে সারা বিশ্বে নানা কাজে ড্রোনের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। ১৯৭০ এবং ৮০-র দশকে ইজরায়েল অত্যন্ত উন্নত মানের স্কাউট ও পাইওনিয়ার নামে ইউ এ ভি তৈরি করে, যা রিয়াল টাইম ইনফরমেশন, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহের কাজে অসামান্য। সিরিয়া এবং লেবাননের যুদ্ধে সামরিক কাজে, নজরদারিতে, ইলেকট্রনিক যুদ্ধে এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ডিকয় হিসাবে ব্যবহারে এই ড্রোনগুলির জুড়ি মেলা ভার। আশির দশকে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে ইরান ছ’টি আরপিজি সমেত একটি ড্রোন পাঠায়। গত শতাব্দীর শেষে ইরাকে ডেজার্ট স্টর্ম আর আফগানিস্তানের যুদ্ধে সেনাদের পাশাপাশি মার্কিন প্রিডেটর ড্রোনের ব্যবহার হয়েছে প্রচুর। ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক মার্কিন রিপোর্টে জানা গিয়েছে সেই সাল অবধি ছ’হাজারের বেশি লোক ড্রোন থেকে নিক্ষিপ্ত মারণাস্ত্রে নিহত হয়েছে। এ যাবৎ ইউরোপ, আমেরিকা, চিন, ইজরায়েল, ইরান, ভারত ও পাকিস্তান-সহ পঞ্চাশটিরও বেশি দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ড্রোন ব্যবহার করেছে। এতে সামনাসামনি লড়াই কমে। কমে সৈনিকদের মৃত্যুর হার।
রামায়ণে বর্ণিত রাবণপুত্র ইন্দ্রজিতের মেঘের আড়াল
থেকে লড়াই বা হিন্দু ও বৌদ্ধপুরাণের বৃহদাকার পাখি
সর্পশত্রু গরুড়ের গল্প তো আমরা সবাই জানি।
তবে শুধু যুদ্ধে নয়। চাষবাস, জমি জরিপ, তথ্যসংগ্রহ, দুর্গম জায়গায় সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার কাজে, বিপদে-আপদে ফার্স্ট রেসপনডার হিসাবে। এই শতকে ড্রোনের কাজ শুরু হয়েছে সর্বত্র। ফলে শুরু হয়েছে নতুন ধরনের ড্রোন তৈরির গবেষণা। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে প্রস্তাবিত ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার উড়ান চাকতি উইভ। পুরো নাম, উইংলেস ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক এয়ার ভেহিক্ল। ছয় ইঞ্চি চাকতি আকারের উইভ উড়বে বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক শক্তির সাহায্যে। ২০১৮ সালে ব্যাটারিচালিত এক স্বনিয়ন্ত্রিত ড্রোন তৈরি করেছেন ইউনিভার্সিটি অব বোলোনা ও সুইস ফেডেরাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ররা। মাত্র চার ইঞ্চি আকারের। এ ছাড়া আছে নানা ধরনের বড় মাছি বা পায়রা আকৃতির গুপ্তচর ড্রোন। অ্যামাজন ও নানা আন্তর্জাতিক কোম্পানি এখন ড্রোনের সাহায্যে জিনিসপত্র, টাটকা খাবার, ওষুধ আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তৈরি হয়েছে থার্মাল ড্রোন, যা ইনফ্রারেড তরঙ্গ দিয়ে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে খুঁজে নেবে জীবিত প্রাণীর উষ্ণতা।
এত দ্রুত এর চাহিদা বেড়ে ওঠার ফলে নানা সমস্যাও দেখা দিয়েছে। যেমন, আপনার অজান্তে পাঁচতলার জানলায় অন্ধকারে লুকিয়ে ছবি তুলতে পারে ড্রোন। আর জানলার কাছেই কিংবা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকার দরুণ কোনও গুপ্তচর ড্রোন কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড জেনে অনায়াসে তথ্য পাঠিয়ে দিতে পারে দুষ্টু লোকের কাছে। এ ছাড়া আছে শব্দদূষণ। ড্রোনের ডানা আর ইলেকট্রনিক্সের আওয়াজ ভারী বিরক্তিকর। অদূর ভবিষ্যতে অলিতে-গলিতে ছোট বড় মাঝারি মাপের ড্রোন ছড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ, আকাশে উড়োযানের সংখ্যা হাজার গুণ বেড়ে যাবে। তার জন্য চাই নিখুঁত জি পি এস এবং কন্ট্রোল ব্যবস্থা, যাতে যে কোনও মুহূর্তে বলা যায় অমুক রাস্তায় ক’টা ড্রোন আছে, তারা কোথায় কখন নামছে-উঠছে। মঙ্গলের বুকেও ড্রোন ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে। কম বাতাসে কিংবা বাতাসহীন পরিবেশে ওড়ার জন্য থ্রাস্টার এবং অন্য জ্বালানি নিয়েও গবেষণা চলছে। হয়তো ড্রোনের ডানায় ক্যামেরা চাপিয়ে বিশ্বভ্রমণ সম্ভব হবে এই শতকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy