Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Science News

চাঁদই হতে চলেছে আগামী দিনের সেরা ল্যাবরেটরি!

চাঁদ শুধুই যে আমাদের হাতের নাগালে, তা-ই নয়; এই ব্রহ্মাণ্ড কী ভাবে তৈরি হয়েছিল, সেই সময় ব্রহ্মাণ্ডের আচার, আচরণ কেমন ছিল, তা বুঝতে চাঁদের মতো এত কাছের, এত ভাল গবেষণাগার আর পাবটা কোথায়?

চাঁদের গবেষণাগারের নকশা। ছবি সৌজন্যে: নাসা

চাঁদের গবেষণাগারের নকশা। ছবি সৌজন্যে: নাসা

নব কুমার মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ১২:৫৮
Share: Save:

চাঁদের চেয়ে এত ভাল ল্যাবরেটরি এই ব্রহ্মাণ্ডে আর কোথায় পেতে পারি আমরা? যা আমাদের জন্য বানিয়েই রাখা হয়েছে কয়েকশো কোটি বছর ধরে।

হাত বাড়ালেই চাঁদ! দূরত্বটা মাত্র ৩ লক্ষ ৮২ হাজার কিলোমিটার। এই সুবিশাল ব্রহ্মাণ্ডে যা নস্যি! আমাদের এত কাছে আর কোনও মহাজাগতিক বস্তু নেই যে!

চাঁদ শুধুই যে আমাদের হাতের নাগালে, তা-ই নয়; এই ব্রহ্মাণ্ড কী ভাবে তৈরি হয়েছিল, সেই আদিমতম ব্রহ্মাণ্ডের আচার, আচরণ কেমন ছিল, তা বুঝতে চাঁদের মতো এত কাছের, এত ভাল গবেষণাগার আর পাবটা কোথায়?

চাঁদের গবেষণাগারের নকশা। নাসার শিল্পীর কল্পনায়

চাঁদে বায়ুমণ্ডল না থাকাটাই ‘শাপে বর’ হয়েছে আমাদের!

যে পরীক্ষানিরীক্ষাগুলি নিখুঁত ভাবে করা সম্ভব হয় না পৃথিবীর কোনও গবেষণাগারেই, তাদের জন্য চাঁদই হয়ে উঠতে চলেছে সেরা জায়গা। সেটা শুধু ব্রহ্মাণ্ডের নিরিখে তার দূরত্বটা খুবই কম বলে নয়; চাঁদের কোনও বায়ুমণ্ডল না থাকাটাও ‘শাপে বর’ হয়ে উঠতে চলেছে আমাদের।

আরও পড়ুন- ৩০ বছরের মধ্যেই চাঁদে বড় শিল্পাঞ্চল গড়ে ফেলবে মানুষ!​

আরও পড়ুন- চার বছরের মধ্যেই চাঁদের পাড়ায় ‘বাড়ি’ বানাচ্ছে নাসা!​

ব্রহ্মাণ্ডের মূল চারটি বল কী কী?

এই ব্রহ্মাণ্ডে মোট চার ধরনের মূল বল বা ফোর্স রয়েছে। কোনও পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রনগুলিকে খুব জোরালো বাঁধনে বেঁধে রাখে যে বল, তাকে বলা হয় স্ট্রং ফোর্স। এর চেয়ে শক্তিশালী বল আর নেই ব্রহ্মাণ্ডে। কিন্তু সেই বলের পাল্লাটা (রেঞ্জ) হয় খুব সামান্য। কারণ, তা শুধুই কার্যকর থাকে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে। আর যে বলে পরমাণুর নিউক্লিয়াস পরমাণুর বাইরের দিকে বিভিন্ন খোলকে থাকা ইলেকট্রনগুলিকে ধরে ও বেঁধে রাখে, সেই বলটার নাম- ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফোর্স বা তড়িৎ-চুম্বকীয় বল।

স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলছে, প্রোটন, ইলেকট্রন আর নিউট্রিনো ছাড়া ব্রহ্মাণ্ডের আর সব কণাই ক্ষণস্থায়ী। তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পর তুলনায় কম ভরের অন্য কণায় ভেঙে যায়। আর সেটা হওয়ার জন্য দায়ী লঘু বলই। আর পড়ে রইল, গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স বা অভিকর্ষ বল। কোনও মহাজাগতিক বস্তু তার ভরের জন্য ব্রহ্মাণ্ডের স্থান ও কালের (স্পেস-টাইম) জ্যামিতিকে বাঁকিয়েচুরিয়ে দেয় বলেও এক ধরনের বলের জন্ম হয়। যাকে বলা হয়, গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স বা অভিকর্ষ বল।

পৃথিবীতে মাটির নীচে কেজিএফ প্রোটন কণা ক্ষয়ের পরীক্ষার গবেষণাগার

বিগ ব্যাং বা মহা-বিস্ফোরণের পর এই চার ধরনের বলের জন্ম হয়েছিল। ওই চার ধরনের বলই ব্রহ্মাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি। যা ছিল, আছে ও থাকবে, যত দিন থাকবে এই ব্রহ্মাণ্ড।

চাঁদে কেমন দেখতে হবে মানবসভ্যতার কলোনি, গবেষণাগার? দেখুন ভিডিয়ো

৪টি বলকে এক সূত্রে বাঁধার চেষ্টা তো বহু দিনের...

এই চারটি বলকে এক সূত্রে বাঁধার চেষ্টা অনেক দিন ধরেই চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। জানার চেষ্টা করছে, আদিমতম ব্রহ্মাণ্ডে ওই চারটি বলই একত্রিত হয়ে ছিল কি না। আমরা বহু দিন ধরেই জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, নদী যেমন উৎস থেকে বেরিয়ে কিছুটা প্রবাহিত হওয়ার পর বিভিন্ন শাখা নদীতে ছড়িয়ে পড়ে, সেই ভাবেই কি ওই চারটি বল আলাদা হয়ে গিয়েছিল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর কোনও এক সময়ে?

চাঁদের বিভিন্ন জায়গায় কী ভাবে গবেষণাগার বানানো হবে, তার নকশা। নাসার শিল্পীর কল্পনায়

ছয়ের দশকে বিজ্ঞানীরা প্রথম দেখিয়েছিলেন, লঘু বল আর তড়িৎ-চুম্বকীয় বলকে একত্রিত করা যায়। তার পরেই, সাতের দশকের গোড়ার দিকে তাত্বিক বিজ্ঞানীরা (যাঁদের মধ্যে অন্যতম পাকিস্তানি বিজ্ঞানী আবদুস সালাম ও ভারতীয় বিজ্ঞানী যোগেশ পতি) এও দেখান, ওই দু’টি বলের সঙ্গে একত্রিত হতে পারে গুরু বল বা স্ট্রং ফোর্সও।

আটের দশকেই বুঝেছিলাম, চাঁদের প্রয়োজন কতটা

আটের দশকের গোড়ার দিকে আমার গবেষণার বিষয় ছিল, ওই গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিয়োরির (জিইউটি বা ‘গাট’)-ই একটি পূর্বাভাস নিয়ে। ওই তত্ত্ব বলেছিল, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনও ভেঙে যায় আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণায়। পজিট্রন, পায়ওন অথবা কেওন-এ।

কিন্তু তা পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণ করার কাজটি ছিল এক রকমের দুঃসাধ্যই। কারণ, প্রোটনের আয়ু। যা আদতে এক-এর পিছনে ৩৬টি শূন্য বসালে যে সংখ্যাটা হয়, প্রায় তত বছর!

আরও পড়ুন- হুগলির চন্দ্রকান্তের তৈরি অ্যান্টেনার ভরসায় ফের চাঁদের কক্ষপথে ঢুকছে ইসরো​

আরও পড়ুন- ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ চাঁদ না থাকলে প্রাণই আসত না পৃথিবীতে!​

যার মানে, বছরে প্রোটন ভাঙার ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গবেষণাগারে দেখা যেতে পারে বড়জোর একটি কি দু’টি। অন্য দিকে, প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীরে উপর আছড়ে পড়ছে মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে। যাদের আছড়ে পড়ার ঘটনার সঙ্গে প্রোটন কণার ক্ষয়ের ঘটনা মিলেমিশে যেতে পারে। তার ফলে, প্রোটন ক্ষয়ের পর্যবেক্ষণ বা তার হিসাবে ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই। সে জন্যই প্রোটন ক্ষয়ের ঘটনাগুলি পরীক্ষা করতে পৃথিবীতে গবেষণাগারগুলি বানানো হয়েছিল মাটির অনেক নীচে। যাতে মহাজাগতিক রশ্মি সেখানে পৌঁছতে না পারে।

তবে সেই মহাজাগতিক রশ্মি যে কণাদের তৈরি করেছিল আমাদের বায়ুমণ্ডলে ঢুকে তাদের সকলকে আমরা থামাতে পারলেও নিউট্রিনোদের থামানো সম্ভব হয়নি। কারণ, তারা কারও বাধাই মানে না যে!

তাই মাটির নীচে আমাদের গবেষণার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নিউট্রিনোরাই। কারণ, পৃথিবীর কোনও গবেষণাগারেই নিউট্রিনোদের জন্য দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে প্রোটন কণার ক্ষয় নিখুঁত ভাবে বোঝা সম্ভব নয়।

চাঁদে বিশেষ ধরনের এই গবেষণাগারের মডেল বানিয়েছে নাসা।

চাঁদে যে সেই ‘যন্ত্রণা’ নেই!

চাঁদে বায়ুমণ্ডলের ছিটোফোঁটাও নেই বলে মহাজাগতিক রশ্মি চাঁদে পৌঁছে নিউট্রিনোদের তৈরি করতে পারে না। তাই চাঁদে কয়েকশো ফুট মাটির নীচে প্রোটন কণা ক্ষয়ের গবেষণাগার বানাতে পারব অনায়াসেই। যেখানে মহাজাগতিক রশ্মি পৌঁছবে না। পৌঁছতে পারবে না নিউট্রিনোরাও। ফলে, সেখানে প্রোটন কণাদের ক্ষয়ের ঘটনা আমরা নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারব।

আর সেটা যদি পারি, তা হলে তা ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্যের জট খুলতে অনেকটাই সাহায্য করবে।

অ্যান্টিম্যাটারের অস্তিত্ব প্রমাণও সম্ভব চাঁদে

তা ছাড়াও, অ্যান্টি-ম্যাটারের অস্তিত্ব প্রমাণের পরীক্ষাটাও আমরা অনেক বেশি নিখুঁত ভাবে করতে পারব চাঁদে। সেখানে বায়ুমণ্ডল নেই বলে। আর বায়ুমণ্ডল নেই বলেই মহাজাগতিক রশ্মির ঝাপ্‌টা অনেকটা কম সইতে হবে চাঁদে। ফলে, অ্যান্টি ম্যাটারের অস্তিত্ব প্রমাণের কাজটা সেখানে সহজতর হবে।

এক্স-রে, গামা রে নিয়ে গবেষণাও করা যাবে চাঁদে

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুরোপুরি শোষিত হয়ে যায় বলে এক্স-রে, গামা রে নিয়ে গবেষণা পৃথিবীতে বসে করা যায় না। তার জন্য মহাকাশযান পাঠাতে হয় মহাকাশে। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই বলে এ বার আর মহাকাশযান পাঠাতে হবে না। চাঁদে বসেই করা যাবে সেই গবেষণা।

লেখক সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের ‘রাজা রামান্না’ চেয়ার অধ্যাপক

টেলিফোন সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী

ছবি সৌজন্যে: নাসা, অধ্যাপক নব কুমার মণ্ডল

ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা ‘ইসা’)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy