Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Science News

হুগলির চন্দ্রকান্তের তৈরি অ্যান্টেনার ভরসায় ফের চাঁদের কক্ষপথে ঢুকছে ইসরো

হুগলির শিবপুর গ্রামের ধনিয়াখালি স্কুলের ছাত্র চন্দ্রকান্ত কুমার তাই এখন ইসরোর ‘হাতে চাঁদ’! যখন নাম রেখেছিলেন, বাবা, মা ঘূণাক্ষরেও ভাবেননি, ছেলের নাম জুড়ে যাবে ভারতের চন্দ্র ও মঙ্গল অভিযানে! ভাবেননি, চন্দ্রকান্তের বানানো অ্যান্টেনাই ইসরোর প্রধান ভরসা হবে চাঁদ আর মঙ্গলের মুলুকে।

ছবি সৌজন্যে: ইসরো।

ছবি সৌজন্যে: ইসরো।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৯ ১৩:১৫
Share: Save:

হ্যাঁ, বাঙালিকে ছাড়া চাঁদে যাওয়াই হত না ইসরোর! শরীর-স্বাস্থ্য বিগড়ে গেলে ‘চন্দ্রযান-২’কে সারিয়ে তোলা, তার হালহকিকৎ জানার জন্য, চন্দ্রকান্তকে ছাড়া যে আর গতি নেই ভারতের!

হুগলির শিবপুর গ্রামের ধনিয়াখালি স্কুলের ছাত্র চন্দ্রকান্ত কুমার তাই এখন ইসরোর ‘হাতে চাঁদ’! যখন নাম রেখেছিলেন, বাবা, মা ঘূণাক্ষরেও ভাবেননি, ছেলের নাম জুড়ে যাবে ভারতের চন্দ্র ও মঙ্গল অভিযানে! ভাবেননি, চন্দ্রকান্তের বানানো অ্যান্টেনাই ইসরোর প্রধান ভরসা হবে চাঁদ আর মঙ্গলের মুলুকে।

ধনিয়াখালি স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি পড়ার সময় চন্দ্রকান্তও কি ভেবেছিলেন কখনও? কোনও দিন কি কোনও স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছিলেন চাঁদ নিয়ে?

চন্দ্রকান্ত বলছেন, ‘‘২০০১ সালে ইসরোর চাকরিতে ঢোকার আগে চাঁদ-টাদ নিয়ে ভাবিইনি কখনও। সেই চিন্তাভাবনা শুরু হয় ভারতের প্রথম চন্দ্রযান (চন্দ্রযান-১) পাঠানোর প্রস্ততি-পর্ব থেকে।’’

সেই যে দিন চাঁদ ঢুকল চন্দ্রকান্তের জীবনে...

তবু চাঁদ ঢুকে পড়ল চন্দ্রকান্তের জীবনে। ইসরোয় তাঁর পা দেওয়ার পরপরই। ‘চন্দ্রযান-১’ ২০০৮ সালে ঢুকল চাঁদের পাড়ায়। চাঁদের কক্ষপথে। আর তার বিশেষ একটি যন্ত্র বানানোর কাজে চন্দ্রকান্ত মন সঁপে দেন ২০০২/’০৩ থেকেই। চাঁদ যেন আষ্টেপৃষ্ঠেই বেঁধে ফেলল চন্দ্রকান্তকে। তার পর গেল ‘মঙ্গলযান’। লাল গ্রহের মুলুকে, ২০১৪-য়। সেই অভিযানের জন্যও ডাক পড়ল তাঁর। তাঁকেই যে বানাতে হবে সেই বিশেষ যন্ত্রটি। তাঁরই নকশায়।

‘চন্দ্রযান-২’ মিশনের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর (টেকনিকাল) চন্দ্রকান্ত কুমার

এ বার ‘চন্দ্রযান-২’। হুগলির চন্দ্রকান্ত ছিলেন, আছেন, থাকছেন। চাঁদে তো বটেই, মঙ্গলেও।

চন্দ্রকান্তের কেরামতি কোথায়?

তা সে চন্দ্রযান-১ বা চন্দ্রযান-২-ই বলুন বা মঙ্গলযান। পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে এই সৌরমণ্ডলে দূরের গন্তব্যে পৌঁছতে ইসরোর বার বারই প্রয়োজন হয়েছে চন্দ্রকান্তকে। এ বারও। মহাকাশযানগুলির অ্যান্টেনা বানাতে। চন্দ্রকান্তের বানানো অ্যান্টেনা না হলে ইসরোর চলবে না!

চন্দ্রযান-২: দেখুন ইসরোর ভিডিয়ো

আরও পড়ুন- চাঁদে যেতে সঙ্গে নিন মাটি, পকোড়া...​

হুগলির ধনিয়াখালি স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর চন্দ্রকান্ত ফিজিক্সে অনার্স পড়তে যান বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনে। তার পর এমএসসি ও পিএইচডি রাজাবাজারের ইনস্টিটিউট অফ রেডিও ফিজিক্স থেকে।

মহাকাশযানে কাজ কী অ্যান্টেনার?

এই যে আমরা কলকাতায় বসে ক্যালিফর্নিয়ার বন্ধুর সঙ্গে দেদার কথা বলি টেলিফোনে, আলাক্সায় ভূমিকম্প বা সাইবেরিয়ায় ভয়ঙ্কর উল্কাপাত হলে টেলিভিশনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার ছবিটা দেখতে পাই ডায়মণ্ডহারবার বা সিঙ্গুরে বসে, সেটা সম্ভব হয় একটাই কারণে। তা হল, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (রেডিও কম্পাঙ্ক)। রেডিও থেকে দৃশ্যমান আলো হয়ে অতিবেগুনি (আল্ট্রাভায়োলেট), এক্স-রে, গামা-রে, তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ আলোর বর্ণালীর (স্পেকট্রাম) ব্যাপ্তি এতটাই। তার মধ্যে খুব সামান্য একটা অংশকে আমরা দেখতে পাই। তাকেই বলা হয় দৃশ্যমান আলো। আর কোনও কিছুই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। যাদের খালি চোখে দেখতে পাই না, তাদের মধ্যেই পড়ে রেডিও, এক্স-রে, গামা-রে। আর যেহেতু সেগুলি এগিয়ে চলে তরঙ্গের মতো, তাই তার যেমন তরঙ্গদৈর্ঘ্য (ওয়েভলেংথ্‌) থাকে, তেমনই থাকে কম্পাঙ্ক। যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি হয়, তার কম্পাঙ্ক তত কম। কম্পাঙ্ক কম মানে তার শক্তি কম।

বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভরা হচ্ছে চন্দ্রযান-২-এ। বেঙ্গালুরুর ইউ আর রাও স্যাটেলাইট সেন্টারে

ইসরোর গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে কথা বলার খুব প্রয়োজন হয় মহাকাশে থাকা যানগুলির। খুব দরকার হয়, মহাকাশযানগুলি কী জবাব দিচ্ছে, তা শোনার। তারা কী বার্তা পাঠাচ্ছে, তা পড়ে দেখার, দ্রুত। চাঁদ, মঙ্গলের মুলুকে যেতে অতটা দূরত্ব পাড়ি দিতে গিয়ে তো বিগড়ে যেতেই পারে মহাকাশযান, তার শরীর-স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে, তখন তা কী ভাবে জানতে পারবে ইসরোর গ্রাউন্ড স্টেশন?

অ্যান্টেনা ছাড়া যে মহাকাশযান দিশাহারা!

তখনই দরকার পড়ে চন্দ্রকান্তের। তাঁর বানানো অ্যান্টেনার। যা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিকে ধরে তা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাঠাতে পারে। আর তারই হাত ধরে গ্রাউন্ড স্টেশন জানতে পারে, মহাকাশযানের তবিয়ত কেমন রয়েছে? তা ঠিক মতো কাজ করছে কি না। সেই মহাকাশযানে থাকা অ্যান্টেনাগুলি কী বলতে চাইছে, কী ধরনের বার্তা পাঠাচ্ছে, গ্রাউন্ড স্টেশন তা বুঝতে পারে, ডিকোড করতে পারে। প্রয়োজনে ‘কমান্ড’ বা নির্দেশ পাঠাতে পারে মহাকাশযানে।

আরও পড়ুন- বৃদ্ধ, অথর্ব, তবু নতুন তারার জন্ম দিচ্ছে গ্যালাক্সি! এই প্রথম দেখলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা​

তাই অ্যান্টেনা ছাড়া মহাকাশে ওই যানগুলি যেমন দিশাহারা, তেমনই মহাকাশযানের অ্যান্টেনা বিগড়ে গেলে বিপদে পড়ে যায় গ্রাউন্ড স্টেশন। তার যে আর কিছুই করার থাকে না। মহাকাশযানের সঙ্গে তার যোগাযোগের সূত্র তো ওই অ্যান্টেনাই।

বেঙ্গালুরু থেকে উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের দিকে রওনা দিল চন্দ্রযান-২

অ্যান্টেনার সঙ্গে আরও দু’টি জিনিস থাকে মহাকাশযানে। একটি, রিসিভার। অন্যটি- ট্রান্সমিটার। সেই রিসিভার ও ট্রান্সমিটার বানিয়েছেন যাঁরা, তাঁদেরও কাজ দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন চন্দ্রকান্ত।

চন্দ্রযান-২-এ কী ভূমিকা চন্দ্রকান্তের?

তার আগে আমাদের জেনে-বুঝে নিতে হবে কী কী থাকছে চন্দ্রযান-২-এ। চন্দ্রযান-২-এ থাকছে একটি ‘অরবিটার’। যা ঘুরবে চাঁদের বিভিন্ন কক্ষপথে। থাকছে একটি ‘ল্যান্ডার’। বিক্রম। যা চাঁদের কক্ষপথে ঢোকার পর চন্দ্রযান-২-এর শরীর থেকে আলাদা হয়ে টুপ করে এসে নামবে চাঁদের পিঠে (লুনার সারফেস)। হাল্কা ছোঁয়ায়। যাকে বলা হয় ‘সফ্‌ট ল্যান্ডিং’। আছড়ে পড়লে তো একেবারেই নষ্ট হয়ে য়াবে, পুড়েও যাবে। ওই ল্যান্ডারের মধ্যেই থাকছে একটি ‘রোভার’। প্রজ্ঞান। চাঁদের পিঠ ছোঁয়ার পর যা ল্যান্ডারের শরীর থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদের বিশেষ কয়েয়কটি এলাকা বা অংশ ঘুরে বেড়াবে।

চন্দ্রযান-২-এ রয়েছে মোট ৭টি অ্যান্টেনা। ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-এ রয়েছে ১টি। সবক’টি অ্যান্টেনাই চন্দ্রকান্তের বানানো। চন্দ্রযান-১-এ ছিল ১১টি অ্যান্টেনা। ৭টি অরবিটারে। আর চাঁদের পাড়ায় ঢুকে চন্দ্রযান-১ যা ছুঁড়ে ফেলেছিল চাঁদের মাটিতে সেই ‘মুন ইম্প্যাক্ট প্রোব (এমআইপি)’-এ ছিল ৪টি অ্যান্টেনা। ওই ১১টি অ্যান্টেনারও নকশা থেকে শুরু করে নির্মাণ, চন্দ্রকান্ত ছিল গতি ছিল না ইসরোর। মঙ্গলযানের সামনে ও পিছনের ৪টি অ্যান্টেনাও তাঁরই বানানো।

ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। এখানেও রয়েছে চন্দ্রকান্তের বানানো অ্যান্টেনা, রিসিভার ও ট্রান্সমিটার

চন্দ্রযান-২-এ সেই ৭টি অ্যান্টেনা রয়েছে কোথায় কোথায়?

বেঙ্গালুরুতে ইসরোর ইউ আর রাও স্যাটেলাইট সেন্টার থেকে টেলিফোনে চন্দ্রযান-২-এর ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর (টেকনিকাল) চন্দ্রকান্ত কুমার ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে জানালেন, অরবিটারের সামনে থাকছে ২টি অ্যান্টেনা। পিছনে ২টি। দুই পাশে রয়েছে ১টি করে অ্যান্টেনা। আর ১টি অ্যান্টেনা রয়েছে বিকল্প হিসাবে। প্রয়োজনে কাজে লাগানো হবে। সামনে ও পিছনে যে ৪টি অ্যান্টেনা রয়েছে, তাদের মধ্যে ২টিকে কাজে লাগানো হবে আপলিঙ্ক আর ২টিকে লাগবে ডাউনলিঙ্কের জন্য।

চন্দ্রকান্তের কথায়, ‘‘সবচেয়ে বড় অ্যান্টেনাটি রয়েছে পাশে। দেখতে অনেকটা ছাতার মতো। যার ব্যাস ০.৭ মিটার। এটা ‘রিফ্লেক্টর’ বা প্রতিফলকের কাজ করবে। লম্বায় ১৫০ মিলিমিটার। আর ছোট অ্যান্টেনাগুলির ব্যাস বড়জোর ৫০ মিলিমিটার। এইগুলিই অরবিটারের ‘আইজ অ্যান্ড ইয়ার্স (চোখ ও কান)’। ছোট অ্যান্টেনাগুলির সঙ্গে রয়েছে একটি করে রিসিভার ও ট্রান্সমিটার। আর বিকল্প হিসাবে রাখা আছে ১টি রিসিভার ও ১টি ট্রান্সমিটার। আর ল্যান্ডারের অ্যান্টেনায় রয়েছে ১টি রিসিভার ও ১টি ট্রান্সমিটার। খুব হাল্কা হবে বলে কার্বন ফাইবার দিয়ে বানানো হয়েছে বড় অ্যান্টেনাটিকে। আর ছোট অ্যান্টেনাগুলির সবক’টিই প্রিন্টেড সার্কিট।’’

চন্দ্রকান্তের জন্য রইল আমাদের একরাশ শুভেচ্ছা। অভিনন্দন। আগামী দিনে তাঁর অ্যান্টেনা দিশা দেখাক এই ব্রহ্মাণ্ডে ভারতের আরও দূর, দূরান্তরের অভিযানে!

ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইসরো

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy