Advertisement
E-Paper

‘আর কত দিন...’, ক্যানসার চিকিৎসকেরা শুনতে চান না

কেউ লড়ে চলেছেন গবেষণাগারে। রোগীকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার অদম্য জেদ দেখাচ্ছেন কেউ। কেউ প্রিয়জনের হাতে হাত রেখে ভরসা জোগাচ্ছেন। তাঁদের জন্য ‘ক্যানসার কেয়ারগিভার ডে’ পালন করা হল বুধবার।

An image of Cancer

—প্রতীকী চিত্র।

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০৭
Share
Save

বাবার ক্যানসার। চিকিৎসকের শরণাপন্ন তিন ছেলে। তাঁদের অনুরোধ, বাবাকে কিছু জানাবেন না। এই ধাক্কা তিনি নিতে পারবেন না। কিছু পরে বাবা এলেন। ছেলেদের ঘর থেকে বার করে দিয়ে দরজার ছিটকিনি তুলে দিলেন। তার পর গলা নামিয়ে বললেন, ‘‘আমার ছেলেরা বড্ড ছোট। আমার যে ক্যানসার, ওদের বলবেন না। জানলে কষ্ট পাবে।’’ স্মৃতির পাতা ঘেঁটে বলছিলেন ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়।

প্রায় ৪৫ বছর ধরে এ রোগের চিকিৎসা করছেন সুবীর। মৃত্যুর পাশাপাশি অনেক ‘জীবন’ও দেখেছেন। মুহূর্তের মধ্যে, মেডিক্যাল রিপোর্টের একফালি কাগজে লেখা কয়েকটা লাইনে পরিবারের মাথাকে বোঝা হয়ে যেতে দেখেছেন। যে বোঝা কবে ঘাড় থেকে নামবে, তার জন্য প্রশ্ন করতে শুনেছেন, ‘‘কত দিন?’’ আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘‘আগে চুপচাপ শুনতাম। এখন খুব রাগ হয়। ক্যানসার হলেই পরিবারের লোক জিজ্ঞাসা করেন, কত দিন সময় আছে! কেন, ডায়াবিটিস হলে তো জানতে চান না।’’

প্রবীণ চিকিৎসক নিজেই জানাচ্ছেন, এই প্রশ্নের পিছনে আর্থিক সঙ্গতি একটা বড় কারণ। কিন্তু তা-ও এমন প্রশ্ন কেন! হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েও তো মানুষ মরে যেতে পারে। কিংবা স্রেফ পথ দুর্ঘটনা! কই, মানুষ রোজ তো নিজেকে এমন প্রশ্ন করেন না।

তবে প্রবীণ চিকিৎসকের ঝোলায় অনেক ভাল স্মৃতিও আছে। এক বার এক অল্পবয়সি মেয়ে এসে জানাল, তাঁর বাবার অবস্থা খুব খারাপ। মুম্বইয়ের হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছে, খুব বেশি হলে ১৫ দিন। তরুণীর ‘আপনি কিছু করুন’ অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে পারেননি সুবীর। চেষ্টা করেছিলেন। আড়াই মাস পরে রোগী মারা যান। তরুণী পরে আসেন দেখা করতে। হাতে উপহার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই। সুবীর বলেন, ‘‘কী আর করতে পারলাম। ১৫ দিনের বদলে আড়াই মাস।’’ মেয়ে বলে, ‘‘বাবা-মেয়ের এই যে বাঁধন... আরও কিছু দিন বাবাকে দিলেন।’’

ক্যানসার চিকিৎসক মানে রোগী প্রথম যাঁর হাত ধরেন। ভরসা খোঁজেন। ঠিক ও দ্রুত চিকিৎসা পেলে অনেকই ক্যানসারমুক্ত হয়ে ওঠেন। এমন নজিরও অনেক। ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, তাঁর এক রোগীর গলায় ক্যানসার হয়েছিল। অস্ত্রোপচার করে স্বরযন্ত্র বাদ দিতে হয়। তার পর কৃত্রিম যন্ত্র বসানো হয়েছে। রোগী আবার কথা বলতে পারছেন।

গৌতম জানান, তাঁর অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন, পরিবারের লোক যা-ই ভাবুন, অনেক রোগীই সদর্থক ভাবেন। এই বিশ্বাস নিয়ে এগোন, চিকিৎসা চলছে, তিনি ঠিক হয়ে যাবেন। গৌতমের কথায়, ‘‘রোগীর সদর্থক ভাবনা অনেক সময়েই আমার মনের জোর বাড়িয়েছে।’’

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আর্থিক দিক থেকে দেখলে ক্যানসারের চিকিৎসা আগের থেকে অনেক বেশি আয়ত্তে এসেছে। নানা ধরনের বিমা এসেছে বাজারে। সরকারি সাহায্য প্রকল্প খরচের ভার পুরো না কমালেও কিছুটা কম করেছে। তবে গ্রামের মানুষ এ সব থেকে অনেক দূরে। শহরে আসার গাড়িভাড়াটাই দিনমজুর রোগীর পকেটে বাড়ন্ত। ক্যানসার চিকিৎসক সায়ন পালের কথায়, ‘‘গ্রাম তো ছেড়েই দিন, পশ্চিমবঙ্গের মফস্‌সল শহরগুলোতে পর্যন্ত কিছু নেই। ঠিক চিকিৎসার খোঁজে শহরে আসতে আসতে রোগ ছড়িয়ে যায় শরীর জুড়ে। কিন্তু ক্যানসার যদি প্রথম দিকেই ধরা পড়ে, অনেক সময় রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।’’ তাঁর আক্ষেপ অন্যান্য বড় শহরের তুলনায়, কলকাতার হাসপাতালে ক্যানসার ডিপার্টমেন্ট খুব কম, হাতেগুণে পাঁচ-ছ’টা। সেখানে হায়দরাবাদে প্রায় ১৩টা ডিপার্টমেন্ট রয়েছে।

সায়ন আরও বলেন, ‘‘ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নতি ঘটলেও সামাজিক ট্যাবু যায়নি। অনেক ক্যানসার রোগী সুস্থ হওয়ার পরে জানাতে চান না, তাঁর ক্যানসার হয়েছিল। যেন নিষিদ্ধ বিষয়, গোপন করে রাখেন। ফলে ভাল খবরগুলো অনেক সময়ই চাপা পড়ে থাকে।’’ এর কারণও হয়তো সেই সমাজ ও তার ভ্রান্ত ধারণা, যার সঙ্গে প্রথাগত শিক্ষার কোনও যোগ নেই। যেমন— সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে চাকরি চলে গিয়েছে যুবকের, কারণ তাঁর ক্যানসার হয়েছিল। কর্তৃপক্ষের ধারণা তাঁর আর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা নেই। কিংবা স্তন ক্যানসার থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা স্ত্রীর পাশে আর শোন না স্বামী।

তবে বহু আক্ষেপের মধ্যেও হিরেমানিক থাকে। দশ-পনেরো বছর আগের কথা বলছিলেন সুবীর। তখন তিনি কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের অঙ্কোলজি বিভাগের প্রধান। নদিয়ার গ্রাম থেকে মেডিক্যাল কলেজে এসেছিলেন এক ক্যানসার রোগী। হতদরিদ্র, পায়ে জুতো নেই, গায়ে ছেঁড়া জামা। পাশে দাঁড়িয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত বৌ। তাঁর একহাত ঘোমটায় অবশ্য সব ভয়ই সে দিন ঢাকা পড়েছিল। অনেক চেষ্টাতেও রোগীকে বাঁচানো যায়নি। এর কিছু পরে হাসপাতালে আসেন সেই মেয়ে। সেই এক হাত ঘোমটা। চেম্বারের বাইরে থেকে যখন উঁকি মেরেছিলেন, ওই ঘোমটা দেখে চিনতে পেরেছিলেন সুবীর। ভিতরে ডাকতে ঝোলা থেকে একটা লাউ বার করে টেবলে রাখেন। বলেছিলেন, ‘‘ও (বর) বলেছিল, ডাক্তারটা আমার জন্য অনেক করছে। এই চারা লাগাচ্ছি। ফল ধরলে প্রথম ফলটা ওঁকে দিস।’’

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cancer Cancer Survivor Cancer Patient Doctors

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}