নিমগ্ন: কিংস কলেজ, লন্ডনে নিজের গবেষণাগারে কর্মরত রোজ়ালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন
ডিএনএ অণুর প্যাঁচানো সিঁড়ির মতো গঠন আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয়ে জীবদ্দশায় তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি। তাঁর কৃতিত্বের কথাও বহু বছর ছিল অন্ধকারে। তিনি, অণুজীববিজ্ঞানী রোজ়ালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন, অনেকের মতে জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত মহিলা বিজ্ঞানী। তাঁকে ‘ডার্ক লেডি অব ডিএনএ’ নামেও ডাকা হয়। এই বছর রোজ়ালিন্ডের জন্মের একশো বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই সুযোগে তাঁর জীবনের পাতায় চোখ রেখে দেখা যাক, সমকাল কী ভাবে গ্রহণ করেছিল এই প্রতিভাময়ী বিজ্ঞানীকে।
২৫ জুলাই, ১৯২০ সাল। লন্ডনের নটিংহিল শহরে এক সম্পন্ন ইহুদি পরিবারে রোজ়ালিন্ডের জন্ম। দুর্দান্ত মেধাবী মেয়েটি ১৫ বছর বয়সেই বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। রক্ষণশীল ইংরেজ সমাজে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা তখনও খুব সহজ ছিল না। রোজ়ালিন্ডের বাবাও চেয়েছিলেন মেয়ে সমাজকর্মী হোক। তবে জেদি মেয়েটি শেষ অবধি কেমব্রিজের নিউয়েনহ্যাম কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা আর রসায়নবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। যোগ দেন ব্রিটিশ কোল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন-এর অধীনে কয়লার গঠন নিয়ে গবেষণায়। এই কাজের উপর পাঁচটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে তিনি ১৯৪৫ সালে পিএইচ ডি ডিগ্রি পান। পদার্থের গঠন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি তখন ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, কারণ এই পদ্ধতিতে কেলাসিত বা ক্রিস্টালাইন পদার্থের অন্দরমহলে পরমাণুর বিন্যাস অবধি বোঝা যায়। ফ্রান্সের এক গবেষণাগারে যোগ দিয়ে রোজ়ালিন্ডও এই নতুন বিষয়টিতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করলেন। এক দিকে জৈব অণুর ছবি তোলা, অন্য দিকে উচ্চ তাপমাত্রায় কার্বনের গ্রাফাইটে পরিণত হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বার করা, দুইয়ে মিলে রোজ়ালিন্ড গবেষণার জগতে বেশ পরিচিত নাম হয়ে উঠছিলেন। এমন সময়ে লন্ডনের কিংস কলেজে তিন বছরের জন্য এক গবেষকের পদ নিয়ে ১৯৫১ সালে তিনি লন্ডনে ফিরলেন।
তখন কিংস কলেজের বায়োফিজ়িক্স বিভাগের প্রধান ছিলেন স্যর জন র্যান্ডল। বিশেষ ভাবে এক্স-রে ব্যবহার করে ডিএনএ-র উপর গবেষণা করার জন্যই তিনি রোজ়ালিন্ডকে নিয়োগ করেছিলেন। সেই সময়ে কিংস কলেজে ডিএনএ নিয়ে কাজ করছিলেন মরিস উইলকিন্স। তিনি ধরে নিলেন, রোজ়ালিন্ড তাঁর অধীনেই কাজ করবেন। কিন্তু রোজালিন্ডের যথেষ্ট প্রস্তুতি আর স্বাধীন ভাবনাও ছিল। ফলে তিনি মোটেই উইলকিন্সের অধীনে থাকতে চাইলেন না। এর জন্য কিংস কলেজে সেই সূচনাপর্ব থেকেই রোজ়ালিন্ডের সঙ্গে উইলকিন্সের তেমন বনিবনা হল না। তবে রোজ়ালিন্ডের নিজের কাজ ভালই এগোতে লাগল। ডিনএনএ-কে কেলাসে পরিণত করা, তার পরে এক্স-রে ব্যবহার করে ছবি তোলা, দুই-ই সে সময় ছিল দুঃসাধ্য কাজ। রোজ়ালিন্ড তাঁর কাজের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি সূক্ষ্ম তন্তুর মতো ‘কাফ থাইমাস ডিএনএ স্যাম্পল’ ব্যবহার করেছিলেন। আর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বানিয়ে নিয়েছিলেন জৈব অণুর পক্ষে উপযুক্ত এক এক্স-রে ক্যামেরা, যার সাহায্যে ছবিও উঠতে লাগল চমৎকার। বিভিন্ন আলোচনা চক্রে রোজ়ালিন্ড সে সমস্ত ফলাফল দেখাতেও লাগলেন।
একই সময়ে ডিএনএ-র গঠন নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছিলেন জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক। ডিএনএ হল এক অতিমাত্রায় লম্বা অণু, যার গঠনের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য সুগার আর ফসফেট অণু। অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থাইমিন ও সাইটোসিন, এই চার রকম নিউক্লিয়োটাইড বেস জুড়ে এর কাঠামোটি তৈরি। ডিএনএ যদি একটা মালা হয়, তা হলে এই অণুগুলো হবে মালার পুঁতি। ওয়াটসন ও ক্রিক ডিএনএ অণুর রাসায়নিক সঙ্কেত থেকে জটিল গাণিতিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন পরমাণু দূরত্ব এবং কোণ বিশ্লেষণ করে সুগার-ফসফেট-বেসগুলো কী ভাবে সাজানো থাকে, তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। গাণিতিক বিশ্লেষণের সঙ্গে তাঁদের দরকার ছিল পরিষ্কার এক্স-রে চিত্র, যেটা তাঁদের গবেষণাগারে তখন পাওয়া যাচ্ছিল না।
ফোটোগ্রাফ ৫১। রোজ়ালিন্ড-এর তোলা কেলাসাকার ডিএনএ-র এই ছবিই ছিল প্রাণের রহস্য বুঝে ওঠার প্রধান চাবিকাঠি।
অন্য দিকে রোজ়ালিন্ড এক্স-রে ছবি এবং অন্যান্য বিশ্লেষণ থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ডিএনএ অণু আসলে দু’ছড়া হার বা মালার মতো একটা যুগ্ম গঠন, যার বাইরের দিকে আছে সুগার আর ফসফেট অণুগুলো। তিনি এটাও বুঝেছিলেন যে, চারপাশে জলের অণুর উপস্থিতির তারতম্যে ডিএনএ দু’রকম রূপে ধরা দেয়, ‘এ’ আর ‘বি’। তবে গোটা বিষয়টায় নিঃসন্দেহ না হয়ে তিনি ছবি সমেত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে চাননি।
১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে ওয়াটসন কিংস কলেজে এলেন। সেই সময়ে উইলকিন্স তাঁকে রোজ়ালিন্ডের তোলা একটা এক্স-রে ফোটোগ্রাফ দেখতে দেন, যা পরবর্তী কালে ‘ফোটোগ্রাফ ৫১’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সেই ছবি দেখে ওয়াটসনের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। ডিএনএ-র প্যাঁচালো চেহারাটা ছবির মতো ভেসে উঠল ওঁর চোখে। নিজের পিএইচ ডি-র সময় থেকে উনি এই রকম দ্বি-সূত্রক বা ডাবল স্ট্র্যান্ডেড অণু নিয়ে কাজ করেছেন। তাই ছবিটা দেখে উনি অতি সহজে অনেকটা বুঝে গেলেন। কিংস থেকে ফেরার পথে চরম উত্তেজিত ওয়াটসন ছবিটা নিজের হাতেই নোটবইতে যতটা সম্ভব এঁকে ফেললেন। ফিরেই ফ্রান্সিসকে বোঝাতে হবে এই দ্বি-সূত্রক গঠনই আসলে ঠিক। কারণ, জীববিজ্ঞানে বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকেই জোড়ায় জোড়ায় থাকতে দেখা যায়।
রোজ়ালিন্ডের তোলা ছবির হাত ধরে ক্রিক তাঁর গণনার জন্য দরকারি তথ্য পেয়ে গেলেন, এবং নতুন করে কাজ শুরু করলেন। শুধু ছবিটাই নয়, ক্রিস্টালোগ্রাফির যে খুঁটিনাটি তথ্য দরকার ছিল, তাও ক্রিক পেয়ে গিয়েছিলেন। মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের এক আলোচনা চক্রের সূত্রে রোজ়ালিন্ডের কাজের ছবি ও তথ্য গিয়েছিল কাউন্সিলের অধিকর্তা ম্যাক্স পেরুজ়ের কাছে। তিনি চুপচাপ সেটা লরেন্স ব্র্যাগকে এবং ব্র্যাগ সেটা ক্রিককে পাঠিয়ে দেন। রোজ়ালিন্ডের নোটবুক জানাচ্ছে, ২৪ ফেব্রুয়ারি নাগাদ তিনি যাবতীয় তথ্য ব্যাখ্যা করে উঠতে পারছেন। অন্য দিকে ফেব্রুয়ারির সেই শেষ সপ্তাহেই ডিএনএ-র মডেল শেষ করে ঘুমোতে যাচ্ছেন ফ্রান্সিস ক্রিক। ডিএনএ যে দ্বি-সূত্রক এক অণু এবং এর সূত্র দু’টি প্যাঁচালো এবং পরিপূরক, একটা ডান দিকে পাক খেলে দ্বিতীয়টা বাঁ দিকে পাক খায়, নিউক্লিয়োটাইডগুলোর যে অসংখ্য বিন্যাস হতে পারে এবং এই বিন্যাসের তারতম্যই যে জীবজগতের যাবতীয় বৈচিত্রের গোড়ার কথা— এ সব কিছুই ব্যাখ্যা করে ১৯ মার্চ পেপার লিখছেন রোজ়ালিন্ড। সেই পেপার জার্নালে পাঠানোর আগেই ওয়াটসন ও ক্রিক তাঁদের ডিএনএ মডেল দেখাতে কেমব্রিজে ডেকে পাঠাচ্ছেন রোজ়ালিন্ড আর উইলকিন্সকে। ঠিক হল, ডিএনএ মডেল ওয়াটসন-ক্রিকই প্রকাশ করবেন। তার সপক্ষে পরীক্ষামূলক প্রমাণ হিসেবে রোজ়ালিন্ড-উইলকিন্স তাঁদের পেপার প্রকাশ করবেন। ১৯৫৩ সালের ১৮ এপ্রিল নেচার পত্রিকায় প্রথম ছাপা হল ওয়াটসন-ক্রিকের ডিএনএ মডেল, পেপারে কিংস কলেজে তাঁদের সহকর্মীদের ‘অপ্রকাশিত’ পরীক্ষালব্ধ প্রমাণের কথা উল্লেখ থাকল। ২৫ এপ্রিল নেচার-এ আলাদা ভাবে প্রকাশিত হল ফ্রাঙ্কলিন-গসলিং আর উইলকিন্স ও সহকর্মীদের দুটো পেপার। রোজ়ালিন্ড তাঁর পেপারে একটা নোট সংযোজন করলেন যে, এই কাজ এই জার্নালেই আগে প্রকাশিত তাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সবই ঠিক হল। শুধু রোজ়ালিন্ড জানতেও পারলেন না যে, তাঁর কাজ থেকে অন্তত দু’বার তথ্য নিয়েছেন ওয়াটসন-ক্রিক।
এর পর রোজ়ালিন্ড লন্ডনেরই বারবেক কলেজে কাজ শুরু করেন। এ বার বিষয়, টোব্যাকো মোজেয়িক ভাইরাস। তিনি এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ব্যবহার করে দেখালেন, টিএমভি-র গঠন ফাঁপা নলের মতো। পোলিয়ো ভাইরাসের উপরও কাজ করছিলেন তিনি। সাফল্যও আসছিল। এই সময় জীবন তাঁর সঙ্গে শ্রেষ্ঠ রসিকতাটা করল। জরায়ুর ক্যানসার তাঁকে কেড়ে নিল মাত্র ৩৮ বছর বয়সে (১৯৫৮)। সুতরাং, ভাবার সুযোগ থেকে গেল যে, রোজ়ালিন্ড বেঁচে থাকলে ওয়াটসন-ক্রিক-উইলকিন্স-এর সঙ্গেই নোবেল পুরস্কার পেতেন। কিন্তু ওয়াটসন-ক্রিক তাঁদের নোবেল পুরস্কারের বক্তৃতায় রোজ়ালিন্ডের কথা উল্লেখ করেননি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী লিনাস পাউলিংও সব কিছু জেনেশুনে ‘বি’-ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কারের কৃতিত্ব উইলকিন্সকে দিয়েছিলেন। তবে রোজ়ালিন্ড তখন এ সবের ঊর্ধ্বে। কেন ওয়াটসন বা ক্রিক রোজ়ালিন্ডকে ওই ৫১ নম্বর ছবির কথা জানালেন না, আর কেনই বা পেরুজ় চুপিচুপি ক্রিকদের তথ্য সরবরাহ করলেন? নিরপেক্ষ ভাবে দেখলে বলতে হয়, শুধুমাত্র পেশাগত ঈর্ষা ছাড়াও একটা মেয়ের এগিয়ে যাওয়াকে সহ্য করতে না পারাও এর একটা কারণ হতে পারে। তবে পুরস্কার বড় কথা নয়, সংক্ষিপ্ত জীবনে কয়লা থেকে ডিএনএ হয়ে টিএমভি, যে বিষয়ে কাজ করেছেন, তাতেই সোনা ফলিয়েছেন যে মেয়েটি, শতবর্ষে তাঁর কাজ নিয়ে অন্তত আমাদের মধ্যে আগ্রহ যথেষ্ট।
সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy