বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাতৃভাষায় কলম ধরেছিলেন বিকাশ। — ফাইল চিত্র।
শুধুমাত্র বিজ্ঞানের জটিল ও গহীন চিন্তালোকেই বাস করতেন না। বিকাশ সিংহের আনাগোনা ছিল বিজ্ঞানচর্চা থেকে দূরে থাকা অগণিত সাধারণ মানুষের পাড়ায়। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চেতনাকে গণমুখী চরিত্র দিতেও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন তিনি। ব্রহ্মাণ্ডের আয়ুষ্কাল নিয়ে এই সে দিনও সাধারণ পাঠকের জন্য অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেছেন পদার্থবিজ্ঞানে যুগান্তকারী এক জটিল তত্ত্বের কথা। আদিহীন, অন্তহীন ব্রহ্মাণ্ডের ধারণাকে ধরাশায়ী করে কী ভাবে মহাবিস্ফোরণের তত্ত্ব তার বিজয়কেতন ওড়াল, তার এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই ইতিহাস লিখনে স্বল্প পরিসরে কতখানি সহজ হওয়া যেতে পারে, এর প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর ‘স্থান কাল বিশ্বলোক’ বা ‘সৃষ্টি ও কৃষ্টি: বন্ধনহীন গ্রন্থি’-র মতো বইয়ের পাতায়।
বিকাশ সিংহের জন্ম মুর্শিদাবাদের কান্দির রাজপরিবারে। ১৯৪৫ সালে। বাংলার বহু জমিদার পরিবার যখন বিলাসব্যসনে বয়ে গিয়েছে বা যাচ্ছে, মুর্শিদাবাদের এই সিংহ পরিবারের সদস্যেরা তখন শিক্ষাদীক্ষা থেকে শুরু করে রাজনীতি, সমাজের নানা পরিসরে সক্রিয় থেকেছেন। বিকাশের বাবার নাম বৃন্দাবনচন্দ্র সিংহ। জেঠু বিমলচন্দ্র সিংহ এবং জ্যাঠতুতো দাদা অতীশ সিংহ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী। প্রাক্তন সাংসদ অতীশ বাম আমলে রাজ্যের বিরোধী দলনেতার পদেও ছিলেন। বিকাশ তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে স্নাতক। উচ্চতর শিক্ষা কেমব্রিজের কিংস কলেজে। সেখান থেকে ফিরে ১৯৭৬ সালে যোগ দেন মুম্বইয়ের ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে। পরবর্তী সময়ে কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এবং ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের ডিরেক্টর হিসাবেও কাজ করেছেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমির ফেলো হিসাবে তিনি সম্মানিত হন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯৪-এ বিজ্ঞানাচার্য সত্যন্দ্রনাথ বসুর জন্ম শতবর্ষ সম্মানের প্রাপকও ছিলেন বিকাশ।
২০০৫ সালে, মনমোহন সিংহের আমলে বিকাশ প্রধানমন্ত্রীর সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন। ২০০৯-এ একই পদে পুনর্নিয়োগ করা হয় তাঁকে। এর মাঝে ২০০৮ সালে, আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির পর মনমোহন সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছিল বামেরা। সরকারকে আস্থা ভোটের মুখেও পড়তে হয়। এই পর্বে দেশ জুড়ে পরমাণু চুক্তি নিয়ে যে মহাবিতর্ক তৈরি হয়, সেই বিতর্কে কেন্দ্রের সমর্থনে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছিলেন বিকাশ। নিজের দৃঢ় মতামত রেখেছেন সংবাদমাধ্যমেও।
গণবিজ্ঞান চেতনার প্রসারের বিষয়ে আজীবন সচেষ্ট বিকাশ নিজের বিজ্ঞানবিশ্বাসের সঙ্গে কোনও রকম আপসে রাজি ছিলেন না। ২০২৩-এ খড়্গপুর আইআইটি-র একটি ক্যালেন্ডারে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান ভাবনার থেকে ধার করা বলে দেখানো হলে তার বিরোধিতা করেন বিকাশ। নবজাগরণ থেকে জ্ঞানদীপ্তি পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপের বিজ্ঞান ভাবনার যে মৌলিকত্ব, তাকে দ্বিধাহীন ভাবে মানতেন তিনি। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে যখন তথাকথিত ‘হিন্দুত্ব’কে বিপুল মহিমা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে, সেখানে স্পষ্ট ভাবে তার বিরোধিতা করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি এই বিজ্ঞানী। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, পশ্চিমি জ্ঞানদীপ্তির সব থেকে বড় ঘটনা দার্শনিক রনে দেকার্তের ‘আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি’ বা ‘কজিটো’-র তত্ত্ব। এবং এই তত্ত্ব কোনও অর্থেই প্রাচীন ভারতীয় দর্শন থেকে ধার করা নয়। আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সংক্রান্ত ভাবনার পিছনেও প্রাচীন ভারতীয় প্রেরণা কাজ করেনি। যখন সব কিছুকেই প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ‘শ্রেষ্ঠত্বের’ আলোয় দেখার প্রবণতা গোটা দেশ জুড়ে চাপিয়ে দেওয়ার কাজ চলেছে, তখন সত্যের অপলাপের তীব্র বিরোধিতা করেন পরমাণু বিজ্ঞানী বিকাশ। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের চিন্তাকাঠামোর বিবর্তন যে সম্পূর্ণ ভাবে দু’টি আলাদা ধারা, তা প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলেছিলেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে। চিন্তাসঙ্কটের এক ঝোড়ো মুহূর্তে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করেছেন তাঁর বিশ্বাসের মর্মস্থল থেকে উঠে আসা উপলব্ধিকে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ‘হাওয়া মোরগ’ হওয়া তাঁর ধাতে ছিল না।
বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাতৃভাষায় কলম ধরেছিলেন বিকাশ। বেশ কিছু ইংরেজি বইয়ের সমান্তরালে বাংলায় ‘স্থান কাল বিশ্বলোক’ বা ‘সৃষ্টি ও কৃষ্টি: বন্ধনহীন গ্রন্থি’-র মতো বই সেই উদ্যোগেরই সাক্ষ্য দেয়। তা ছাড়া নিরলস ভাবে বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বকে, বিশেষ করে ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম ও পরিণতি বিষয়ে লিখে গিয়েছেন দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায়। এই সব লেখালেখি এবং বিভিন্ন সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে বোঝা যায়, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস এমনকি শিল্পকলা বিষয়েও তাঁর চর্চা ছিল গভীর। মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে যে মানব একাকী, সেই ভাবনার শরিক ছিলেন বিকাশ। অন্য একটি সাক্ষাৎকারে ফরাসি বিজ্ঞানী জাক মোনোর ধারণাকে রবীন্দ্রভাবনার পাশাপাশি উল্লেখ করে দৃঢ় ভাবেই জানিয়েছিলেন, মহাবিশ্বে মানবের জন্ম এক আকস্মিক ঘটনা। সৃষ্টি ও ধ্বংসের নিরন্তর পালাবদলের প্রতীক হিসাবে তিনি দেখেছিলেন নটরাজ মূর্তিকে। সে দিক থেকে দেখলে ভারতীয় সংস্কৃতির শিকড়কে বিকাশ কখনওই অস্বীকার করেননি।
সারা জীবনে সম্মান পেয়েছেন প্রচুর। স্বদেশে ২০০১ সালে বিজ্ঞানী রাজা রমন্নার নামাঙ্কিত পুরস্কার থেকে শুরু করে ইউক্রেনের ন্যাশনাল অ্যাকডেমি অফ সায়েন্সের দেওয়া সাম্মানিক ডক্টরেট, জার্মানির আম্বোল্ট রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি তারই সাক্ষ্য দেয়। ভারত সরকার ২০০১ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে, ২০১০ সালে তিনি সম্মানিত হন পদ্মভূষণে। ২০২২ সালে তিনি বঙ্গবিভূষণ হন। ওই বছর রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারও দেওয়া হয় তাঁকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy